আজ বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ইং

‘শুধু গান নয়, লালনের মানবধর্মও ছড়িয়ে দিতে হবে বিশ্বময়’

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৯-০২-২৪ ০০:৩০:০১

শুধু গান নয়, লালনের মানবধর্মও ছড়িয়ে দিতে হবে বিশ্বময়। জাতপাতের উর্ধে উঠে লালন সব মানুষকে যে মানবজাতে মিলিত করার চেষ্ঠা করেছিলেন আমরা সেই মানবধর্মের গান গাই।-কথাগুলো বলছিলেন সিলেটের লালনকন্যা হিসেবে পরিচিত শিল্পি আয়শা রুনা। এক কাপ চায়ের আমন্ত্রণে সম্প্রতি এই শিল্পি জম্পেশ আড্ডায় কথা বলেছেন গানসহ প্রাসঙিক নানা বিষয়ে; বলেছেন নিজের কথা, সিলেটে লালন চর্চার সীমাবদ্ধতার কথাও বলতে ভুলেননি তিনি। সনাতনধারার প্রথাগত কোন সাক্ষাৎকার নয়, আলাপচারিতা আর আড্ডাবাজির চুম্বক অংশগুলো তুলে এনেছেন তনিমা আনাম

’ছিপছিপে সেই মেয়ে, ছেপছিপে সে। পেঁয়াজকোষে শাড়ির আঁচল, ঠোঁটের কোনে তিল, স্বপ্নমালায় গেঁথে গেলো হরিণ চিতাচিল’-কবির এই কাব্যভাবনার সাথে যেনো অনেকটাই মিলে যায় তার। ফর্সা আর ছিপছিপে একহরা গড়নের রুনা যখন কথা বলছিলেন তখন হাসির দ্যুতি যেনো ছড়িয়ে ছিলো তার চারপাশ জুড়ে। সদাহাস্যময়ী-লাস্যময়ী এই তরুণীর গানের শুরু সেই ’মেয়েবেলায়’। তবে মঞ্চে আসেন তারও অনেক পরে। ’৯৭-এ নগরের মিরাবাজার মডেল স্কুল মাঠে আয়োজিত সঙ্গিতায়োজেন নিজেকে মেলে ধরেন রুনা। এরপর থেকে তাঁকে আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি। অথবা বলা চলে মঞ্চই তাঁর পিছু ছাড়েনি। সেই শুরু হওয়া পথচলা আজও চলছে। ’যদ্দিন বাঁচি, এই পথচলা থেকে থেকে যেনো বিচ্যুৎ না হই’- এমনটিই বললেন রুনা। উদিচি-সিলেটের একনিষ্ঠ কর্মী হিসেবে রুনা সেই ’৯৭ থেকে ২০০৫ পর্যন্ত টানা কাজ করেছেন। রবীন্দ্রনাথের পাশাপশি গণসঙ্গীতও করেছেন প্রচুর।

তিন ভাই আর দুই বোনের মধ্যে দ্বিতীয় রুনার পুরো নাম আয়শা খানম রুনা। তবে আয়শা রুনা নামেই তিনি সম্যক পরিচিত। আম্বরখানা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষাজীবন শুরু করা রুনা এখন একটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। বিশ্বজিৎ দে অনু’র কাছে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে হাতেখড়ি তার। দীর্ঘ দিন এই গুরুর কাছেই শাস্ত্রিয় সঙ্গীতে তালিম নেন তিনি। কিন্তু লালনের প্রতি তার দুর্ণিবার ভালোবাসা যেনো অতৃপ্তিতে ভরিয়ে রেখেছিলো তার তনুমন। তাই লালন চর্চার জন্য হুতাশন শুরু করা এই লালনপ্রেমি পুরো নগর চষে বেড়িয়েছেন লালনগীতির ওস্তাদের খোঁজে! কিন্তু হতাশ হতে হয় তাঁকে। সিলেটে লালন চর্চার প্রাতিষ্ঠানিক কোন আয়োজন বা পরিচর্চার সুযোগ না থাকার বিষয়টি তাকে দারুণ ভাবে পিড়িত করে।

২০০৫ এ রানা কুমার সিনহার শিষ্যত্ব নেন আয়শা রুনা। তার আগে ২০০৩-এ মায়ের মৃত্যুতে তিনি বেশ কিছুদিন নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন। কিন্তু বুকের ভেতরে গানের যে স্বতঃউৎসরিত ধারা বহমান তার অমোঘ টান অস্বীকার করতে পারেননি তিনি। তাই ফের সঙ্গীতের ফাগুন হাওয়ায় ডানা মেলেন এই কিন্নরী শিল্পি। লালন চর্চার প্রাতিষ্ঠানিক সুযোগ না পেয়ে রুনা ঝুঁকে পড়েন রবীন্দ্রনাথের প্রতি। কিন্তু বুকের ভেতরে হাহাকার করে লালন। তাই ঠাকুর আর সাঁইজিকে একসাথে চর্চায় রেখেছেন তিনি।

বাংলাদেশ রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পিসংস্থার নিয়মিত শিল্পি রুনা গানের পাশাপাশি কাজ করছেন থিয়েটারেও। নান্দিক নাট্যদলের একনিষ্ঠ কর্মী হিসেবে ভুমিকা রাখছেন সিলেটর থিয়েটার আন্দোলনেও। ’থিয়েটারে আমি নবীণ-শিশু শিক্ষার্থী, তাই এই অঙণ সম্পর্কে কিছু বলতে চাইনা।’-সিলেটের থিয়েটারপাড়া সম্পর্কে বলতে গিয়ে এ কথাই বললেন রুনা। রুনা ইতোমধ্যে ’হাছনরাজা’ নাটকে হাছনরাজার স্ত্রী আজিজাবানুর চরিত্রে অভিনয় করে ব্যপক প্রশংসিত হয়েছেন।

ঘাঢ় নীল রঙের প্রতি অসম্ভব দুর্বল রুনার খাওয়া-দাওয়ায় কোন বাছবিচার নেই। তবে ছোট বোন আমেনা রুমির হাতে তৈরী হরেক পদের বাহারী ভর্তার টান এড়াতে পারেননা কিছুতেই। সুযোগে পেলে আইসক্রিমেও তার চিরলদাঁত হানা দেয়! প্রিয় পোষাকের তালিকাটি এককভাবে দখল করে আছে শাড়ি। গান, থিয়েটারের পাশাপাশ আঁকিয়ে রুনার প্রিয় মানুষ তাঁর মা। বঙ্গবন্ধুকে তিনি প্রিয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে জানেন। প্রতিদিনের প্রথম সূর্যোদয়ের সময়টার প্রতি দুর্বল আয়শা রুনার একমাত্র প্রিয় বন্ধু আমেনা রুমি। ঘুরে বেড়ানোর পাশাপাশি প্রাকৃতিক ঝর্ণাজলে নিজেকে ’নাইয়ে’ নিতেও বেশ পছন্দ করেন।

জেলা শিল্পকলা একাডেমীতে ফাইন আটর্সে এবার ডিপ্লোমা শেষ করবেন এই বহুমুখী প্রতিভাধর শিল্পি। চলমান সঙ্গীত চর্চার ধারায় খুবই বিরক্ত আয়শা রুনা মনে করেন, এই অসুস্থধারার পরিবর্তন হওয়া দরকার। রাতারাতি তারকা খ্যতি পাওয়ার লোভে যারা প্রতিনিয়ত গানকে ’হত্যা’ করছে তাদের তিনি করুনা করেন বলেও জানান। শিক্ষকতা দিয়ে পেশাজীবন শুরু করা রুনা সম্প্রতি শিক্ষকতায় ইস্তেফা দিয়ে একটি স্বেচ্ছাসেবী উন্নয়ন সংগঠনে যোগ দিয়েছেন। গানকেই ক্যরিয়ার হিসেবে নেয়ার পরিকল্পনা নিয়েই এগুচ্ছেন এই শিল্পি। তাঁর কথায়, ’সামনে কন্ঠকপথ, তবু যেতে হবে বহু দূর!’

@

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন