আজ বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ইং

‘নির্দোষরাই শূলে চড়িবে, দোষীরাই কোলে চড়িবে’

গঞ্জিকা সেবনের ইতিকথা-০২

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৯-০২-২২ ০০:০৮:০০

শামসুল ইসলাম শামীম :: ‘আর ঘুমাইয়া রিজনী কাটাইবার সময় নাই, বেলা তিরোহিত হইতেসে, এখনই জাগ্রত হও বতস্য!’ -ঐশ্বরিক এই হুঙ্কারে আমার ঘুম টুটিয়া গেলো, আমি তড়াক করিয়া শয্যায় উঠিয়া বসিলাম। অন্ধকার শয়ন কক্ষের চারপাশে কাউকে না দেখিয়া অতিশয় শঙ্কিত হইয়া পড়িলাম। হঠাত মনে হইলো, আমার গোটা শয়ন কক্ষে গঞ্জিকার ‘গু-গন্ধ’ মৌ মৌ করিতেছে! সেই গু-গন্ধে আমার নাসিকা বন্ধ হইয়া আসিতেছে।

সন্ধ্যাবেলায় সস্তা দামে খাওয়া ডাইল-ভাত ভিতর হইতে আপনা-আপনি উগড়াইয়া আসিতেছে! আমি কোনমতে গলাসমেত খাদ্য নালী চাপিয়া ধরিয়া ভিতরে আন্দোলনরত উগড়াইয়া আসিবার উপক্রম হইবার মালামাল ফের ভিতরে ইস্তেমাল করিয়া দিয়া ভীত কন্ঠে শুধাইলাম-

-কে কথা কহিলেন?
-ভীত হইসনা বতস্য, আমি তোর সাধুবাবা। তোর সামনের মুক্তির পথ উন্মোচণ করিয়া দিতে আসিয়াছি।
-আপনি কথা হইতে আগমন করিয়া এই গরীবের জীর্ণ কুঠিরে তশরিফ রাখিয়াছেন বাবা?

এই প্রশ্নের কোণ জবাব পাইলাম না, সেকেণ্ড চাইরেকের ভিতরে একখানা হাতের খসখসে তালু আমার কপালে আসিয়া পড়িলো! নিধেন পক্ষে দেড়যুগ সময়কাল অতিবাহিত হইয়াছে এমন নখের আলতো ছোঁয়ায় কপালে তীব্র ব্যাথা অনুভূত হইলো। সেই ব্যাথার তীব্রতায় আমি কিছুটা ককাইয়া উঠিলাম। সাধুবাবা আমার কপাল হইতে তাহার হাত সরাইয়া নিয়া আমার মুখোমুখি বসিলেন। তাহার বদন হইতে যে উটকো গন্ধ আমার নাকে আসিতেছে, তাহা আমি কোনমতেই সহিতে পারিতেছিনা। জন্মের পর সাধুবাবা ইহকালে আর স্নানকম্ম সারিয়াছেন বলিয়া আমি বিশ্বাস করিতে পারিতেছিনা। তিনি আমার দিকে আরো কিঞ্চিৎ সরিয়া আসিলেন।

আমি মানুষের ত্যাগ করা হলুদ বরণের ‘মালে’র গন্ধ পাইতেছি! আমার নাড়িভূড়ি সব একাকার হইয়া মুখ দিয়া উগড়াইয়া আসিবার জন্য ‘এক দফা এক দাবী’র ভিত্তিতে আন্দোলন বেগবান করিয়া তুলিয়াছে। আমি কহিলাম-
-বাবা, আমি বমি করিব
বাবা আমার এই কথা শ্রবণ করিয়া কহিলেন-
-বতস্য, এইটুকুতেই অধৈর্য হইলে চলিবে কেমনে? শান্ত হও।
আমি শরীরের সর্বশক্তি দিয়া এক হাতে গলা এবং অন্য হাতে মুখ চাপিয়া ধরিয়া উঠিয়া গিয়া শয়ন কক্ষের নিষ্প্রাণ বাতিতে প্রাণ সঞ্চার করিলাম।

সাধুবাবা কহিলেন, বতস্য তুমি আমার নিকটবর্তি হইয়া বসো।
আমি তাহার নিকটবর্তী হইতে হইতে খেয়াল করিলাম, বাবার কোমরে এক টুকরা লালসালুর নেংটি ছাড়া শরীরের আর কোথাও কাপড়ের কোন বালাই নাই। বাম হাতে ত্রিশূল আর একটি লোটা ধরা। বাবা ডান হাতে টান দিয়া আমাকে তাহার সামনে বসাইলেন। সামনে বসিয়াই আরেক ফরদা বিপদে পড়িলাম। বাবার লালসালুর নেংটির ফাঁকফোকর গলে আফ্রিকার একখণ্ড গহীণ অরণ্য আমার চোখ ধাধিয়ে দিলো। সেই জঙ্গলের ফাঁক দিয়া মনে হইলে একটা মরা বাঘ নীচের দিকে মাথা
ঝুলাইয়া লটকিয়া আছে! অরণ্যের গভীরতার কারনে শুধুই মরা বাঘটির মাথাই দেখা যাইতেছে! আমি দ্রুত চোখ সরাইয়া শঙ্কিত কণ্ঠে জিজ্ঞাসিলাম-
-বাবা, এই গরীবের দরবারে কোথা হইতে আপনার শুভাগমণ হইয়াছে?
-তোর ডাক শুনিয়া আমি হিমালয়ের চূড়া হইতে নামিয়া আসিয়াছি বতস্য!
বাবার কথায় আমার তো ভিমড়ি খাইবার যোগাড়! আমি শুধাইলাম-

-আপনি আমার ডাক শুনিলেন কেমনে বাবা? আমি তো কষ্মিনকালেও আপনারে স্মরণ করি নাই!
-করেছিস রে নাবুঝ-নালায়েক বতস্য। তুই কি ভুলিয়া গিয়াছিস যে, গঞ্জিকা সেবনের ইতিকথা জানিবার মানসে তোর দিল বহুত বেচাইন হইয়া আছে?
-ঠিক বলেছেন বাবা, এইকারনে আমার দিল বহুত পেরেশান হইয়া আছে, কলিজা ফানাফিল্লা হইয়া যাইতেছে। বাবা কি কৃপা করিয়া এই অধমকে সেই পথ
বাতলাইয়া দিতে পারিবেন?
বাবা আমার কথার কোন জবাব না দিয়া লোটার ভিতর হইতে কল্কিসমেত সিদ্ধি বাহির করিয়া তাহাতে অগ্নিসংযোগ করিলেন। কল্কির গোড়ায় মিনিট তিনিকের লম্বা একটা টান দিয়া কল্কিটি আমার দিকে বাড়াইয়া দিলেন!
-শোন বতস্য, গঞ্জিকা সেবনের ইতিকথা জানিবার জন্য এতো বেচাইন হইবার ফুরসত নাই! চোখ-কান খোলা রাখিয়া চলিলেই উহার সন্ধান পাইবি।
-কিন্তু আমি তো পাইনা বাবা, খরগোশের মতো কান খাড়া করিয়া চলিয়াও উহার সন্ধান পাইতেসিনা। বাবাগো, আপনি আমারে পথা দেখাইয়া লইয়া চলেন!
আমি বাবার পায়ের কাছে বসিয়া পড়িলাম। বাবা আমাকে উঠিয়া দাঁড়াইতে ইশারা করিলেন। আমি উঠিয়া দাঁড়াইলাম।

-শোন বতস্য, এই ত্রিশূলটি দেখিতেছিস?
-হুম, দেখিতেছি বাবা।
-উহার অগ্রভাগ কতোটা শুচালো তাহা কি দেখিয়াছিস?
-হুম বাবা দেখিয়াছি
-এই ত্রিশূলের অগ্রভাগে তোদের বঙ্গদেশের জাহালাম নামের এক যুবককে সেধিয়ে দিয়াছিলাম।
-কিন্তু বাবা, সে তো নির্দোষ।

-নির্বোধ বতস্য, নির্দোষরাই তো শূলে চড়িবে!
-ইহা তো অন্যায় বাবা, পুরাদস্তুর অবিচার।
বাবা ইটভাটার মতো একমুখ ধোয়া আমার মুখের উপর ছাড়িয়া দিয়া হো হো করিয়া হাসিয়া উঠিলেন, তাহার হাসির দমকে আমার পুরা ঘরখানা থরথর করিয়া কাঁপিয়া উঠিলো-
-শোন বতস্য, তুই এইবেলাও নাবালিক রহিয়াছিস। শুনিয়া রাখ, জগতে নির্দোষরাই শূলে চড়িবে আর দোষীরাই কোলে চড়িবে- ইহাই এই বঙ্গদেশের, এই বঙসংসারের নিয়ম! তুই কি জাহালমের ঘটনা হইতে গঞ্জিকা সেবনের ইতিকথা’র সুত্র খুঁজিয়া পাইতেছস না? শোন আমার নির্বোধ বালক, এই বঙ্গদেশে কালে-কালে এমনতর ধারায় নির্দোষরা শূলে চড়িয়াসে। কিন্তু দোষীদের টিকিটিও কেহ ছুঁইয়া দেখিতে পারে নাই!

এই যে আমি জাহালমকে তিন বছর শূলে ঝুলাইয়া রাখিয়াছিলাম, তাহাতে কেহ কি আমার কেশাগ্রও ছুইতে পারিয়াছে? পারেনাই। এই না পারার সুত্র ধরিয়া তুই অতীতের পানে ধাবিত হ, তাহাতে অবশ্যই তুই সাফলকাম হইতে পারবি, তোর মনোবাসনা পূরণ হইবে। যা বতস! আমি তোকে আশীর্বাদ করিলাম, অবশ্যই তুই গঞ্জিকা সেবনের ইতিকথা জানিতে পারবি!
আমার মুখে কোন রাও নাই, আমি বাকরুদ্ধ হইয়া দাঁড়াইয়া রহিলাম! বাবা ফের হো হো করিয়া হাসিয়া উঠিলেন। আকস্মিক হাসি থামাইলেন, তাহার চক্ষুজোড়া ইটভাটার ন্যায় জ্বলিতেছে, বাবা হুঙ্কার ছাড়িলেন-
-প্রাতঃকাল সন্নিকট হইয়াসে, সাধনার সময় তিরোহিত হইতছে। বতস্য তুই নেংটা হ! (ক্রমশঃ)

লেখক: সিলেট ব্যুরো প্রধান, বাংলাভিশন।

@

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন