আজ বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ইং

জোবাইদার কঠোর পরিশ্রমের আয়ে স্বামীর জুয়া-বিলাসীতা

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৯-০৫-১৬ ০০:০১:০৯

সাকলিন হক :: দুই ছেলে ও দুই মেয়েকে নিয়ে অকুলপথারে প্রায় ডুবতে বসেছিলেন নেত্রকোনার জোবাইদা বেগম (৩৯)। স্বামী জুয়াড়ি। প্রায়ই আয়-রোজগারের জন্য চাপচাপি। সন্তানরা খেয়েছে কি-না তার খোঁজখবর নেয়ার কোন দরকারই মনে করতেন না।

এমন কঠিন পরিস্থিতে প্রায় ২০ বছর আগে জীবিকার সন্ধানে তিনি চলে আসেন এই সিলেট শহরে। তখন অবশ্য তার ১ মেয়ে ও ১ ছেলে। ছোটা কামলা হিসাবে শুরু করেন জীবনযুদ্ধ। এরপর গত প্রায় ১৫ বছর ধরে নির্মাণ শ্রমিক (ঢালাই) হিসাবে কাজ করছেন তিনি। সেই সাথে চলছে তার ও সন্তানদের জীবনও।

বর্তমানে জোবাইদা বসবাস করছেন সিলেট শহরের বাদাম-বাগিচা এলাকায়। ২ ছেলে এবং ২ মেয়ে নিয়ে তার সংসার । বড় মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন বছর পাঁচেক আগে, আর ছোট মেয়ে পড়ছে স্কুলে।

জানালেন, নিজে লেখাপড়া জানেন না। তাই ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন। স্বপ্ন দেখেন একদিন তার ছোট্ট মেয়েটি লেখাপড়া করে চাকরি-বাকরি করে উন্নত জীবন-যাপন করবে।

স্বামীর প্রসঙ্গ উঠতেই দুঃখ করে তিনি বলেন, স্ত্রী-সন্তানের অধিকার হিসাবে কেবল তার নামটাই ব্যবহার করতে পারি। তিনি কেবল একজন বেকারই নয়, জুয়াড়িও। আর তাই তাদের এই দুর্ভোগ।

তিনি দেশের বাড়ি নেত্রকোনায় থাকলেও বছরে ২/৩ বার আসেন জোবাইদার ঘাম ঝরানো উপার্জনের ভাগ নিতে। বাঙালি নারীর স্বামী ভক্তির কাছে তখন হেরে যায় হাড়-ভাঙ্গা খাটুনী আর অশ্রু ঝরা দিনরাতের উপাখ্যান।

জোবাইদার ছেলেরাও বাউন্ডুলে স্বভাবের। কন্সট্রাকশন সাইটে ইট-পাথর ভাঙ্গাসহ পাথর, বালু বহনের কাজ করছেন তিনি। বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা থাকা সত্ত্বেও মাসে ১০/১৫ দিন কাজ করতে হয় তাকে। ঝড়বৃষ্টি বা কাঠফাটা রোদেও পুরুষ সহকর্মীদের সাথে সমান তালে কাজ করছেন তিনি।

বিনিময়ে দৈনিক ৫০০/৬০০ টাকা আয় হচ্ছে। তবে সেকালের মতো একালেও বৈষম্যের স্বীকার হচ্ছেন জোবাইদারা। একই কাজ করে পুরুষেরা দৈনিক ৭/৮শ’ টাকা কামাই করছেন।

কর্মসক্ষমতার বিষয়টি নিয়ে একই কন্সট্রাকসনের ঊর্ধ্বতন কর্মীরা একমত হলেও নারী ও পুরুষ শ্রমিকদের বেতন-বৈষম্য নিয়ে তারা কেউই কোন সদুত্তর দিতে পারেন নি।

সৃষ্টির শুরু থেকেই সামাজিক ও পারিবারিক ক্ষেত্রে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও রুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন । শুধু সন্তান জন্মদানই নয়, প্রতিটি কর্মক্ষেত্রেই তারা তৈরি করে নিয়েছেন নিজেদের স্থান । প্রাচীন যুগেও এই নারীরাই সভ্যতাকে এগিয়ে নিতে অবদান রেখেছেন। তাদের হাত ধরেই হয়েছে কৃষিকর্মের উৎপত্তি।

সমাজের পুরুষেরা যখন পশু শিকার করতে বন-জঙ্গলে যেত, নারীরা তখন সন্তান পালনের সাথে সাথে বিভিন্ন ধরণের ঘর- গৃহস্থালির কাজ কর্মে ব্যস্ত থাকতেন, যা মানবসভ্যতা এগিয়ে নেয়ার অন্যতম ভিত্তি।

বর্তমান সমাজেও এ ধারার বিকল্প নেই। বরং নারীরা দৃঢ়তা ও সাহসিকতার সাথে এগিয়ে চলছে প্রতিটি ক্ষেত্রে। পারিবারিক কাঠামোগত নিয়মতান্ত্রিক কাজকর্মের বাইরেও নারীরা অবদান রাখছেন। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষকতাসহ প্রায় সব পেশাতেই তারা নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করছেন।

এমন কি রাজনীতি বা ব্যবসা-বানিজ্য কোন ক্ষেত্রেই পিছিয়ে নেই তারা। কোনকোন নারী আবার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা এবং জীবন যুদ্ধের লড়াইয়ে চালিয়ে যেতে পাথর ভাঙছেন বা পুরুষের পাশাপাশি কঠোর শ্রম দিচ্ছেন বিভিন্ন কনস্ট্রাকশন সাইটে। কিন্তু এত সবের পরেও কি তারা যোগ্য মর্যাদা পাচ্ছেন না বলে প্রায়ই শোনা যায়। পুরুষতান্ত্রিক এই সমাজে আজো তারা নিত্য হয়রানীর স্বীকার হচ্ছেন।

বর্তমান সরকার নারীর ক্ষমতাওনের লক্ষে যথেষ্ট উদ্যোগী। অফিস-আদালত,স্কুল-কলেজ থেকে শুরু করে প্রতিটি কর্মস্থলে নারীদের দেয়া হচ্ছে সর্বচ্চো সুযোগ-সুবিধা। তবে কন্সট্রাকসন বিল্ডিং, গার্মেন্টসসহ আরো কয়েকটি সেক্টরে জোবাইদারা প্রতিনিয়ত মজুরিবৈষম্যের স্বীকার হচ্ছেন।

অবহেলিত এই নারী শ্রমিকদের সুবিধা বঞ্চিত রেখেই কি তবে নারীর ক্ষমতায়ন হচ্ছে? এমন প্রশ্ন সচেতন মানুষের।

সিলেটভিউ২৪ডটকম/১৬ মে ২০১৯/এসএইচ/এক

@

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন