আজ শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ইং

বিশ্বমঞ্চে সিলেটের শীতলপাটি!

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৮-০২-১৪ ০০:০৩:৩৪

নিজস্ব প্রতিবেদক :: ইতিহাস বলছে, অর্জনের গল্পটা পুরনো। ১৯০৬ সালে কলকাতায় কৃষি প্রদর্শনীতে ৯০ টাকা মূল্যের একটি শীতলপাটি প্রদর্শন করে স্বর্ণপদক পেয়েছিলেন যদুরাম দাস নামের এক বুননকর্মী। ১৯৯০ সালে ইতালির রোমে অনুষ্ঠিত হস্তশিল্প প্রদর্শনীতে সিলেট বিভাগের প্রতিনিধি হিসেবে মৌলভীবাজারের রাজনগর উপজেলার শীতলপাটি শিল্পী মনিন্দ্র নাথকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। শীতলপাটি নিয়ে এই অর্জনের গল্প আরো আছে। তবে সব অর্জনকে পেছনে ফেলে দিয়েছে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কোর স্বীকৃতি। সারা বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ নির্বস্তুক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় সিলেটের শীতলপাটিকে অন্তর্ভূক্ত করার ঘোষণা গেল ৬ ডিসেম্বর দেয় ইউনেস্কো। শীতলপাটিতে মুগ্ধ হয়ে বিশ্ব যেন বিজয়ের মাসে বাংলাদেশের কপালে আরেক বিজয়তিলক পরিয়ে দেয়।

গ্রীষ্মকালে তপ্ত খররোদে শীতলপাটি শরীরে অদ্ভূত এক শীতল পরশ বুলিয়ে দেয়। এই শীতল পরশের এর নাম শীতলপাটি হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। ঐতিহ্যবাহী শীতলপাটি শিল্পের আদিস্থান সিলেটের বালাগঞ্জ ও বিয়ানীবাজার উপজেলায়। এছাড়াও সিলেটের কোম্পানিগঞ্জ ও গোয়াইনঘাট উপজেলা, হবিগঞ্জের চুনারুঘাট, মৌলভীবাজারের বড়লেখা ও রাজনগর এবং সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর ও জামালগঞ্জ উপজেলায় শীতলপাটি শিল্পের বিস্তৃতি রয়েছে।

সিলেটের কয়েকজন শীতলপাটি শিল্পীর সাথে কথা বলে জানা গেছে, মুরতা নামক একধরনের ঝোপজাতীয় গাছের বেত দিয়ে বুনা হয় শীতলপাটি। ছয় থেকে দশ ফুট পর্যন্ত লম্বা হয় মুরতা গাছ। এ গাছের ছাল (বেত) তুলে সেটি দিয়ে তৈরী হয় শীতলপাটি। ওই ছাল রোদে কিছুটা শুকিয়ে বুনা হয় পাটি। আবার মুরতা গাছের ছালকে বিভিন্ন রঙে রাঙিয়ে নান্দনিক শীতলপাটিও বুনা হয়। বর্তমানে নকশা আঁকা শীতলপাটিই বেশি চলে। নানা রঙের বেত দিয়ে পাটিতে ফুটিয়ে তোলা হয় নানাধরনের লোককাহিনী; আঁকা হয় তাজমহ, হাতি, ফুল, পাখি প্রভৃতিও।

সিলেটের বালাগঞ্জ উপজেলার পশ্চিম গৌরিপুর ইউনিয়নের খাইস্তঘাট গ্রামের শীতলপাটি বুননশিল্পী মনাফ আলী বলেন, ‘চার বাই পাঁচ হাত মাপের একটি শীতলপাটি বুনতে লাগে প্রায় দেড়শ’টি মুরতা গাছ। একেকটি পাটি বুনা সময়সাপেক্ষ। প্রথমে মুরতা গাছ কেটে এনে সেগুলোর ছাল ওঠাতে হয়। এরপর একটু রোদে শুকিয়ে রঙ করা, পরে আবার রোদে শুকানো এরপর পাটি তৈরীর কাজ শুরু করতে হয়।’

একই উপজেলার তেঘরিয়া গ্রামের খবির উদ্দিন বলেন, ‘শীতলপাটি বিক্রি করে লাভের পরিমাণ কম। মাঝারি আকারের একেকটি পাটি তৈরীতে ছয় থেকে সাতশ টাকা পর্যন্ত খরচ হয়। এর সাথে সময় ও শ্রম তো আছেন। এ আকারের পাটি আট-নয়শ টাকায় বিক্রি হয়।’ তিনি আরো বলেন, ‘বর্তমান সময়ে মুরতা গাছের চাষ কমে যাওয়ায় এবং প্লাস্টিকের মাদুর সহজলভ্য হওয়ায় শীতলপাটি বুনা ও বিক্রি দুটোই কমেছে। শীতলপাটি ইউনেস্কোর স্বীকৃতি পাওয়ায় আমরা নতুন করে আশান্বিত হচ্ছি। আমরা চাই, সরকার শীতলপাটির দিকে দৃষ্টি দিক।’

সিলেট চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সাবেক সভাপতি সালাহউদ্দিন আলী আহমদ সিলেটভিউকে বলেন, ‘শীতলপাটি শিল্প বর্তমানে ধুঁকছে বললেই চলে। ইউনেস্কোর স্বীকৃতি এ শিল্প এবং শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্টরা উজ্জীবিত হবেন। তবে এজন্য প্রয়োজন সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা।’

শীতলপাটি ইউনেস্কোর স্বীকৃতি পাওয়ায় সম্প্রতি সিলেটের বালাগঞ্জ উপজেলায় আনন্দ উৎসব করেছে প্রশাসন। ওই উৎসবে সিলেটের জেলা প্রশাসক রাহাত আনোয়ার বলেন, ‘শীতলপাটির আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আমাদের গৌরবান্বিত করেছে। এ সম্মান শুধু সিলেটবাসীর নয়, গোটা দেশের। শীতলপাটির এ অগ্রযাত্রা ধরে রাখতে হবে। শীতলপাটির সাথে জড়িত শ্রমজীবীদের সঠিক মূল্যায়ন, পাটি তৈরীর কাঁচামালের উৎপাদন বৃদ্ধিতে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। এ কাজে সরকারের পাশাপাশি স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও সামাজিক নেতৃবৃন্দকে এগিয়ে আসতে হবে।’

জেলা প্রশাসক রাহাত আনোয়ার জানিয়েছেন, সরকারি উদ্যোগে নতুন নতুন বেত বাগান সৃজন ও এই শিল্পে উদ্যোক্তাদের নানাভাবে প্রণোদনা দেয়া হবে।

যেভাবে বিশ্বমঞ্চে: শীতলপাটিকে বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভূক্ত করার প্রক্রিয়া শুরু হয় ২০১৬ সালে। ওই বছরের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের পক্ষে জাতীয় জাদুঘর শীতলপাটিকে তালিকাভুক্ত করতে ইউনেস্কোর কাছে প্রস্তাবনা পাঠায়। সাথে পাঠানো হয় শীতলপাটির বুনন প্রক্রিয়াও। ২০১৭ সালের ২৭ অক্টোবর ইউনেস্কোর সংশ্লিষ্ট মূল্যায়ন কমিটি বাংলাদেশের প্রস্তাবটিকে গ্রহণযোগ্য বলে অভিমত দেয়। এরপর ছিল শুধু আনুষ্ঠানিক ঘোষণার অপেক্ষা। সেই অপেক্ষা ফুরায় গেল ৬ ডিসেম্বর। দক্ষিণ কোরিয়ার জেজু দ্বীপে ৪ থেকে ৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয় ইউনেস্কোর আন্তসরকার কমিটির (ইন্টারগভর্নমেন্টাল কমিটি ফর দ্য সেফগার্ডিং অব দ্য ইনটেনজিবল কালচারাল হেরিটেজ) ১২তম অধিবেশন। ওই অধিবেশনে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের সচিব মোহাম্মদ শওকত নবীর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল ওই সম্মেলনে অংশ নেয়। প্রতিনিধি দলে সিলেটের বালাগঞ্জের শীতলপাটির কারিগর গীতেশচন্দ্র ও হরেন্দ্রকুমার দাশও ছিলেন। ৬ ডিসেম্বর ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষণা দেয় শীতলপাটিকে। ঘোষণার পরই মঞ্চে একটি শীতলপাটি প্রদর্শন করে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দল।

সিলেটভিউ২৪ডটকম/১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮/আরআই-কে

@

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন