আজ বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪ ইং

মুক্তিযুদ্ধে যে চ্যালেঞ্জ নিয়েছিলেন সি আর দত্ত বীরউত্তম

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৭-১২-০৭ ০০:১১:০০

সি আর দত্ত বীরউত্তম :: আমার চাকরি জীবন শুরু হয়েছিল পশ্চিম পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে। ১৯৭১ সালে যখন স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হয় তখন পরিবার নিয়ে তিন মাসের ছুটিতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে অর্থাৎ বাংলাদেশে আমার জন্মস্থান হবিগঞ্জে বেড়াতে আসি। এ সময় সিলেটের এমপি জেনারেল রব ও মানিক চৌধুরী আমাকে স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে বলেন। সেদিন আমি রব দাদাকে বলেছিলাম, ‘আমি এত দিন এটাই চেয়েছিলাম। কিন্তু কেউ আমাকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের ব্যাপারে কিছু বলেননি। আপনি বলেছেন, আমি যুদ্ধে অবশ্যই অংশগ্রহণ করব। ’

জেনারেল রব আমাকে যুদ্ধের চার নম্বর সেক্টর, সিলেট শত্রুমুক্ত করার দায়িত্ব দিলেন। নিজ এলাকা শত্রুমুক্ত করার দায়িত্ব পেয়ে আমি বেশ আনন্দিত হলাম। কানাইঘাটে অপারেশনের জন্য আমাকে ‘বীরউত্তম’ উপাধি দেওয়া হয়। কানাইঘাট শত্রুমুক্ত করার দায়িত্ব ছিল আমাদের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ। আমার সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য সামরিক বাহিনীর লোকজন তখন সংখ্যায় খুব কম ছিল।

কেবল যারা ছুটিতে ছিল তারাই যুদ্ধে অংশ নিতে পেরেছিল। যোদ্ধার সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য আমরা এ সময় সিলেটের সাধারণ মানুষকে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করলাম। এতে হবিগঞ্জের ছেলেরা খুব উৎসাহিত হলো। দু-তিন মাসের ট্রেনিংয়ে আমাদের কাছ থেকে দু-তিন শ ছেলে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করল। আমরা প্রথম হবিগঞ্জ শত্রুমুক্ত করলাম। এরপর আমাদের হাতে শেরপুর ও যাদিপুর দখলমুক্ত হয়। একদিন শুনতে পেলাম হানাদার বাহিনী কুশিয়ারা নদীর পাড়ে অবস্থান নিয়েছে। তবে সে জায়গাটি শত্রুমুক্ত করতে আমি জেনারেল রবের কাছে একটু সময় চাইলাম। ইতিমধ্যে শত্রুরা খবর পেয়ে যায় যে, আমি পশ্চিম পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে ছিলাম। এ সময় শেরপুর ও যাদিপুরে বেশ বড় ধরনের লড়াই হয়। চার-পাঁচ দিন টানা লড়াই শেষে এ অঞ্চল শত্রুমুক্ত হয়। এ সময় দলে সৈন্যসংখ্যা আরও বৃদ্ধি করার জন্য আমরা জেনারেল রবের কাছে সাহায্য চাইলাম। তখন তিনি ইপিআর বর্ডারের ট্রেনিংপ্রাপ্ত সৈন্যদের সহযোগিতায় আমাদের সাধারণ মানুষকে যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। এতে প্রশিক্ষণ পায় দেড় শর মতো সৈন্য। এর ফলে চার নম্বর সেক্টরে সৈন্যসংখ্যা আরও বৃদ্ধি পেল।

ডিসেম্বরের শেষে এসে সিলেটকে পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কবল থেকে মুক্ত করা হয়। ভারতীয় সেনাবাহিনী যুদ্ধ চলাকালে আমাদের সাহায্য করেছিল। একদিন ভারত থেকে এক ছেলে এসে বলল, ‘স্যার! আমি ক্যাপ্টেন হামিদ, একজন ভারতীয় সেনা। আমাকে এখানে পাঠানো হয়েছে আপনাকে যুদ্ধে সহযোগিতা করতে। ’ ভারতীয় সেনাবাহিনী গোলাবারুদ দিয়েও আমাদের সাহায্য করেছিল। কানাইঘাট শত্রুমুক্ত করার দায়িত্বটি আমাদের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ। কারণ সিলেট জয় করতে হলে অবশ্যই কানাইঘাট জয় করতে হবে। সে সময় আমরা জানতে পারলাম, সুরমা নদীর অন্য প্রান্তে ভারী অস্ত্রে সজ্জিত হানাদার বাহিনী অবস্থান নিয়েছে। আমরা তখন ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাহায্যে শত্রুর ওপর আর্টিলারি শেল নিক্ষেপ শুরু করি। শেষ পর্যন্ত শত্রু তার অবস্থান থেকে পিছে সরে যায়। আমার ধারণা, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আমাদের থেকে সৈন্য ও অস্ত্রে এগিয়ে থাকলেও যেহেতু তারা পূর্ব পাকিস্তানের মানুষদের সঙ্গে ভুল কাজ করছিল সে কারণে তাদের মানসিক শক্তি দুর্বল ছিল। যদিও পশ্চিম পাকিস্তানে আমার বাড়ি ও ব্যবহারের জিনিসপত্র ফেলে এসেছিলাম। কিন্তু যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর আমি আর সেখানে ফিরে যাইনি। আমি বাংলাদেশ আর্মিতে যোগ দিই। বিজয়ের ৪৬তম বছরে এসে বলতে চাই, শিগগির অবশিষ্ট যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও এর রায় কার্যকর হওয়া দরকার। সরকার যত দ্রুত তা বাস্তবায়ন করবে ততই ভালো। কারণ, যারা মুক্তিযুদ্ধের সময় পশ্চিম পাকিস্তানের পক্ষে ছিলেন এবং সেই চিন্তাধারায় বিশ্বাসী ছিলেন তাদের বিচার করা না হলে গোষ্ঠীটি পুনরায় দেশে গণ্ডগোল বাধানোর চেষ্টা করবে। তবে যে সরকারই আসুক না কেন শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য তাদের কাজ করে যেতে হবে। আমি বিশ্বাস করি, দেশের উন্নতির জন্য তরুণ প্রজন্ম তাদের সবটুকু ঢেলে দেবে। স্বাধীনতার স্বপ্ন কতটুকু বাস্তবায়ন হয়েছে তার মূল্যায়ন আমি করতে পারব না। কিন্তু এটি বলব যে, বহু ঘাত-প্রতিঘাতে বেশকিছু ভালো অর্জনও আমাদের আছে। নিজ ভাষা, সংস্কৃতি ও কৃষ্টি মিলিয়ে আমি যে বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছি তা স্বাধীনতার এত বছর পর যে খুব খারাপ চলেছে তা নয়। যত দিন আমি এ দেশে বেঁচে থাকব একজন বাঙালির মতো করেই জীবনযাপন করব। যদি সরকার দেশের কৃষ্টি, কালচার ও সংস্কৃতির সঠিক বিকাশ ঘটাতে পারে তবেই দেশ ভালোভাবে চলবে। আর এর পুরো দায়ভার সরকারের। যেহেতু এ দেশে জন্মেছি তাই দেশের প্রয়োজনে যে কোনো সময় এগিয়ে আসতেও দ্বিধাবোধ করব না। অনুলিখক : জিন্নাতুন নূর।

সিলেটভিউ২৪ডটকম/০৭ ডিসেম্বর ২০১৭/ডেস্ক/ডিজেএস

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন