আজ শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ ইং

সিলেটের জয়িতা-১: ১৪শ’ দিয়ে শুরু, অর্ধকোটি টাকার পুঁজি আসমার!

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৭-১২-৩০ ০০:০৪:৪৬

এনামুল কবীর :: তাঁর ভাষায়, এখনও বাংলাদেশের মহিলাদের জীবন অনেকটা লতা’র সেই বিখ্যাত গান ‘উড়তে মানা আকাশে তোর, বসতে মানা ডালে, বাসা বাঁধতেও মানা, কি আছে কপালে’র মতো। তবু এরমধ্যেই তিনি একজন সফল মানুষ। বিশেষ করে নারী উদ্যোক্তা হিসাবে মাত্র ১৪শ’ টাকায় বাজিমাত করতে পেরেছেন তিনি। আজ তার ব্যবসার পুঁজি অর্ধকোটি টাকারও বেশি! তিনি আসমা উল হাসনা খান। সফল উদ্যোক্তা এবং সিলেট জেলার ‘জয়িতা’।

নানা প্রতিকূলতা পেরিয়ে সফল নারীদের সরকার যে সম্মাননা জানায়, তার নাম ‘জয়িতা অন্বেষণে বাংলাদেশ’। এ কর্মসূচির আওতায় এবার ৫টি ক্যাটাগরিতে সিলেট জেলা পর্যায়ে ৫ জন নারীকে জয়িতা সম্মাননা জানানো হয়েছে। আসমা উল হাসানা জয়িতা হয়েছেন ‘অর্থনৈতিক সাফল্য অর্জনকারী নারী’ ক্যাটাগরিতে।

সম্প্রতি সিলেটভিউ২৪ডটকম’র মুখোমুখি হন আসমা উল হাসনা খান। কথায় কথায় আসমার প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়াই করার মানসীক শক্তি অর্জনের রহস্য উনো¥াচিত হলো। তার বাবা নূর মিয়া ছিলেন একজন মুক্তিযোদ্ধা, ১১নং সেক্টরে যুদ্ধ করেছেন। দেশেরে জন্য লড়তে লড়তে শহীদ হয়েছেন তার ৩ মামা। রাজাকার-হানাদার মিলে তাদের গ্রামের বাড়ি এবং নানার বাড়িও পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল সেই একাত্তরে। এমন পরিবারের একটি মেয়ে প্রতিকূলতা কাটিয়ে সফল হওয়ার শক্তি অর্জন করতে পারবেন না তো, পারবে কে!

আসমা উল হাসানার জন্ম সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা উপজেলার সেলবরষ গ্রামে, মামার বাড়িতে। নিজের বাড়িও ওই উপজেলায়।

বেগম রোকেয়ার আদর্শে অনুপ্রাণিত আসমা সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মাননি। ছোটবেলা থেকেই দারিদ্রের বিরুদ্ধে কঠোর সংগ্রামে নামতে হয়েছে তাকে। সেই গত শতাব্দীর ’৮৮ সালে সেলাই শিখতে শুরু করেন। লেখা-পড়া এসএসসি পর্যন্ত। ১৯৯০-৯১ সালে সিলেট মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরে এক বছর মেয়াদী দর্জি বিজ্ঞান ট্রেডে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।

এর পরপরই শুরু তার উত্থান পর্ব। নানির কাছ থেকে পাওয়া মাত্র ১৪শ’ টাকা পুঁজি নিয়ে শুরু করেন নিজের ব্যবসা। দোকান নিলেন সিলেট প্লাজা মার্কেটে। নাম দিলেন স্টার প্লাজা টেইলার্স। নানা প্রতিকূলতা মাড়িয়ে এগুতে শুরু করলেন তিনি। ২০১৪ সালে স্টার ফ্যাশন হাউস নামে আরেকটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান চালু করেন। বর্তমানে সেখানে ৬০ থেকে ৬৫ জন মানুষ কাজ করছেন। তাদের বেশির ভাগই সমাজের অবহেলিত এবং চরম দরিদ্র। জানালেন ভালোই চলছে তার ব্যবসা।

ব্যবসায় নেমে অবশ্য ব্যর্থতার ছোঁয়াও পেয়েছেন তিনি। জিন্দাবাজারের আল-হামরায় একটি দোকান করেছিলেন। অজ্ঞাত কারণে তিনি ব্যর্থ হয়েছেন সেখানে। মৃদু হেসে জানালেন, ‘৫ লাখ টেকা আমার লস অইসে, কথাটা লেখইন যেনো ভাই।’

দুই সন্তানের জননী আসমার স্বামী আবুল খায়েরও একজন ব্যবসায়ী।

নারী উদ্যোক্তা হিসাবে সফল হতে কি কি প্রতিকূলতা মোকাবেলা করতে হয়েছে আপনাকে? এমন প্রশ্নের জবাবে আসমা জানালেন, প্রতিকূলতাতো সব জায়গায়। ঘরে-বাইরে সব জায়গায়, সব সময় নানা বিধি-নিষেধ তো আছেই, আছে প্রতিদ্ব›িদ্ব ব্যবসায়ীদের প্রতিহিংসামূলক আচরণও।

সেটা কি রকম? আসমা বলেন, ‘‘একজন ভালো কারিগর বা কাটিং মাস্টার রাখলে এমন অনেকেই আছেন, ‘বেটিনতোর দোকানো কাম করনি বা?’ ‘ই বেটি যে জল্লাদ’ ‘বেটাগু অইয়া বেটিনতোর দোকানো...’ ইত্যাদি নারীবিদ্বেষমূলক কথা-বার্তা বলে পকেটের টাকা দিয়ে চা খাওয়ায়। এমন কুমন্ত্রণায় এক সময় সেই মাস্টার বা কারিগর বিদায় নিয়ে নেয়। বার বার এসব প্রতিকূলতায় পড়তে হয়েছে আমাকে।’’

পারিবারিক এবং সামাজিক ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। সেখানেও পুরুষ সদস্যদের কাছে এমন কথা বলার লোকের অভাব ছিল না একসময়। তবু এগিয়ে গেছেন আসমা। মোটেও পাত্তা দেননি এসব। নিজের পরিবার থেকে সহযোগিতা তিনি ‘আদায়’ করে নিয়েছেন বলে খুব জোর দিয়েই বললেন।

ব্যবসা করে তিনি যে কেবল নিজেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন তা নয়। আসমার কাছে প্রশিক্ষণ নিয়ে ব্যবসা এবং চাকুরির মাধ্যমে সফল নারীর সংখ্যা ১৯/২০ জন তো হবেই। তারা এই সিলেট শহরে এবং কয়েকজন নিজেদের গ্রামের বাড়িতে, স্থানীয় বাজারে ব্যবসা করছে, বেশ তৃপ্তি নিয়েই জানালেন তিনি।

প্রশিক্ষক হিসাবে আসমা ‘অঙ্গরুপা’ নামে একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে ছিলেন। অনেকেই সেখানে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। উদ্যোক্তা হিসাবে বেশ কিছু পুরস্কার জমা হয়েছে সফল এই মানুষটির শোকেসে। যেমন, সফল নারী উদ্যোক্তা হিসাবে ২০১৬ সালে পেয়েছেন ওসমানী পদক, ২০১৫ সালে শেরে বাংলা পদক। সিলেটে ‘হাসন উৎসব ২০১৭’ উপলক্ষেও  পদক পেয়েছেন তিনি। সর্বশেষ, সরকারি স্বীকৃতি ‘জয়িতা’ পুরস্কার।

শুধু সেলাই মেশিন চালানোই নয়, রান্না-বান্নায়ও দারুন দক্ষ এই ‘জয়িতা’। ২০১২ সালে তার বোন সাব্রিনা খানের সাথে যৌথভাবে পেয়েছিলেন সেরা রাঁধুনী অ্যাওয়ার্ড। নারী উদ্যোক্তা হিসাবে এ বছরই তিনি মাছরাঙা টেলিভিশনের ‘রাঙা সকাল’ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছিলেন।

বাংলাদেশে নারী উদ্যোক্তাদের সাফল্য অর্জনে প্রধান প্রতিবন্ধকতাগুলো চিহ্নিত করতে গিয়ে আসমা বলেন, ‘প্রত্যেক নারী কোননা কোনভাবে নির্যাতিত। পারিবারিক, সামাজিক, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন মোকাবেলা করতে হচ্ছে প্রতিটি নারীকেই। উদ্যোক্তা হিসাবে অনেকের হিংসাবিদ্বেষের মোকাবেলা করতে হয়। কুৎসা বদনাম রটায় হীনমন্যরা। সমাজ থেকে এগুলো দূর করে সবাইকে আরও ইতিবাচক হতে হবে।’
 
এমন পরিস্থিতিতে পড়া মেয়েদের উত্তরণের উপায়ও বাতলে দিলেন সফল এই মানুষ, ‘কঠোর পরিশ্রম, মুখ বন্ধ রেখে ধৈর্যের সাথে কাজ চালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি স্বামী এবং পারিবারের অন্যান্য সদস্যদের সহযোগিতাও খুবই জরুরী।’

সিলেটভিউ২৪ডটকম/৩০ ডিসেম্বর ২০১৭/এমইকে/আরআই-কে

@

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন