আজ বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ইং

ক্রয় নয় ভাড়ায় বেশি আগ্রহ, দুটি গাড়িতে ব্যয় ১ কোটি ১৫ লাখ!

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০২০-০৯-২৫ ২২:০৪:০৮

সিলেটভিউ ডেস্ক :: মা-ইলিশ ও জাটকা সংরক্ষণ এবং ইলিশ উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য ‘ইলিশ সম্পদ উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা’ শিরোনামে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় একটি প্রকল্পের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। গত ২২ সেপ্টেম্বর পাস হওয়া প্রকল্পটি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে মৎস্য অধিদফতর ২০২০ সালের জুলাই থেকে ২০২৪ সালের জুন মেয়াদে বাস্তবায়ন করবে। প্রকল্পে মোট ব্যয় হবে ২৪৬ কোটি ২৮ লাখ টাকা। এর মধ্যে দুটি গাড়ি ভাড়া বাবদ চার বছরে খরচ ধরা হয়েছে এক কোটি ১৫ লাখ ২০ হাজার টাকা।

প্রকল্পটির উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) সূত্রে জানা যায়, প্রকল্পের অধীনে থাকা ২৯টি জেলার ১৩৪টি উপজেলার কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়নে পর্যবেক্ষণ, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়নের জন্য প্রতি মাসে একটি গাড়ির ভাড়া ধরা হয়েছে এক লাখ দুই হাজার টাকা। ফলে দুটি গাড়ির চার বছরের (৪৮ মাস) ভাড়া খরচ ধরা হয়েছে এক কোটি ১৫ লাখ ২০ হাজার টাকা। তেল খরচ ছাড়াই এই অর্থ ভাড়া বাবদ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।

এক কোটি ১৫ লাখ টাকা খরচে দুটি গাড়ি অনায়াসেই কেনা যায়। চাইলে তিনটি গাড়িও কেনা সম্ভব। গাড়ি না কিনে ভাড়ার পেছনে এত টাকা খরচের কারণ কী, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

প্রকল্পটি যাচাই-বাছাই করেছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের কৃষি, পানিসম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগ। দুটি গাড়ি না কিনে এক কোটি ১৫ লাখ টাকা ভাড়ার পেছনে খরচের কারণ কী— জানতে চাইলে কৃষি, পানিসম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগের সদস্য (সচিব) মো. জাকির হোসেন আকন্দ বলেন, ‘সরকার বর্তমান পরিস্থিতিতে গাড়ি না কেনার জন্য সার্কুলার দিয়েছে। এখন সার্কুলার যেহেতু দিয়েছে, কাজ তো করতে হবে। সুতরাং আউটসোর্সিং (ভাড়া) ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।’

কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হলে গাড়িগুলো অফিসের পেছনে পড়ে থাকে। ছোট প্রকল্পে ব্যবহার দুরূহ হয়ে পড়ে। এছাড়া কোনো গাড়ি যদি সরকার কেনে, তার জন্য একজন চালক লাগে। দেখা যাবে, সেই চালক আবার রাজস্ব খাতে আসতে চায়। সামগ্রিক বিষয় বিবেচনা করে আমরা প্রকল্প মেয়াদের জন্য, যেসব প্রকল্পে এ রকম আছে, সেখানে গাড়ি সরাসরি দিচ্ছি না।’

আরও কারণ ব্যাখ্যা করে জাকির হোসেন আকন্দ বলেন, ‘দুটি গাড়িই ভালো হতে হবে। এগুলো গ্রামে চলবে। শহরের গাড়িগুলোর চাকা খাটো। সেই গাড়ি কিন্তু গ্রামের ভেতরে কাদার রাস্তায় চলতে পারবে না। সুতরাং গ্রামের রাস্তায়, কাদার ভেতরে চলার জন্য একটু মানসম্মত গাড়ি দরকার। সেসব গাড়ি কোনো অবস্থায়ই মাসে এক লাখ টাকা ছাড়া পাওয়া যাবে না। আমি নিজে খবর নিয়েছি।’


তবে কৃষি, পানিসম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগের সদস্যের যুক্তি টেকেনি পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নানের কাছে। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘গাড়ি ভাড়া বনাম গাড়ি কেনা, এখানে কিছু যুক্তি আছে। আমার সচিব মহোদয় বা বিভাগকে অনুরোধ করব যে, এটা আরেকটু দেখতে। প্রয়োজনে সচিবের (মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়) সঙ্গে কথা বলা যায়। যদি সামান্যতম সুযোগ থাকে রিভিশনের (পুনর্বিবেচনা করা), ফর বেটার উই ডু (ভালোর জন্য করব)।’

মন্ত্রী আরও বলেন, ‘আপনাদের অবগতির জন্য বলছি, পাস করা মানেই নয় যে করতে হবে। পাস করার পরও আমাদের আইএমইডি (বাস্তবায়ন পরীবিক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ) আছে। ওই মন্ত্রণালয়ের (মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ) নির্বাহী প্রধান বা সচিব, তিনি বিষয়গুলো দেখেন সার্বক্ষণিক।’

বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করা হবে কি-না, জানতে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব রওনক মাহমুদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তবে কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।


সমাধান কী?

গত ৮ জুলাই সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ পরিপত্র জারি করে বলেছে, ‘চলমান কোভিড-১৯ পরিস্থিতি মোকাবিলা এবং সরকারের কৃচ্ছ্র সাধন নীতির আলোকে আগামী ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সব সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের পরিচালন এবং উন্নয়ন ব্যয়ের আওতায় সব প্রকার নতুন/প্রতিস্থাপক হিসেবে যানবাহন ক্রয় বন্ধ থাকবে।’

গাড়ি ভাড়ার বিষয়ে যেসব যুক্তি কৃষি, পানিসম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগের সদস্য (সচিব) মো. জাকির হোসেন আকন্দ দেখিয়েছেন, তার মধ্যে অন্যতম হলো সরকার এমন সার্কুলার জারি করায় এ প্রকল্পে গাড়ি ভাড়া করা ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই।

বিষয়টি বিস্তারিত জানানো হলে বিশ্বব্যাংকের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘পরিকল্পনা কমিশনের যারা যাচাই-বাছাই করছেন এবং যে মন্ত্রণালয় প্রস্তাব পাঠিয়েছে, তাদের সদিচ্ছার অভাব রয়েছে। তা না হলে এ ধরনের যুক্তি দেয় কীভাবে যে, গাড়ি কিনতে না করেছে, সেজন্য ভাড়া করছি। তারা ভাড়া করছে চার বছরের জন্য!’

‘দৈনিকভিত্তিতে তো গাড়ি ভাড়া করা যায়। এমন তো নয় যে, মাসিকভিত্তিতে ভাড়া করতে হবে। গাড়ি তো অনেক সময় একটা ট্রিপের (পূর্বনির্ধারিত সময়ে প্রকল্প পরিদর্শনে) জন্যও করা যায়। সারাদিনের জন্য যে ভাড়া করতে হবে, তা তো না। মানে, কাজ বিঘ্নিত না করে খরচ নিয়ন্ত্রণের বিভিন্ন উপায় আছে। গাড়ি যখন দরকার, তখনই ভাড়া করা যায়। প্রয়োজন না হলে করলাম না। আরেকটা বড় কথা হলো, গাড়ি নাই, এমনও নয়। মন্ত্রণালয়ের তো গাড়ি আছে। ভাড়া করতে হবে কেন? অনেক সময় ভাড়া করারই দরকার পড়ে না। গাড়ি হয়তো বসেই আছে। কিন্তু আপনি আরেকটা ভাড়া করছেন! একটা গাড়ি বসে আছে, ওই মন্ত্রণালয়ের লোকজন আরেকটা গাড়ি ভাড়া করে খরচ করছে! সমন্বয়, পরিকল্পনা— এগুলো সঠিকভাবে করলে তো সরকারি ব্যয়ের অনেক সাশ্রয় হয়। কিন্তু সেটা তো করবে না। ভাড়া করলে তো শুধু গাড়ি সার্ভিস পাচ্ছে না, আরও তো কিছু পাচ্ছে, তাই না? কিছু কমিশন-টমিশন তো থাকেই।’

তিনি বলেন, ‘পরিকল্পনা কমিশনের পিইসির দায়িত্ব প্রশ্নগুলো তোলা। এগুলোর সন্তোষজনক উত্তর না পেলে ডিপিপিটাকে ফেরত পাঠানো। অথচ প্রকল্পটি একনেকে পাস হয়ে গেছে! এটা দুঃখজনক ব্যাপার। যাদের দায়িত্ব এ ধরনের প্রস্তাব নজরে আনার, তাদের নজরে পড়ল না! সার্কুলারের উদ্দেশ্য হলো খরচ কমানো, খরচ নিয়ন্ত্রণ করা। গাড়ি না কিনে ভাড়া করলে খরচের নিয়ন্ত্রণ তো আর থাকল না। এটুকু বোঝার ক্ষমতা নিশ্চয়ই তাদের আছে। তারা যে না বুঝে করেছে, এটাও নয়।’

ড. জাহিদ হোসেন আরও বলেন, ‘দায়িত্বশীল কর্মকর্তা হলে স্বপ্রণোদিত হয়ে নিজেদেরই এগুলো যাচাই-বাছাইয়ের কথা। একটা কথা বললাম, সেটার শাব্দিক অর্থ থাকে, আরেকটা উদ্দেশ্য থাকে। বিষয়টি হলো খরচ কমানো। কথার মারপ্যাঁচে পার পেয়ে যাওয়ার চেষ্টা, আর কি? এগুলো দুঃখজনক। একজন পাবলিক সার্ভেন্ট থেকে আমরা এগুলো আশা করি না।’

এ ঘটনা থেকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের শিক্ষা নেয়া উচিত— উল্লেখ করে বিশ্বব্যাংকের সাবেক লিড এ ইকোনমিস্ট বলেন, ‘পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের এখন তো আর কিছু করার নেই। পাস হয়ে গেছে। এ থেকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের একটা শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত যে, তাদের আরেকটু সুনির্দিষ্টভাবে বলা। খরচ সাশ্রয়ের উদ্দেশ্যে আমরা এ ব্যবস্থা নিয়েছি।’

ভ্রমণে খরচ ৭ কোটি

ডিপিপি থেকে আরও জানা যায়, প্রকল্পের অধীনে ১৭৪ কর্মকর্তা ২৯টি জেলার ১৩৪টি উপজেলা ভ্রমণ করবেন। চার বছরে এজন্য তারা খরচ করবেন ছয় কোটি ৯৯ লাখ ৭২ হাজার টাকা। অর্থাৎ ১৭৪ কর্মকর্তার প্রত্যেকে প্রতি বছর ভ্রমণ বাবদ খরচ করবেন এক লাখ ৫৩৪ টাকা করে, যা দুটি ভাড়া করা গাড়ির বাইরের খরচ।

এ বিষয়ে কৃষি, পানিসম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগের সদস্য জাকির হোসেন আকন্দ বলেন, ‘আপনারা জানেন, কোনো প্রকল্পে ভ্রমণ ব্যয় অতিরিক্ত দেখানোর ব্যবস্থা নাই। তাকে ভ্রমণ টিকিট জমা দিতে হবে, তারপর বিল করতে হবে। সুতরাং ভ্রমণ বিভাগের খরচে যদি টাকা কিছু বেশি ধরাও থাকে, তা অব্যয়িত থাকবে।’

প্রকল্প সূত্র জানায়, প্রকল্পে সিল ও স্ট্যাম্পে ১০ লাখ, মনিহারিতে ২০ লাখ, মুদ্রণ ও বাঁধাইয়ে এক কোটি ১৬ লাখ, জনসচেতনতা সভায় এক কোটি ১৬ লাখ, ৬০টি সেমিনার/কনফারেন্সে খরচ এক কোটি ৩৫ লাখ, অভ্যন্তরীণ প্রশিক্ষণে খরচ ১৬ কোটি ৬৮ লাখ, ২২ দিনে মৎস্য সংরক্ষণ আইন বাস্তবায়নে খরচ এক কোটি ৬০ লাখ, পেট্রল ও লুব্রিকেন্ট খরচ ১৬ লাখ ৮০ হাজার, বদলি ব্যয় ১১ লাখ ৩৪ হাজার, তিনটি এসিতে খরচ চার লাখ ৫০ হাজার, ৩৫ লাখ টাকার আসবাবপত্র, দেড় লাখ টাকার একটি ফটোকপিয়ার, যানবাহন মেরামত ও সংস্কারে চার লাখ টাকা খরচ করা হবে। এমন মোট ৫১টি খাতে এ প্রকল্পে খরচ করা হবে ২৪৬ কোটি ২৮ লাখ টাকা।

প্রকল্পের উদ্দেশ্য হলো, মা-ইলিশ ও জাটকা সংরক্ষণে মৎস্য সংরক্ষণ আইন বাস্তবায়ন এবং অভয়াশ্রম ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধি করা। দক্ষতা বৃদ্ধি করে জাটকা ও মা-ইলিশ আহরণকারী ৩০ হাজার জেলে পরিবারের বিকল্প কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা। জেলেদের ১০ হাজার বৈধ জাল বিতরণ এবং প্রচারের মাধ্যমে মা-ইলিশ ও জাটকা সংরক্ষণে জনসচেতনতা তৈরি করা।



সিলেটভিউ২৪ডটকম/২৫ সেপ্টেম্বর ২০২০/ জাগোনিউজ২৪ / জিএসি

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন