আজ শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ইং

এমপি কয়েস ‘বেয়াদব’, আ.লীগের সাথে আছেন ‘স্বার্থের কারণে’

দক্ষিণ সুরমা উপজেলা আ.লীগের সংবাদ সম্মেলন

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৮-০২-১৪ ১৭:১৫:৪৫

সিলেট :: সিলেট-৩ আসনের সংসদ সদস্য মাহমুদ-উস-সামাদ চৌধুরী কয়েসকে ‘বেয়াদব, প্রতিহিংসাপরায়ণ, আভিজাত্যের অহমিকায় অন্ধ, পরশ্রীকাতর’ উল্লেখ করে দক্ষিণ সুরমা উপজেলা আওয়ামী লীগের ব্যানারে সংবাদ সম্মেলন করা হয়েছে। বুধবার বেলা ২টায় সিলেট নগরীর একটি হোটেলে এ সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ‘স্বার্থের কারণে এমপি কয়েস আওয়ামী লীগের সাথে রয়েছেন’ বলেও সংবাদ সম্মেলনে উল্লেখ করা হয়। সংবাদ সম্মেলনে দক্ষিণ সুরমা উপজেলার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রইছ আলীর লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন যুগ্ম সম্পাদক সাহেদ হোসেন।

সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ‘‘আমরা উপজেলা আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গ। এখানে উপস্থিত প্রায় প্রত্যেকেই দীর্ঘ সময় ধরে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত। অনেকেরই স্বাধীনতাপূর্ব থেকে এই দলের প্রতি অনেক শ্রম ও ত্যাগ রয়েছে। আমাদের দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক ত্যাগ ও অবদানকে দলে ‘উড়ে এসে জুড়ে বসা’ একটি চক্র স্বীকার না করে ত্যাগী নেতাকর্মীদের দূরে ঠেলে দিয়ে স্বার্থান্বেষী পদলেহীচক্রকে নিজের চারপাশে নিয়ে আত্মপ্রচারে মত্ত। আমরা সিলেট-৩ আসনের এমপি মাহমুদ-উস-সামাদ চৌধুরী কয়েসকে উদ্দেশ্য করে এসব কথা বলছি। অত্যন্ত বেয়াদব, প্রতিহিংসাপরায়ণ, আভিজাত্যের অহমিকায় অন্ধ, পরশ্রীকাতর এমপি কয়েসের দলীয় আনুগত্য নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। তাঁর বাবা দেলওয়ার হোসেন ফিরু মিয়া মুক্তিযুদ্ধের সময় ছিলেন শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান, একজন চিহ্নিত রাজাকার। রাজাকার ফিরু মিয়ার প্রতিহিংসার শিকার হয়ে ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার অনেক মানুষ পাকবাহিনীর হাতে নির্যাতিত হয়েছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। চিহ্নিত পাকিস্তানী দালালের ছেলে হয়ে মাহমুদ-উস-সামাদ এখন লেবাস পাল্টে বঙ্গবন্ধুর আদর্শে আওয়ামী লীগার হওয়ার অপচেষ্টায় লিপ্ত। কিন্তু কথায় আছে ‘ময়ুরের পালক নিজের শরীরে ধারণ করলেই কাক ময়ুর হয়ে যায় না।’ এমপির পরিবারের কেউ আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে সংশ্লিষ্ট নয়। স্বার্থের কারণেই মাহমুদ-উস-সামাদ আমাদের দলের সাথে রয়েছেন। এমপির ছোট ভাই আহমদ-উস-সামাদ চৌধুরী ওয়েছ লন্ডনে ‘চ্যানেল এস’ নামে টেলিভিশন চ্যানেলের মালিক। এই চ্যানেল বিএনপি-জামায়াত-শিবিরসহ প্রতিক্রিয়াশীল চক্রকে প্রতিষ্ঠিত করতে কাজ করে যাচ্ছে।’’

এমপি কয়েস ‘ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার অসৎ উদ্দেশ্যে উপজেলা আওয়ামী লীগকে সাংগঠনিকভাবে তছনছ করে দিচ্ছেন’ মন্তব্য করে সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ‘কয়েক বছর ধরেই তিনি এ অপচেষ্টা চালিয়ে আসছেন। গত ৩০ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর সিলেট সফর উপলক্ষে দক্ষিণ সুরমা উপজেলা আওয়ামী লীগ ২৭ জানুয়ারি চন্ডিপুলস্থ একটি সেন্টারে বর্ধিত সভার আয়োজন করে। সিদ্ধান্ত হয়েছিল, বর্ধিত সভার ব্যানারে দলের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেনকে প্রধান অতিথি, সাংগঠনিক সম্পাদক মিসবাহ উদ্দিন সিরাজকে প্রধান বক্তা এবং মহানগর আওয়ামী লীগ সভাপতি বদর উদ্দিন কামরান, জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি লুৎফুর রহমান, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শফিকুর রহমান চৌধুরী, মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আসাদ উদ্দিন আহমদ ও এমপি মাহমুদ-উস-সামাদ চৌধুরীর নাম বিশেষ অতিথি হিসেবে উল্লেখ থাকবে। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে মাহমুদ-উস-সামাদ চাটুকারদের সহযোগিতায় নিজেকে প্রধান অতিথি উল্লেখ করে বর্ধিত সভার মঞ্চে জোরপূর্বক একটি ব্যানার টানান। তাঁর অপতৎপরতায় সভায় উপস্থিত নেতাকর্মীরা প্রতিবাদমুখর হলে এমপির পোষ্য গুন্ডারা জামায়াত-শিবির ও বিএনপির চিহ্নিত সশস্ত্র ক্যাডারদের দলের নিরীহ নেতাকর্মীদের উপর লেলিয়ে দেয়। ১৬ মামলার পলাতক আসামী শিবির ক্যাডার সোহেল রানা, ছাত্রদলের চিহ্নিত ক্যাডার আব্বাস, মঞ্জু, কুটন, বাবুল ও রুহুলসহ বেশ কয়েকজন সন্ত্রাসী প্রকাশ্যে অস্ত্র উঁচিয়ে দলীয় নেতাকর্মীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এমপির পোষ্য ও ভাড়াটে গুন্ডাবাহিনীর হামলায় আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ নেতাদের গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। এমপির নির্দেশে দক্ষিণ সুরমা থানা পুলিশ ৭৬ রাউন্ড গুলি ছুঁড়ে। সন্ত্রাসী হামলা ও গুলিবর্ষণের ফলে দলের ৩০ নেতাকর্মী আহত হয়।’

ওই ঘটনায় সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে দোষীদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিতে জেলা আওয়ামী লীগের প্রতি আহবান জানানো হয় সংবাদ সম্মেলনে।

সংবাদ সম্মেলনে এমপি কয়েসের ‘কুকীর্তি’ তুলে ধরে বলা হয়, ‘২০১৪ সালে উপজেলা নির্বাচনে দল মনোনীত প্রার্থী মোহাম্মদ আবু জাহিদকে মেনে নিতে না পেরে এমপি কয়েস বিরোধিতা করেন। আওয়ামী লীগ প্রার্থীর বিজয় ঠেকাতে চাটুকার, মোসাহেবদের মাঠে নামান তিনি। তাঁর এই বিরোধিতার তথ্য প্রধানমন্ত্রীর অফিসে যায়। প্রধানমন্ত্রীর অফিস থেকে এমপিকে দলের প্রার্থীর বিরুদ্ধাচরণ না করতে নির্দেশ দেয়া হয়। কিন্তু নির্দেশ উপেক্ষা করে ভোটের দিন পর্যন্ত এমপি দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধাচরণ এবং জামায়াতের প্রার্থীর প্রতীকে ভোট দিতে ভোটারদের উৎসাহ দেন। আবু জাহিদের বিজয় ঠেকাতে না পেরে তিনি যাতে উন্নয়ন কর্মকান্ড পরিচালিত করতে না পারেন, সে লক্ষ্যে ষড়যন্ত্র শুরু করেন এমপি কয়েস। উপজেলা প্রশাসনকে ব্যবহার করে তিনি উপজেলা চেয়ারম্যানের কোটার উন্নয়ন কার্যক্রম বাধাগ্রস্থ করে রেখেছেন। ফলে গত ৪ বছর ধরে দক্ষিণ সুরমায় উন্নয়ন হচ্ছে না। উপজেলার রাস্তাঘাটের অবস্থা খুবই করুণ, বিদ্যালয়ে আসবাবপত্র সংকট বিরাজ করছে, পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নতি হয়নি। দক্ষিণ সুরমার প্রতি এমপির বিমাতাসুলভ আচরণের ফলেই এ দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।’

এমপি কয়েসকে ‘নানা দুষ্কর্মের হোতা’ উল্লেখ করে বলা হয়, ‘২০১৬ সালে ইউপি নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীদের বিরুদ্ধে ন্যক্কারজনক ভূমিকা রাখেন এমপি। প্রতিটি ইউনিয়নে তৃণমূল নেতাদের বাছাই করার ফলে এমপির নিজের লোকেরা প্রার্থী হতে পারেনি। এতে প্রতিহিংসাপরায়ণ এমপি দলীয় প্রতীকের বিরোধিতা করে অন্য দলের প্রার্থীদের সমর্থন করেন। দলীয় প্রার্থীদের বিরুদ্ধে এমপির বিরোধীতার কারণে দক্ষিণ সুরমায় ৭টি ইউনিয়নের ৫টিতেই নৌকার প্রার্থী পরাজিত হন।’

এক শিক্ষককে এমপি কয়েস ‘চপেটাঘাত করেন’ উল্লেখ করে সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ‘এর ফলে গোটা শিক্ষকসমাজ অপমানিত বোধ করেছেন এবং শিক্ষকরা আওয়ামী লীগের প্রতি অসন্তুষ্ট।’ বিএনপির ‘বিতর্কিত নেতা’ ইলিয়াস আলীকে নিয়ে এমপি কয়েস ‘সাফাই গেয়েছেন’ উল্লেখ করে সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ‘এতেই আঁচ করা যায়, এমপি নিজের দলের প্রতি কতটা আন্তরিক বা অনুগত।’

সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে আরো উল্লেখ করা হয়, ‘কিছুদিন আগে এমপি কয়েস ফেঞ্চুগঞ্জে শাহজালাল সারকারখানা ধ্বংস করে দেয়ার কথা বলেন। কতো বড় কুলাঙ্গার হলে নিজ দেশের এতো বড় একটি প্রতিষ্ঠান ধ্বংসের কথা মুখে আনতে পারেন? এমপির হিংসার কারণে শাহজালাল সারকারখানায় দক্ষিণ সুরমার কোন লোককে চাকুরি দেয়া হয়নি।’

এমপি কয়েসের ‘লোকজন সিলেট-৩ আসনের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করছে’ অভিযোগ করে বলা হয়, ‘থানা পুলিশের দালালী করছে এমপির চাটুকাররা। এমপি ও তার মোসাহেবরা দুর্নীতির মাধ্যমে দক্ষিণ সুরমা তথা সিলেট-৩ আসনভুক্ত এলাকাকে নিজেদের করদরাজ্যে পরিণত করেছে। সম্প্রতি একটি পথসভায় আমাদের দলীয় এক নেতাকে প্রকাশ্যে কান ধরিয়ে ওঠবস করিয়েছেন এমপি।’

সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করে বলা হয়, ‘২০০৪ সালে দক্ষিণ সুরমা উপজেলা কমিটি গঠন করা হয়েছিল। প্রায় ১৪ বছর গত হতে চলেছে, অথচ উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনের কোন খবর নেই। নিজের চামচাদের সুবিধাজনক পদে রাখা যাবে না দেখে টালাবাহানা করে এমপি উপজেলা সম্মেলন পিছিয়ে রাখছেন। এর ফলে দলের নেতাকর্মীরা আগ্রহ হারিয়ে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ছে। দক্ষিণ সুরমার ১০টি ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের সম্মেলন সম্পন্ন হলেও একটিতেও পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করা হয়নি। সাংগঠনিক কার্যক্রম বৃদ্ধির পরিবর্তে গত ৯ বছরে এমপি দলীয় নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমুলক মামলা দিয়ে নির্যাতন করছেন।’

সংবাদ সম্মেলনে এমপি মাহমুদ-উস-সামাদকে ‘উড়ে এসে জুড়ে বসা’, ‘রাজনৈতিকভাবে অপরিপক্ষ’, ‘দলের নীতি ও আদর্শের প্রতি উদাসীন’ এবং ‘দায়িত্বহীন’ ব্যক্তি বলেও উল্লেখ করা হয়। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সিলেট-৩ আসনে দলীয় প্রার্থী মনোনয়নে এলাকার সচেতন ভোটারদের ‘চাওয়া-পাওয়াকে মূল্যায়ন করে দলীয় নেতাকর্মীদের সাথে রাজনৈতিকভাবে সম্পৃক্ত সুযোগ্য ব্যক্তিকে’ মনোনয়ন প্রদানের জন্য আওয়ামী লীগের হাইকমান্ডের প্রতি আহবান জানানো হয় সংবাদ সম্মেলনে।

সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন দক্ষিণ সুরমা উপজেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতিআব্দুস সালাম, সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুল মতিন, মাসুক উদ্দিন, প্রচার সম্পাদক আব্দুর রব, বন ও পরিবেশ সম্পাদক মো. বশির, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক আব্দুল আহাদ, কার্যকরি সদস্য জামাল উদ্দিন, আনছার আলী, ইউপি চেয়ারম্যান ফখরুল ইসলাম শায়েস্তা, তপন চন্দ্র পাল, রফিকুল ইসলাম, বোরহান উদ্দিন, জেলা পরিষদ সদস্য মতিউর রহমান, নুরুল ইসলাম প্রমুখ।

এদিকে, সংবাদ সম্মেলনে ওঠা অভিযোগ অস্বীকার করেছেন সাংসদ মাহমুদ-উস-সামাদ চৌধুরী কয়েস। 

সিলেটভিউ২৪ডটকম/১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮/সিজেপ্রে/আরআই-কে

@

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন