Sylhet View 24 PRINT

আম্ফানের পর ছোবল কালবৈশাখীর

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০২০-০৫-২৯ ১৮:৩৯:০৮

সিলেটভিউ ডেস্ক :: চলমান করোনা আতঙ্কের মধ্যেই এক সপ্তাহ আগে বাংলাদেশের উপকূলে আঘাত হানে এই শতাব্দীর প্রথম সুপার সাইক্লোন আম্ফান। এর তাণ্ডবে লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে উপকূলসহ দেশের ২৬টি জেলা। প্রাণ গেছে ২২ জনের। আম্ফানের প্রভাবে জলোচ্ছ্বাসে ভেঙেছে বাঁধ। তলিয়ে গেছে শত শত গ্রাম। ধ্বংস হয়েছে আমের ফলন। ভেসে গেছে মাছের ঘের। দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ের প্রাথমিক তথ্যে বলা হয়েছে, আম্ফানে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে এক হাজার ১০০ কোটি টাকার সম্পদ। আম্ফানের রেশ না কাটতেই এলো আরেকটি দুর্যোগ। ঈদুল ফিতরের দুই দিন পর ঢাকাসহ দেশের প্রায় সব জেলার ওপর দিয়ে বয়ে গেছে কালবৈশাখী। কালবৈশাখীর ছোবলে সারা দেশে প্রাণ গেছে অন্তত ৩০ জনের। বজ পাতেই মারা গেছে ১০ জন। কালবৈশাখীতে দেশের বিভিন্ন স্থানে বাড়িঘর তছনছ হয়ে গেছে। ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ফসলের।

বুধবারের কালবৈশাখীকে চলতি মৌসুমের সবচেয়ে শক্তিশালী হিসেবে বিবেচনা করছে আবহাওয়া অফিস। মঙ্গলবার দুপুর থেকে শুরু হয়ে টানা ঝড়-বৃষ্টি অব্যাহত ছিল এক দিনের বেশি সময়। সাগরে দেওয়া হয়েছে ৩ নম্বর সতর্কতা সংকেত। একদিকে করোনাভাইরাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ, নতুন করে যোগ হওয়া ঘূর্ণিঝড় আম্ফান, মৌসুমের সবচেয়ে শক্তিশালী কালবৈশাখী, সাগরে বিপদ সংকেত, বজ পাতে প্রাণহানির সংখ্যা বৃদ্ধি—একসঙ্গে এত দুর্যোগ মানুষকে দিশাহারা করে তুলছে। আবহাওয়াবিদ আবদুল মান্নানের মতে, ‘বুধবারের কালবৈশাখী দুই কারণে চলতি মৌসুমে সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী ছিল। প্রথমত, এই কালবৈশাখীর বিস্তৃতি ছিল সারা দেশ। সাধারণত অন্য সময়ে যখন কালবৈশাখী হয়, তখন এত বিস্তৃতি থাকে না। কয়েকটি জেলার ওপর দিয়ে ঝড় বয়ে যায়। কিন্তু বুধবারের কালবৈশাখী বয়ে গেছে দেশের প্রায় সব জেলার ওপর দিয়ে। দ্বিতীয়ত, এই সময়ে বৃষ্টি হয়েছে রেকর্ড পরিমাণে। প্রতিটি জেলায় বৃষ্টি হয়েছে গড়ে ৫০ মিলিমিটারের বেশি। শেষ কবে প্রতিটি জেলায় এক দিনে ৫০ মিলিমিটারের বেশি বৃষ্টি হয়েছে, তা বলতে পারেনি আবহাওয়া অফিস। এই কালবৈশাখীর প্রভাবে সিরাজগঞ্জের চৌহালীতে নৌকাডুবির ঘটনায় ১০ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এখনো নিখোঁজ রয়েছে ৯ জন। বুধবার বজ পাতে দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রাণ গেছে অন্তত ১০ জনের। বুধবারের কালবৈশাখীতে ক্ষয়ক্ষতিও হয়েছে বেশি।

আবহাওয়া অফিস থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, বুধবার ঢাকায় চলতি মৌসুমে সবচেয়ে শক্তিশালী কালবৈশাখী রেকর্ড করা হয়েছে। ওই দিন ঢাকায় ঘণ্টায় ৮৩ কিলোমিটার বেগে বাতাস বয়ে গেছে। ফলে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে গাছ উপড়ে রাস্তার ওপরে পড়ে যানবাহন চলাচল ব্যাহত হয়েছে। হাইকোর্ট, রমনা এলাকাসহ বিভিন্ন স্থানে গাছ উপড়ে গেছে। বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে গেছে। ব্যাপক বৃষ্টিপাতের কারণে বিভিন্ন স্থানে দেখা দিয়েছে জলাবদ্ধতা।

আবহাওয়া অফিসের তথ্য বলছে, বুধবার কুমিল্লায় ৬৭ কিলোমিটার, সিলেটে ৭৮ কিলোমিটার, রংপুরে ৪৮ কিলোমিটার বেগে কালবৈশাখী বয়ে গেছে। ওই কালবৈশাখীর বিস্তৃতি ছিল যশোর থেকে সিলেট পর্যন্ত। এত বিস্তৃত কালবৈশাখী চলতি প্রাক-বর্ষা মৌসুমে আর দেখা যায়নি। এ ছাড়া বুধবার দিনাজপুরে সর্বোচ্চ বৃষ্টি হয়েছে ১৪৫ মিলিমিটার। নেত্রকোনায় ৭৪ মিলিমিটার, সিলেটে ৬২ মিলিমিটার ও ঢাকায় ৬৩ মিলিমিটার বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়েছে। ওই দিন বৃষ্টি হয়েছে দেশের প্রায় সব জেলায়ই। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ মোহসীন বলেন, তাঁদের হিসাবে চলতি এপ্রিল থেকে এই পর্যন্ত বজ পাতে প্রাণ হারিয়েছে ৯৩ জন। যদিও বেসরকারি হিসাবে এই সংখ্যা আরো বেশি।

সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, গত মঙ্গলবার দুপুরে সিরাজগঞ্জের চৌহালী উপজেলার স্থলচর এলাকায় যমুনা নদীতে যাত্রীবোঝাই একটি নৌকা ডুবে নিখোঁজ ১৯ যাত্রীর মধ্যে এ পর্যন্ত ১০ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে মঙ্গলবার তিনজনের, বুধবার দুজনের এবং বৃহস্পতিবার আরো পাঁচজনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। নৌকাডুবির পর এলাকাবাসীর সহায়তায় ৫৭ জন ডুবন্ত যাত্রীকে যমুনা নদী থেকে উদ্ধার করা হলেও এখন পর্যন্ত নিখোঁজ রয়েছে ৯ জন যাত্রী। এনায়েতপুর থানার ওসি মোল্লা মাসুদ পারভেজ ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, মঙ্গলবার দুপুরে এনায়েতপুর ঘাট থেকে ইব্রাহিম মাঝির ইঞ্জিনচালিত একটি নৌকা চৌহালীতে যাওয়ার পথে স্থলচর এলাকায় পৌঁছলে প্রচণ্ড বাতাসের কবলে পড়ে। এ সময় নদীতে প্রবল ঢেউয়ের সৃষ্টি হলে ৭৩ জন যাত্রী নিয়ে নৌকাটি ডুবে যায়। ডুবন্ত যাত্রীদের চিৎকারে এলাকাবাসী ৫৪ জন যাত্রীকে জীবিত ও তিনজনের লাশ উদ্ধার করে। এর মধ্যে দুজনের লাশ স্থলচর ও আরেকজনের লাশ কুকুরিয়া এলাকা থেকে উদ্ধার করা হয়। খবর পেয়ে সিরাজগঞ্জ থেকে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা উদ্ধার তৎপরতা শুরু করেন। বিকেলে ঢাকা থেকে সাত সদস্যের ডুবুরিদল ঘটনাস্থলে পৌঁছে। কিন্তু প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে তাদের উদ্ধার তৎপরতা ব্যাহত হয়। বুধবার সকালে জোতপাড়া যমুনা নদীর ঘাট থেকে শাহজাদপুর উপজেলার কৈজুরী গ্রামের আজিজল মোল্লার ছেলে নছি মোল্লা (৩৮) এবং আব্দুর রশিদের ছেলে আমজাদ হোসেনের (৩২) লাশ উদ্ধার করা হয়। এ ছাড়া বৃহস্পতিবার সকালে নদীতে ভাসমান অবস্থায় উপজলোর এনায়তেপুর থকে একজন, খাস কাউলিয়ার চর থেকে একজন, পয়লার চর থেকে একজন ও স্থলচর এলাকা থেকে একজন এবং জোতপাড়া থেকে একজনের মরদেহ উদ্ধার করে স্থানীয়রা।

জয়পুরহাট প্রতিনিধি জানান, ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে জয়পুরহাটে দেয়ালচাপা পড়ে দুই শিশুসহ চারজন নিহত হয়েছে। লণ্ডভণ্ড হয়েছে তিন উপজেলার কয়েক শ ঘরবাড়ি। ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে অটো রাইসমিলের। ভেঙে পড়েছে অসংখ্য মুরগির শেড। মারা গেছে প্রায় ৪৫ হাজার মুরগি। উপড়ে পড়েছে শত শত গাছ ও বিদ্যুতের শতাধিক খুঁটি। ঝড় ও শিলাবৃষ্টিতে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে বোরো ধানের।

নন্দীগ্রাম (বগুড়া) প্রতিনিধি জানান, বগুড়ার কাহালুতে কালবৈশাখীতে ঘরচাপা পড়ে মুক্তিযোদ্ধা ও আওয়ামী লীগ নেতা নজিবর রহমান নজির (৭০) নিহত হয়েছেন। ভোররাতে ঘুমন্ত অবস্থায় নিজ বাড়িতে ঘরচাপা পড়ে তিনি মারা যান।

ঝালকাঠি প্রতিনিধি জানান, ঝালকাঠিতে দুই মিনিটের টর্নেডো বয়ে গেছে ছয় গ্রামের ওপর দিয়ে। এতে লণ্ডভণ্ড হয়েছে শতাধিক বসতঘর, একটি বিদ্যালয়, মসজিদ ও মাদরাসা। উড়ে গেছে টিনের চালা, উপড়ে পড়েছে এবং ভেঙে গেছে ছোট-বড় অসংখ্য গাছ। স্থানীয়রা জানায়, বুধবার রাতে বৃষ্টির সঙ্গে বজ পাত শুরু হয়। রাত ৯টার দিকে আকস্মিকভাবে প্রচণ্ড গতিতে টর্নেডো শুরু হয়। টর্নেডোর আঘাতে কেওড়া ইউনিয়নের সারেঙ্গল, রণমতি, নৈকাঠি, আইহোর, বামনকাঠি ও পার্শ্ববর্তী কীর্তিপাশা ইউনিয়নের তারপাশা গ্রামের ওপর দিয়ে বয়ে যায়। বসতঘর ভেঙে পড়ায় অনেকেই খোলা আকাশের নিছে বসবাস করছে। বিদ্যুতের খুঁটি ভেঙে ও তার ছিঁড়ে রাত থেকে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে উপজেলা প্রশাসন কাজ করছে বলে জানিয়েছেন সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রোজী আকতার।

সুন্দরগঞ্জ (গাইবান্ধা) প্রতিনিধি জানান, গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জে কালবৈশাখীর তাণ্ডবে শতাধিক ঘরবাড়ি ও মৌসুমি ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে বেশ কিছু গ্রামের কাঁচাপাকা ঘরবাড়ি, আম, লিচু, কলা, বোরো ধান, ভুট্টা ও বাদাম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সরেজমিনে গিয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গতকাল (২৪ মে) রবিবার রাত ১১টা থেকে উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় কয়েক দফায় তাণ্ডব চালায় কালবৈশাখী। দফায় দফায় তাণ্ডব চালানো কালবৈশাখীতে লণ্ডভণ্ড হয় দেড় শতাধিক কাঁচাপাকা ঘরবাড়ি। দুমড়েমুচড়ে গেছে অনেক বাড়িঘর। তিনটি ইউনিয়ন শান্তিরাম, শ্রীপুর ও ছাপরহাটির বেশ কয়েকটি গ্রাম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ওই সব এলাকায় অনেকের ঘরের ছাউনি বাতাসে উড়ে গেছে। অনেক পরিবার এখন খোলা আকাশের নিচে বসবাস করছে। বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মৌসুমি ফসলসহ বোরো ধানের আবাদ। এতে বেশ কিছু মৌসুমি ফল আম, লিচু ও কলাবাগান দুমড়েমুচড়ে গেছে। গাছপালা উপড়ে পড়ে অনেক জায়গায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। বিচ্ছিন্ন  রয়েছে বিদ্যুৎ সরবরাহ।

ফরিদপুরের নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, ফরিদপুর সদর উপজেলার কানাইপুরে বজ পাতে এক কৃষকের মৃত্যু হয়েছে। বুধবার সকাল ৯টার দিকে বজ পাত হলে হান্নান সিকদার (৩০) নামের এক কৃষক ঘটনাস্থলেই নিহত হন। আমাদের বরগুনা প্রতিনিধি জানান, বরগুনায় ঘূর্ণিঝড় আম্ফানে ভেঙেছে ২১ কিমি বেড়িবাঁধ। জরুরি মেরামত না হলে সরকারের শতকোটি টাকা গচ্ছার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের প্রভাবে সাড়ে ১১ ফুট উচ্চতার জোয়ারের তীব্রতায় জেলার ২১ কিমি বেড়িবাঁধ আংশিক ভেঙে গেছে। পুরোপুরি ভেঙে গেছে প্রায় ২০০ মিটার বেড়িবাঁধ। এতে জেলার ছয়টি উপজেলার ৮২টি স্থানে বেড়িবাঁধের ক্ষত হয়েছে, যা মেরামত করতে ২০ কোটি টাকার প্রাক্কলন ব্যয় ধরেছে বরগুনা পানি উন্নয়ন বোর্ড।


সৌজন্যে : কালের কণ্ঠ
সিলেটভিউ২৪ডটকম/২৯ মে ২০২০/ডেস্ক/জিএসি

সম্পাদক : মো. শাহ্ দিদার আলম চৌধুরী
উপ-সম্পাদক : মশিউর রহমান চৌধুরী
✉ sylhetview24@gmail.com ☎ ০১৬১৬-৪৪০ ০৯৫ (বিজ্ঞাপন), ০১৭৯১-৫৬৭ ৩৮৭ (নিউজ)
নেহার মার্কেট, লেভেল-৪, পূর্ব জিন্দাবাজার, সিলেট
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.