Sylhet View 24 PRINT

সংসদে অাসনসহ সিলেটের অাদিবাসীদের ৯ দফা

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৮-০৮-১০ ০০:১২:১৮

মিসবাহ উদ্দীন অাহমদ :: পার্বত্য চট্টগ্রামের পরেই দেশে অাদিবাসীদের বড় অংশের বসবাস সিলেট অঞ্চলে। বিভাগীয় জেলা সিলেটসহ হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজারের বিভিন্ন এলাকায় অাছেন বিভিন্ন সম্প্রদায়ের অাদিবাসী। চা বাগানের সুবাদে সমতল অঞ্চলের অাদিবাসীদের সংখ্যায় দেশে সবার চেয়ে এগিয়ে সিলেট। শুধুমাত্র অাদিবাসী চা শ্রমিক জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ৫ লাখ। অার অন্যান্য সব অাদিবাসীসহ সিলেট বিভাগে প্রায় ৮ লাখের কাছাকাছি অাদিবাসী রয়েছেন।

নানাকারণে, সমস্যা সমস্যায় তাদের জীবনকে ঘিরে রেখেছে এক কষ্টের নিয়তি। যুগের পর যুগের তাদের কপালে শুধুমাত্র বঞ্চনাই জুটছে। অত্যাচার, নির্যাতন, ভূমিখেকোদের থাবাসহ নানামুখী যন্ত্রণায় অতীষ্ট অাদিবাসীরা। দেশের অন্যান্য অঞ্চলের অাদিবাসীদের মতো সিলেটের অাদিবাসীরা চান নিজেদের জীবনের যাত্রা অারোও একটু গতিময় হয়ে উঠুক। নিজেদের দাবি-দাওয়া অাদায়ে তারা অাগের মতো পিছিয়ে নেই। জড়তার সব শৃঙ্খল ভেঙ্গে দিয়ে, শত অভাব অনটনের মাঝেও অাদিবাসীরা স্বপ্ন বুঁনছেন উন্নত জীবনের। সবুজ বেস্টনে গড়া চা-বাগানের কষ্টের জীবন ছুড়ে ফেলে অনেকে বেছে নিয়েছেন নতুন ঠিকানা। বদলে নিয়েছেন নিজের পেশা। মিশে যাচ্ছেন দেশের মূলস্রোতের সাথে।
সিলেটের প্রায় ৮ লক্ষাধিক অাদিবাসীর জীবনমান উন্নয়নে এবং তাঁদের দাবি-দাওয়া অাদায়ের লক্ষ্যে কাজ করছে এথনিক কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (একডো)। এই সংস্থাটির মাধ্যমেই অান্তর্জাতিক অাদিবাসী দিবসের এক অনুষ্ঠানে সিলেটের অাদিবাসীদের নয় দফা দাবি সরকারের কাছে তুলে ধরা হলো।
নয় দফা দাবিসমূহের মধ্যে প্রধান দাবি হচ্ছে পৃথক মন্ত্রণালয় গঠন। সিলেটের অাদিবাসীদের মতে, সরকার শুধু পাহাড়ে বসবাসরত অাদিবাসীদের খেয়াল রাখে। কিন্তু সমতলে বসবাসরত অাদিবাসীরাও যে সমস্যার পাহাড়ে অাছে সেটিতে কোন সরকারেরই দৃষ্টি পড়ে না। বিষয়টি গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে অালাদা মন্ত্রণালয় গঠনের দাবি করেছেন তারা। যেটি সমতলে বসবাসরত অাদিবাসী জনগোষ্ঠীর জন্য কাজ করবে। বর্তমানে অাদিবাসীদের জন্য যে মন্ত্রণালয় অাছে সেটি শুধুমাত্র পাহাড়ে বসবাসরতদের সমস্যা সমাধান নিয়ে কাজ করে। অবহেলিত থেকে যাচ্ছেন সমতল জনপদের অাদিবাসীরা।

দ্বিতীয় দফাতে এসে সিলেটসহ দেশের সমতল অঞ্চলে বসবাসরত অাদিবাসীদের জন্য প্রধানমন্ত্রীর তহবিল থেকে বরাদ্দ বাড়ানোর দাবি জানানো হয়েছে। বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর তহবিলে অাদিবাসীদের জন্য যে বরাদ্দ দেয়া হয়ে থাকে তার সিংহভাগ চলে যায় পার্বত্য চট্টগ্রামের অাদিবাসীদের সেবায়। বঞ্চিত হচ্ছেন সমতলের অাদিবাসীরা। তাই সর্বস্তরের অাদিবাসীদের জন্য সমান বরাদ্দের দাবি ওঠেছে।

এছাড়া অন্যান্য দাবিসমূহের মধ্যে সিলেটের অাদিবাসীরা প্রত্যাশা করেন- জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ এর অালোকে দেশের সকল অাদিবাসী জনগোষ্ঠীর নিজস্ব মাতৃভাষায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রম প্রকাশনা এবং পাঠদান চালু করতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় উদ্যোগী হবে।

পাশাপাশি সিলেট শহরে অাদিবাসী বিষয়ক একটি পৃথক ইনস্টিটিউট গড়ে তোলার দাবিও তাদের। এই ইনস্টিটিউটের মাধ্যমে অাদিবাসীদের নিয়ে বড় পরিসরে কাজ ও গবেষণা চালানো সম্ভব হবে। অাদিবাসীদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য রক্ষার ক্ষেত্রেও এটি সহায়ক হতে পারে।

এছাড়া অন্যান্য দাবির মধ্যে অাছে একটি সহজ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অাদিবাসীদের ভূমি সংক্রান্ত সকল বিরোধ নিষ্পত্তি করা। অার্থিক সংকট নিরসনের মাধ্যমে অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনের জন্য অাদিবাসী তরুণ-তরুণীদের নিয়ে বিভিন্ন অায়বর্ধক প্রকল্প গ্রহণ ও বাসস্তবায়ন করা। অাইন ও অধিকার রক্ষায় অাদিবাসীদের জন্য ‘অাদিবাসী সুরক্ষা অাইন প্রণয়ন’ করা। চা শ্রমিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নের জন্য একটি বিশেষ তহবিল গঠন করা।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দাবিটি হচ্ছে মহান জাতীয় সংসদে বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের অাদিবাসী জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার জন্য একটি সংরক্ষিত অাসন চালু করা।

এথনিক কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (একডো) এর নির্বাহী পরিচালক লক্ষ্মীকান্ত সিংহ এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেছেন, সিলেটের অাদিবাসীরা যুগ যুগ ধরে নানা বঞ্চনার মধ্যে দিনযাপন করছেন। এটি থেকে উত্তরণে অামরা উপরোক্ত দাবিসমূহের বাসস্তবায়ন চাই।

সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) সিলেটের সভাপতি জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক অাজিজ অাহমদ সেলিম অাদিবাসীদের অধিকার বাসস্তবায়নে সরকারের সুদৃষ্টি কামনা করে বলেন- বাংলাদেশের সংবিধান দেশের প্রতিটি নাগরিককে সমান মর্যাদা দিয়েছে। অাদিবাসীরাও এ দেশের নাগরিক। কিন্তু তারা অবহেলিত। তাদের নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব।

‘অাদিবাসী জাতিসমূহের দেশান্তর: প্রতিরোধের সংগ্রাম’ শীর্ষক অালোচনা সভা বৃহস্পতিবার সিলেট নগরীতে অনুষ্ঠিত হয়।

সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) সদস্য এমাদ উল্লাহ শহিদুল ইসলামের সঞ্চালনায় ও সনাক সভাপতি অাজিজ অাহমদ সেলিমের সভাপতিত্বে সনাক কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত সভায় এ নয় দফা দাবির কথা জানানো হয়।

প্রসঙ্গত, ১৯৯৪ সাল থেকে ৯ অাগস্টকে অান্তর্জাতিক অাদিবাসী দিবস হিসেবে পালন করছে জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রসমূহ। বিশ্বের ৯০টি দেশে প্রায় ৪০ কোটিরও অধিক অাদিবাসী জনগণের মতো বাংলাদেশে বসবাসরত প্রায় ৩০ লক্ষাধিক জনগণ দিবসটি উদযাপন করে থাকে।

জাতিসংঘ কর্তৃক ঘোষিত এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘অাদিবাসী জাতিসমূহের দেশান্তর: প্রতিরোধের সংগ্রাম’। প্রতিপাদ্যটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। কেননা বাংলাদেশেও অাদিবাসী জনগোষ্ঠীর ইতিহাস নিজ ভূমি থেকে উচ্ছেদের ইতিহাস, জোরপূর্বক দেশান্তরের ইতিহাস।

এ অঞ্চলে ১৯৪৭ সালের পর বারবার অাদিবাসী জনগোষ্ঠীকে জোরপূর্বক দেশান্তরী হতে হয়েছে। সিলেট অঞ্চল, বৃহত্তর ময়মনসিংহ ও উত্তরবঙ্গ ইত্যাদি অঞ্চলসমূহের অাদিবাসী জনগণ দেশান্তরী হয়েছেন।

সিলেটে একসময় পাত্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় লক্ষাধিক হলেও বর্তমানে এ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা মাত্র ৩ হাজারের কোঠায় গিয়ে ঠেকেছে। এই বিশাল সংখ্যার বেশিরভাগই দেশান্তরী হয়েছেন বা অন্যত্র চলে গেছেন। এই ধারা চলমান থাকলে অাগামীতে বিশেষ করে পাত্র অাদিবাসী জনগোষ্ঠীর অস্তিত্ব ধরে রাখা সম্ভব নাও হতে পারে।

জনসংখ্যার বিচারে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অাদিবাসী জনগোষ্ঠী হচ্ছে চাকমা। যাদের বসবাস মূলত: পার্বত্য চট্টগ্রামে। অার সিলেটসহ বাংলাদেশের অন্যান্য সমতল অঞ্চলে বসবাসরত জনগোষ্ঠীর মধ্যে রয়েছে সাঁওতাল, মণিপুরী, খাসি, পাত্র, হাজং, ওরাঁও, শব্দকর, চা জনগোষ্ঠী ইত্যাদি।

জনসংখ্যার বিচারে সিলেটে সবচেয়ে বড় অাদিবাসী জনগোষ্ঠী হচ্ছে চা-শ্রমিক। বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে শুধু চা শ্রমিক জনগোষ্ঠীর সংখ্যাই হচ্ছে প্রায় পাঁচ লক্ষাধিক।

অার অন্যান্য সব অাদিবাসীসহ সিলেটে মোট অাদিবাসী জনগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় অাট লক্ষাধিক। বিভিন্ন সরকারী ও বেসরকারী পরিসংখ্যান থেকে জানা যায় যে, বর্তমানে বাংলাদেশে অাদিবাসী ও অন্যান্য সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ক্রমশ কমছেই। যা রীতিমতো উদ্বেগজনক।

সিলেটভিউ২৪ডটকম/১০অাগস্ট২০১৮/এমইউএ

সম্পাদক : মো. শাহ্ দিদার আলম চৌধুরী
উপ-সম্পাদক : মশিউর রহমান চৌধুরী
✉ sylhetview24@gmail.com ☎ ০১৬১৬-৪৪০ ০৯৫ (বিজ্ঞাপন), ০১৭৯১-৫৬৭ ৩৮৭ (নিউজ)
নেহার মার্কেট, লেভেল-৪, পূর্ব জিন্দাবাজার, সিলেট
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.