আজ শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ ইং

শহীদ মিনার ভাংচুর, বিচার হয়নি ৬ বছরেও

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৯-০২-২২ ১১:৫৮:৩৭

সিলেটভিউ ডেস্ক :: আজ ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, সিলেট কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে হামলার ৬ বছর। ২০১৩ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি রচিত হয়েছিলো সিলেটের ইতিহাসের একটি কালো অধ্যায়। এইদিন ভাংচুর করা হয় বাঙালীর ‘প্রাণের মিনার’ সিলেটের কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার। ব্লগ থেকে কথিত ‘ধর্ম অবমাননার  প্রতিবাদের নামে জামায়াত শিবিরের ইন্ধনে সিলেটের কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে ভাংচুরসহ ২১শে ফেব্রুয়ারি শহিদ মিনারে দেয়া ফুলে আগুন ধরিয়ে দেয় ইসলামী আন্দোলনের ব্যানারে কয়েক হাজার নেতাকর্মী। কেবল তাই না সে সময় শহিদ মিনার ভাংচুরের সাথে উল্লাসে মেতে ওঠেছিলো হামলাকারীরা। এদিন দূর থেকে এ দৃশ্য অবলোকন করা বাঙালীদের প্রাণে তৈরি হয়েছিলো ভয়াবহ এক যন্ত্রণা। চোখের সামনে বাঙালীর চেতনার প্রতীক শহিদ মিনার ভাংচুর করা হলেও দুষ্কৃতিকারীদের হাত থেকে রক্ষা করতে না পেরে সকলেই বেদনায় বিভোর হন সেদিন। আজও এ বেদনার ক্ষত মুছতে পারেনি সিলেটের মানুষ।

বেদনার এ স্মৃতির আজ ৬ বছর পূর্ণ হলেও শহিদ মিনার ভাংচুর মামলায় নেই কোন দৃশ্যমান অগ্রগতি। বরং হামলাকারীরা হয় জামিনে না হয় কথিত ‘পলাতক থাকার’ নামে প্রকাশ্য ঘুরে বেড়ালেও তাদের এখনও আনা হয়নি আইনের আওতায়। বরং আসামিরা মিলেমিশে আছেন ক্ষমতাসীনদের সাথে। এতে ক্ষুদ্ধ সিলেটের নাগরিক সমাজ।

২০১৩ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি (শুক্রবার) জুমার নামাজ শেষে কয়েকটি ইসলামী সমমনা দল ইসলামী আন্দোলনের ব্যানারে কয়েক হাজার কর্মী কোর্ট পয়েন্টে জড়ো হয়। পরে সেখানে সমাবেশ করে তারা ‘ব্লগে ধর্ম অবমাননার’ অভিযোগ তুলে প্রতিবাদের নামে সিলেটের শহিদ মিনারে গিয়ে হামলা চালায়। পৌনে ৩টার দিকে মিছিলকারীরা শহিদ মিনারে ঢুকে সীমানা প্রাচীর ভাংচুরসহ ২১শে ফেব্রুয়ারির দিন দেয়া ফুলে আগুন ধরিয়ে দেয়। এক পর্যায়ে তারা সেনাবাহিনী পরিচালিত ট্রাস্ট ব্যাংকে আগুন দেয়, শহিদ মিনারের সীমানা প্রাচীর, মুজিব-জাহান ব্লাড ব্যাংক ও বিএমএ ভবনে ভাংচুর করে। এ সময় ১ জন নিহত হন এবং অন্তত ৩০ জন আহত হন। এর মধ্যে সাংবাদিকসহ অন্তত ১০ জন গুলিবিদ্ধ হন। একই সময়ে হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। সারা দেশের ন্যায় ইসলামী আন্দোলনের ব্যানার ব্যবহার করে জামায় শিবিরের নেতৃত্বেই এ হামলা চালানো হয় বলে সেসময় জানিয়ে ছিলো পুলিশ ও সংশ্লিষ্টরা।

ওইদিন হামলার পর পর কোতোয়ালী থানার তৎকালীন উপ-পরিদর্শক জামাল উদ্দিন ও কমর উদ্দিন বাদী হয়ে ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে (মামলা নং-২৫ ও ২৬) দুটি মামলা দায়ের করেন। পরবর্তীতে বিশেষ ক্ষমতা আইনে দায়ের করা ২৫ নং মামলায় ৯৪ জনের নাম উল্লেখ করে ওই সালের ৩১ ডিসেম্বর চার্জশিট নং ৩৫৪ ও মামলা নং-২৬ এ ৮৪ জনের নাম উল্লেখ করে চার্জশিট নং-৩৫৫ দাখিল করা হয়।

এ দুই মামলায় মহানগর জামায়াতের আমির এহসানুল মাহবুব জুবায়ের, বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা ডাক্তার শাহরিয়ার হোসেন চৌধুরী, কাউন্সিলর রেজাউল হাসান কয়েছ লোদী, মহানগর জামায়াতের সহকারি সেক্রেটারি ইনসান আলী, মহানগর ছাত্র শিবিরের সাংগঠনিক সম্পাদক মাহমুদুর রহমান দেলওয়ার, এমসি কলেজ ছাত্র শিবিরের সেক্রেটারি তোফাজ্জুল আহমদ, মদন মোহন কলেজ ছাত্র শিবির সভাপতি তানভীর আহমদ, সেক্রেটারি মাহবুবসহ মোট ১৭৮ জনের নাম উল্লেখ করে কয়েক হাজার নেতাকর্মীকে অজ্ঞাত আসামি করে চার্জশিট গঠন করা হলেও অধিকাংশই রয়েছেন পলাত। কেবল তাই না, এ ঘটনার ৫ বছর পূর্ণ হলেও এখনও মামলায় তেমন কোন দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই বললেই চলে।

প্রসিকিউশন সূত্রে জানা যায়, আগামী ১৮ মার্চ পত্রিকা বিজ্ঞপ্তি উপস্থাপনের নির্দেশ দিয়েছেন আমলগ্রহণকারী আদালত। এর পর ও মামলার চার্জ গঠন ও সাক্ষী উপস্থাপন করা হবে। এ মামলায় ৫৬ জন আসামি জামিনে রয়েছেন এবং বাকি আসামিরা পলাতক রয়েছেন। তবে মামলার দীর্ঘসূত্রিতার জন্য সংশ্লিষ্টের গাফিলতিকেই দায়ী করছেন নাগরিক সমাজ।

এ ব্যাপারে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) এর সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী বলেন, শহিদ মিনারে হামলা এটি একটি জাতির জন্য লজ্জার। এ মামলায় পুলিশ চার্জশিট গঠনের পর এখন এর মূল দায়িত্ব রাষ্ট্র পক্ষের পিপির। পিপি এটি আদালতের মাধ্যমে দ্রুত নিষ্পত্তি করে দোষীদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করবেন এটিই কাম্য।

একই কথা বলেছেন সম্মিলিত নাট্য পরিষদের সভাপতি মিশফাক আহমদ মিশু। তিনি বলেন- কষ্ট লাগে যখন দেখি শহিদ মিনারে হামলাকারীরা জামিনে বেরিয়ে এসে বিভিন্ন জায়গায় নেতৃত্ব দেয়। তাই শহিদ মিনারে হামলাকারীরা দ্রুত আইনের আওতায় আসবে এ মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি হবে এটি আমাদের প্রাণের দাবী। কিন্তু সংশ্লিষ্টদের গাফিলতির কারণে মামলাটির এখনও কোন অগ্রগতি নেই বলে মন্তব্য করেন তিনি।

এদিকে শহিদ মিনারে হামলাকারীরা সমাজের ঘৃণিত ব্যক্তি হলেও কেবল সিলেটে আপোষের রাজনৈতিক সংস্কৃতির কারণে হামলাকারীরা এখন পুনরায় সমাজে প্রতিষ্ঠিত বলে মন্তব্য করেছেন সিলেট গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র দেবাশিষ দেবু। তিনি বলেন, শহিদ মিনারে হামলা আমাদের জাতীয় অস্তিত্বের উপর হামলা। কিন্তু এ হামলার মামলায় দৃশ্যমান কোন অগ্রগতি নাই। সরকার এবং সংশ্লিষ্ট সকলের আন্তরিকতার অভাবেই এ মামলা এখনও এরকমই পড়ে আছে। এরকম একটি গুরুত্বপূর্ণ মামলা এ ভাবে পড়ে থাকা দুঃখজনক। একই সঙ্গে আমরা দেখছি এ মামলায় যারা আসামি তারা নানাভাবে সমাজে আবারো প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সিলেটে আপোষের রাজনীতির কারণে এ মামলার আসামিরা কিছুদিন জেলে থেকে জামিনে বেরিয়ে এসে আবারও সমাজের বিভিন্ন জায়গায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করছে। এটি খুবই খারাপ দিক এবং লজ্জার। যারা শহিদ মিনারে হামলা করে তারা সমাজের ঘৃণিত ব্যক্তি হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার কথা থাকলেও আমরা দেখছি তারাই এখন সমজে নেতৃত্ব দিচ্ছে। তাই আমরা আশা করি এ মামলা দ্রুত সময়ের ভিতর নিষ্পত্তি হবে এবং দূষি ব্যক্তিরা শাস্তির আওতায় আসবে।

তবে মহানগর দায়রা জজ আদালতের পিপি এড. মোহাম্মদ মফুর আলী বলেন, এ মামলা এখনও আমলগ্রহণকারী আদালতে বিচারাধীন। বেশির ভাগ আসামি পলাতক থাকায় আগামী তারিখে আসামিদের আদালতে হাজির হতে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এখন আগামী ১৮ মার্চ পত্রিকার বিজ্ঞপ্তি ও সাক্ষী উপস্থাপনের পর যদি আসামিরা আদালতে অনুপস্থিত থাকেন তাহলে একতরফা বিচারের নির্দেশ দেয়া হবে বলে জানান তিনি।

সিলেটভিউ২৪ডটকম/২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯/ডেস্ক/নাহোই

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন