আজ শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ ইং

বিশ্বনাথে ঐতিহ্যের পলো বাওয়ায় উৎসবের আমেজ

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৮-০১-১৪ ১৮:২৫:৩০

প্রনঞ্জয় বৈদ্য অপু, বিশ্বনাথ :: ‘ঝপ-ঝপা-ঝপ’ শব্দের তালে তালে বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনায় সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলার গোয়াহরী গ্রামের ‘বড় বিলে’ বার্ষিক পলো বাওয়া উৎসব সম্পন্ন হয়েছে। প্রায় দু’শত বছর ধরে বংশানুক্রমিকভাবে বাংলা বছরের প্রতি মাঘ মাসের ১ তারিখ চিরায়ত বাংলার ঐতিহ্যবাহী পলো বাওয়া উৎসব পালিত হয়ে আসছে। দৌলতপুর ইউনিয়নের অবস্থিত ওই বিলে বার্ষিক পলো বাওয়াতে গোয়াহরী গ্রামবাসী ছাড়াও আশপাশের গ্রামের লোকজন অংশগ্রহণ করে থাকেন, তবে বাদ পড়েন না প্রবাসীরাও। সবার অংশগ্রহণে পলো বাওয়ায় তৈরী হয় উৎসবের আমেজ।

বাঁশ আর বেতের সমন্বয়ে তৈরী করা পলো ও উড়াল-চিটকি-ঠেলা জাল দিয়ে শীত উপেক্ষা করা এক সাথে মাছ শিকার করাই গ্রামবাসীর প্রধান এক আনন্দের উৎসব। তাই আনন্দের ওই উৎসব পালন করতে প্রতি বছর পহেলা মাঘের অপেক্ষায় থাকেন গ্রামবাসী। আর ওই আনন্দ থেকে বাদ পড়তে চান না গ্রামের জামাইরাও। প্রায় পরিবারেই ১লা মাঘ মাস আসার পূর্বে বিয়ে হয়ে যাওয়া গ্রামের মেয়েরা নিজের স্বামী-সন্তান ও আত্মীয়-স্বজন নিয়ে বাবার বাড়িতে বেড়াতে চলে আসেন।

রবিবার সকাল সাড়ে ১১টার দিকে হৈ হৈ করে একসাথে পলো-জাল হাতে মাছ শিকারে নেমে পড়েন সবাই। বিলে প্রচুর পরিমাণ মাছ থাকায় পলো বাওয়া উৎসবে অংশগ্রহন করা কাউকেই খালি হাতে ফিরতে হয়নি। এমনকি শিশুরাও জাল দিয়ে বিলের তীরের কাছে মাছ শিকার করতে সক্ষম হয়েছে। আর তরুণ-কিশোর-যুবক-বৃদ্ধ সবাই বোয়াল, রুই, গজার, কালীবাউস, শোল, বাউশ, কার্পু, কাতলা, শিং, মাগুর, কৈসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ শিকার করেন। একেকটি মাছ শিকারের সাথে সাথে চিৎকার করে নিজেদের আনন্দ প্রকাশ করেন শিকারীরা। শিকারীদের ওই আনন্দের সাথে সাথে তাল মেলান বিলের তীরে অপেক্ষমান গ্রামের মুরব্বী, মহিলা ও শিশুরা।

পলো বাওয়া উৎসবের আনন্দ বাড়িয়ে দেয় বাবা-চাচা, ভাই-দাদা, মামা-ফুফার সাথে আসা শিশুরা। নিজের আত্মীয়-স্বজনের কেউ মাছ শিকার করলে তাদের আনন্দ আর কে দেখে! বিলের তীরে শিশুরা অপেক্ষা করে কখন নিজের কেউ মাছ শিকার করে এনে তাদের হাতে দেবেন, আর তারা কখন নিজের শরীরের প্রায় অর্ধেক ওজনের মাছটি বহন করে বাড়িতে পৌঁছে দেবে। মাছ শিকার পর চিৎকারের আওয়াজই এলাকাকে জানিয়ে দেয় কেমন পরিমাণ মাছ শিকার করেছেন শিকারীরা।

‘পূর্ব পুরুষদের রেখে যাওয়া ঐতিহ্য দীর্ঘকাল ধরে বিপুল পরিমাণ উৎসাহ-উদ্দীপনায় আমরা গ্রামবাসী একসাথে প্রতি বাংলা বছরের ১লা মাঘ বার্ষিক পলো বাওয়া উৎসব পালন করে থাকি ’ মন্তব্য করে স্থানীয় ইউপি সদস্য গোলাম হোসেন বলেন, ‘ওই উৎসবের আনন্দ অন্য কোন কিছুর মাধ্যমে পাওয়া যাবে না। আর উৎসবের ওই দিন মাছ শিকার করতে পারলে তো আরও কোন কথাই নেই। শুধু আনন্দ আর আনন্দ।’

গ্রামের প্রবীণ মুরব্বী হাজী তৈমুছ আলী বলেন, ‘বয়সের কারণে এখন আর পলো বাওয়াতে অংশগ্রহণ করতে পারি না। তবে জীবনে ওই বিলে প্রচুর পরিমাণ মাছ শিকার করেছি। পূর্বপুরুষের আমল থেকে মাঘ মাসের পহেলা তারিখ পলো বাওয়া উৎসবকে কেন্দ্র করে বিলের তীরে গ্রামবাসীর এক মহামিলন হয়। ওই সময়ের আনন্দই সম্পূর্ণ আলাদা, মুখে বলে তা বুঝানো যাবে না।’

যুক্তরাজ্যপ্রবাসী রহমত উল্লাহ বলেন, ‘দীর্ঘ প্রায় ২৭ বছর ধরে প্রবাসে বসবাস করে আসছি। ইচ্ছে থাকা সত্ত্বে ওই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে ব্যস্ততার কারণে কখনও পলো বাওয়াতে অংশগ্রহণ করতে পারিনি। এবার তা পূরণ হয়েছে।’

গ্রামের জামাই মামুনুল হুদা মামুন বলেন, ‘প্রতি বছর পলো বাওয়া উৎসবে এক সাধারণ দর্শক হিসেব আসতাম। এবার গ্রামের জামাই হিসেবে এসেছি বউকে সাথে নিয়ে। ছোট ভাইয়েরা (শালা) মাছ শিকার করেছে। তাতে অনেক আনন্দ পেয়েছি।’

পলো বাওয়া উৎসবে অংশ নেওয়া উপজেলার কালীগঞ্জের এম এ রব ও চৌধুরীগাঁও গ্রামের তাহিরান আলী বলেন, ‘গ্রামে আত্মীয়-স্বজন থাকার কারণে অন্যান্য বছরের মতো এবারও বার্ষিক পলো বাওয়া উৎসবে অংশগ্রহণ করে মাছ শিকার করেছি। অন্য গ্রামের বাসিন্দা হওয়ার পরও গ্রামবাসী তাদের আনন্দের ওই উৎসবে শরিক হওয়ার সুয়োগ দেওয়ায় আমরা আনন্দিত।’

গৃহবধু ছুরেতুন বিবি বলেন, ‘বিয়ে হয়ে ওই গ্রামে আসার পর থেকে দেখে আসছি প্রথমে আমার শ্বশুড় বার্ষিক পলো বাওয়াতে অংশগ্রহণ করেছেন। এরপর আমার স্বামী আর আজ আমার ছেলে। আজকের পলো বাওয়া উৎসবে আমার ছেলে ২টি বোয়াল মাছ শিকার করেছে।’

৬ষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্রী রাবিয়া বেগম বলে, ‘ছোট জাল দিয়ে আমিও মাছ শিকার করেছি।’

প্রবীণ মুরব্বী আবদুল আহাদ বলেন, ‘শিশুকাল থেকে প্রতি বছর ওই বিলে পলো বাওয়া উৎসবে অংশগ্রহণ করে মাছ শিকার করে আসছি। আজও ২টি বোয়াল শিকার করেছি। ওর আনন্দই আলাদা।’

এছাড়া এবারের পলো বাওয়া উৎসবে তজম্মুল আলী ২টি বোয়াল ও ১টি কার্পু, জাহাঙ্গীর আলম কয়েছে ২টি বোয়াল ও ১টি শোল, মিজানুল করিম ৩টি বোয়াল ও ১টি গজার, তোফায়েল আহমদ ২টি বাউশ, সিরাজুল ইসলাম ১টি বোয়াল, আতাউর রহমান ১টি শোল, লিমন মিয়া ২টি রুই, মাহফুজুর রহমান সুজন ১টি বোয়াল ও ২টি কাতলা মাছ শিকার করেছেন।

সিলেটভিউ২৪ডটকম/১৪ জানুয়ারি ২০১৮/পিবিএ/আরআই-কে

@

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন