আজ শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ ইং

সিলেটে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের গ্রাম এখনো বিচ্ছিন্ন ‘দ্বীপ-দেশ’

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৮-০১-২৪ ০০:১৫:১৮

মঈন উদ্দিন, অতিথি প্রতিবেদক :: সিলেট সিটি কর্পোরেশনের সীমানা যেখানে শেষ হয়েছে, দূরত্বটা সেখান থেকে আধা কিলোমিটার। গ্রামের নাম ছিটা গোটাটিকর। সিটি কর্পোরেশনের ২৭ নং ওয়ার্ডের পড়শি গ্রাম। ছায়া সুনিবিড়, সবুজের গালিচা বিছানো। কান পাতলেই শোনা যায় রাখালিয়া সুর। শব্দের গাঁথুনিতে এর গায়ে জুড়ে দেওয়া যায় আদর্শ পাড়াগাঁয়ের উপমা। কিন্তু বাস্তবতা একেবারেই ভিন্ন। সাদামাটা। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বাড়িঘর দেখলেই বোঝা যায় এটা ঠিক নগর উপকণ্ঠের কোনো এলাকা নয়। ইট-পাথরের কয়েকটা দালানের পাশে বাকিগুলো বড্ড বেমানান। মাটির ঘর। সামান্য বৃষ্টিতেই ছনের চাল বেয়ে নামে পানির ফোয়ারা। এগুলোর চেহারায় কেবলই দীনতার প্রকাশ। কিন্তু অতি সাধারণ এই গ্রামটিই একাত্তরে কাঁপিয়ে দিয়েছিলো পুরো দেশ। মুক্তিযুদ্ধে রয়েছে গ্রামটির গৌরবগাঁথা ইতিহাস। দু’জন শহীদ যোদ্ধার রক্তস্রোত বইছে গ্রামবাসীর শিরায়। সম্মুখ রণাঙ্গণের আরো দু’জন সেনানী এখনো বুকে লালন করেন যুদ্ধদিনের স্মৃতি। সেই গ্রামটিই এখন অনাদর-অবহেলার প্রতিশব্দ হয়ে উঠেছে। স্বাধীনতার ৪৬ বছর পরও উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি গ্রামটিতে। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন এই গ্রাম এখন অনেকের চোখেই দূরের কোনো এক ‘দ্বীপ-দেশ’।

পিদিম-জ্বলা ঘর থেকে উঁকি দিলেই গ্রামবাসীর চোখের সামনে ভেসে উঠে পাশের আলো ঝলমলে নগরী। দীর্ঘশ্বাস বুকে চেপে রাখেন গ্রামের মানুষ। অপ্রাপ্তিকেই নিয়তি মেনেছেন তারা।‘দ্বীপ-দেশ’ ছিটা গোটাটিকরের মানুষের অভিযোগ, রাষ্ট্রীয় নানা সুযোগ-সুবিধা থেকে তাদের বঞ্চিত রাখা হয়েছে। যুগ যুগ ধরেই উপেক্ষার পাত্র। সাত-আটশ’ মানুষের বাস গ্রামটিতে। অভাবি মানুষের সংখ্যাই বেশি। এদের কেউ বেছে নিয়েছেন জেলে জীবন, কেউ দিন মজুর । জীবন-জীবিকার তাগিদে কেউ কেউ মাড়িয়েছেন দেশের গণ্ডিও। যতো কষ্ট হোক কারো কাছে হাত পাততে চান না তারা। অধিকার চান।

আয়ত্তের মধ্যে থাকলে সেই অধিকার আদায়ও করতে পারেন তারা। গত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে নিজেদের গ্রাম থেকে প্রার্থী দিয়েছিলেন সদস্য পদে। সবুজ কুমার বিশ্বাস তাদের ভোটে নির্বাচিত ইউপি সদস্য। এই জনপ্রতিনিধিই হয়ে উঠেছেন ছিটা গোটাটিকরের মানুষের কণ্ঠস্বর। তিনি জানালেন অসহায়ত্বের কথা। টগবগে যুবকের মৃত্যু দেখেছেন চোখের সামনে।। গত বছর হƒদরোগে আক্রান্ত হন স্থানীয় বাসিন্দা রবীন্দ্র বিশ্বাস। তার মৃত্যু ঘটে যথা সময়ে হাসপাতালে না নেওয়ার কারণে। কেউ রোগে পড়লেই মৃত্যু শংকা চেপে ধরে গ্রামবাসীকে। কিছুদিন আগে এলাকর পঞ্চাশোর্ধ হেমু রানী বিশ্বাস হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। জরুরি ভিত্তিতে তাকে হাসপাতালে নেওয়া প্রয়োজন। যোগাযোগ ব্যবস্থা না থাকার কারণে লোকজন কাঁধে তুলে নেন তাকে। পায়ে হেঁটে কিছুদূর নেওয়ার পর নৌকা। শেষমেশ বিকল্প পথে অটোরিক্সায় করে তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়।

গ্রামে ৭০ টি পরিবারের মধ্যে ৬০ টি-ই সনাতন ধর্মাবলম্বীদের। একসময় এলাকায় শিক্ষিত মানুষ খুঁজে পাওয়া যেতো না। অবস্থা পাল্টেছে। পিন্টু লাল বিশ্বাস গ্রামের প্রথম আলোকিত মানুষ। ১৫/১৬ বছর আগে ডিগ্রি পাশ করে পাড়ি জমান বিদেশে। থিতু হয়েছেন ফ্রান্সে। সাম্প্রতিক সময়ে ডিগ্রি পাশ করেছেন সঞ্চিতা রানী বিশ্বাস ও নীপা রানী বিশ্বাস। স্থানীয়দের মনে এরা আলো হয়েই জ্বলছেন। এই আলোকিত মানুষগুলোর দেখানো পথে হাঁটছেন এখন উত্তরসূরিরা। কলেজের গণ্ডিতে পা রেখেছেন অনেকে। এখন গ্রামটিতে দেড়শ’র মতো শিক্ষার্থী। এদের বড় একটা অংশ বিদ্যালয়েই যেতে পারেনা বর্ষা মৌসুমে। গ্রামটিতে রাস্তা বলতে কিছু নেই। ধানের ক্ষেতের আলের মতোই গ্রামটির ভেতরের রাস্তা। কাদা-জলে একাকার হয়ে পড়ে। শিশু শিক্ষার্থীদের অনেকে কাদার মধ্যেই হাবুডুবু খায়। সাম্প্রতিক বন্যা পুরোপুরি ধ্বংস করে দিয়েছে গ্রামের যোগাযোগ ব্যবস্থা। শিশু থেকে বৃদ্ধ-কেউই কোথাও যেতে পারেন না। ঘর কিংবা উঠোনই ভরসা। কোথাও যেতে হলে নৌকায় উঠতে হয় তাদের।

এমন গ্লানির জীবন আর বয়ে বেড়াতে চান না গ্রামের সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ নাগরিক কনাই রাম বিশ্বাস। ৮২ পেরিয়ে গেছে বয়স। স্থানীয়দের কাছে নমস্য পুরুষ। ‘কনাই সাধ’ু হিসেবেই যার পরিচিতি। একাত্তরে প্রাণে বেঁচে যাওয়াদের একজন। অন্তহীন ক্ষোভ নিয়েই বেঁচে আছেন। শুভ প্রতিদিনের কথা হয় তার সাথে। শুরুতেই একাত্তরের লোমহর্ষক ঘটনার বর্ণনা তার মুখে। বললেন, ছিটা গোটাটিকরজুড়েই আছে মুক্তিযুদ্ধের দুঃসহ স্মৃতি। রক্তগঙায় ভেসেছে তার গ্রাম। ওই সময় নিভৃত গ্রামটিতে পরিবার ছিলো মাত্র আঠারোটি । মানুষ ছিলেন শ’খানেকের মতো। ২৫ মার্চের কালো রাতেই আতঙ্ক চেপে ধরে গ্রামবাসিকে। একদিন দু’দিন করে সপ্তাহ কেটে গেলো। কাক ডাকা ভোর। পাক আর্মি ঘেরাও করে ফেলে পুরো গ্রাম। ঘরেই ছিলেন কনাই রাম বিশ্বাস। পালাতে চান। পিছু নেয় আর্মি। কোলে ছোট্ট শিশু। দৌঁড়ে আশ্রয় নেন পাশের বাড়িতে। একজন মহিলার কাছে শিশুটিকে রেখে আশ্রয় নেন মাচাংয়ে। সেখান থেকেই বীভৎসতা দেখেন সেদিনের।

পাক সেনারা সকল পুরুষ মানুষকে জড়ো করে গ্রামের বীরু রাম বিশ্বাসের উঠোনে। সারিবদ্ধভাবে দাঁড়াতে বলে সকলকে। সারির প্রথমেই ছিলেন বীরেন্দ্র রাম বিশ্বাস। গর্জে উঠে রাইফেল। গুলি লাগে বীরেন্দ্র বিশ্বাসের বুকে। লুটিয়ে পড়েন মাটিতে। বুক বেয়ে নামে রক্তের স্রোত। প্রাণ হারান বীরেন্দ্র বিশ্বাস। বীরেন্দ্র’র পরেই অবস্থান ছিলো নরেন্দ্র বিশ্বাসের। তাকেও গুলি করে পাক আর্মি। আহত হয়ে পড়ে যান মাটিতে। মৃত ভেবে তাকে ফেলে সেনারা পা বাড়ায় গ্রামের মেঠো পথে। আরেক বাড়িতে গিয়ে উঠে তারা। আতঙ্কিত লোকজন ওইখানেই আশ্রয় নিয়েছেন। হল্লাদ রামের বাড়িতে আশ্রয় নেওয়া লোকজন পাক আর্মি দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন। অনুনয়-বিনয় করেন পা ধরে। মন গলেনি সেনাদের। বুটের নিচেই পিষ্ট করে ১০-১৫ জন মানুষকে। দিগিন্দ্র রাম বিশ্বাসকে বলের মতোই লাথি মারতে থাকে তারা। গুরুতর আহত হন কুলেন্দ্র ও বিপীন রাম বিশ্বাস।  অমানুষিক নির্যাতনের পর আহতদের মাটিতেই ফেলে রাখে সেনারা। এরপর তারা হানা দেয় রুদ্ধ একটি ঘরে। বাঁশের তৈরি ঘরের দরোজার ওপাশে ছিলেন সুরেশ বিশ্বাস। বাইরে থেকেই গুলি করে হানাদাররা। নাড়ীভূড়ি ছিঁড়ে যায় সুরেশের। ওখানেই মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেন তিনি। ওইদিনের পুরো নৃশংসতার স্বাক্ষী কনাই রাম জানান, পাক আর্মিরা ধ্বংসযজ্ঞ শেষে চলে যাবার সময় ব্যাপক লুটপাট চালায়। আর পাক আর্মির এমন নির্মমতা গভীর রেখাপাত করে টগবগে যুবক শংকর রাম ও হরমন রাম বিশ্বাসের মনে। প্রতিশোধ নিতেই তারা ঝাঁপিয়ে পড়েন মুক্তিযুদ্ধে। রাইফেল হাতে একের পর এক মিশন। স্বাধীনতার লাল সূর্য উদয়ের দিনে অশ্র“ ঝরেছে শংকর-হরমনের চোখে। অন্ততঃ প্রতিশোধটাতো নেওয়া হয়েছে। ভাতা পান শংকর-হরমন। তাদের ঘরে অভাব অতোটা নেই। কিন্তু গ্রামের রাস্তাঘাটের দিকে তাকালে তাদের অন্তরটা কেঁদে উঠে। সিটি কর্পোরেশনের শেষ সীমানা থেকে মাত্র এক কিলোমিটার রাস্তা। গ্রামে যাওয়ার মূল রাস্তাই এটি। কেউ নজর দেয় না। এলাকাবাসী ছাড়া আর কেউ উদ্যোগীও হয়না। মাঝেমধ্যে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে বরাদ্দ এলে মাটির প্রলেপ দেওয়া হয়। একে-বেঁকে চলা রাস্তার সেই প্রলেপ উঠে যায় বৈশাখী বৃষ্টিতেই। আষাঢ়-শ্রাবণ এলে কোন্টা হাওর আর কোন্টা রাস্তা-চেনার উপায় থাকেনা। বর্ষায় নৌকাই হয় তাদের ভরসা। যাদের নৌকা নেই তাদের কষ্টের সীমা থাকেনা।
এলাকার লোকজন বলছেন, একাত্তরের পর থেকে সব নির্বাচনে নিজেদের সেন্টারে আওয়ামী লীগকে পাশ করাতে বড় ভূমিকা রেখেছেন ছিটা গোটাটিকরের ভোটাররা। বর্তমানে ক্ষমতায় আছে দলটি। এরপরও কাজের কাজ কিছুই হচ্ছেনা। উপেক্ষিত তারা।

কুচাই ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক সদস্য আবদুস শহীদ বলেন, কেউই যেনো এই গ্রাম নিয়ে মাথা ঘামাতে চায় না। উচ্চ পর্যায় থেকে কিছু করা না গেলে মুক্তিযোদ্ধাদের রক্তমাখা গ্রামটিতে উন্নয়নের পরশ লাগবেনা। এলাকায় ‘ডাক্তারবাবু’ হিসেবে পরিচিত কৃষ্ণমণি বিশ্বাস বললেন, এতো অবহেলা। মানুষ হিসেবে ন্যূনতম মর্যাদাটা প্রত্যাশা করে এলাকাবাসী। বর্তমান ইউপি সদস্য সবুজ কুমার বিশ্বাসের কষ্টটা একটু বেশেই। নিজের গ্রামের জন্য কিছুই করতে পারছেন না। স্থানীয় প্রশাসন থেকে পাওয়া যৎসামান্য সাহায্য দিয়ে কোনো উপকারই করতে পারছেন না ভাগ্যবিড়ম্বিত মানুষের জন্য।

সবুজ বিশ্বাস জানান, ২০১২ সালে সিলেট-৩ আসনের সংসদ সদস্য মাহমুদ উস সামাদ চৌধুরী কয়েস তাদের এলাকা সফর করেন। শুষ্ক মৌসুম ছিলো, কাদা-জল মাড়াতে হয়নি । আশ্বাস দিয়ে গিয়েছিলেন রাস্তাটি পাকা করে দেবেন। আজো সেই আশ্বাস পূর্ণতা পায়নি। এরপর সংসদ সদস্য আমাতুল কিবরিয়া কেয়া চৌধুরীও ২০১৫ সালে সফর করেন ওই গ্রাম। আশ্বাস আছে তারও। দক্ষিণ সুরমা উপজেলা চেয়ারম্যান আবু জাহিদের কাছ থেকেও আশ্বাস ছাড়া কিছু পাননি-অভিমানই ঝরলো সবুজের কণ্ঠে।

আর সবুজ বিশ্বাসের কণ্ঠই এখন পুরো ছিটা গোটাটিকরের কণ্ঠ। বীরেন্দ্র-সুরেশ বিশ্বাসের আÍাহুতি কিংবা শংকর-হরমন বিশ্বাসের জীবনবাজি রেখে যুদ্ধজয়, সবই ম্লান হয়ে হয়ে যাচ্ছে একটি রাস্তার দাবির কাছে। ‘কনাই সাধুর’ কণ্ঠেও আকুতি-জীবনের পড়ন্ত বেলায় এসে একটি পাকা রাস্তার জন্য দাবি জানাতে হবে সেটা কল্পনায়ও আসেনি। পূর্বপুরুষরাও চলে গেছেন বঞ্চনার স্বাক্ষী হয়ে। ‘মাত্র একটি রাস্তা দিয়ে দিলে কী বাংলাদেশের খুব ক্ষতি হয়ে যাবে?’
সৌজন্যে: শুভ প্রতিদিন

সিলেটভিউ২৪ডটকম/ ২৪ জানুয়ারি ২০১৮ / এমইউ/ এমইউএ

@

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন