আজ বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ইং

অধম্য মেধাবী: ইচ্ছাশক্তি দিয়ে বাধাকে জয় করেছেন তাঁরা

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৯-০৫-২১ ১৫:৪৬:৫৪

আব্দুর রহমান সোহেল, রাজনগর :: পরিবারের অভাব-অনটনে হার মানেনি রাজনগর উপজেলার আজমল হোসেন, ফাতেমা আক্তার ইমা ও তাহমিদা আক্তার। অভাবের সংসারে বাবা-মায়ের যেখানে দু’বেলা দু’মুঠো ভাত মুখে তুলে দেয়া ছিল দূরহ, সেখানে লেখাপড়া করার স্বপ্নটা ছিল তাদের কাছে ‌'দিবাস্বপ্ন'।

এতোসব প্রতিবন্ধকতাকে নিজেদের ইচ্ছাশক্তি দিয়ে জয় করেছেন রাজনগর উপজেলার ঘরগাঁও গ্রামের আজমল হোসেন, গোবিন্দবার্টী এলাকার ফাতেমা আক্তার ইমা ও দত্তগ্রামের তাহমিদা আক্তার।

এবারের এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছে তারা। তবে এতো প্রতিবন্ধকতা মাড়িয়ে ভবিষ্যতে কতটুকু লেখাপড়া চালিয়ে যেতে পারবে এমন আশঙ্কা তাদের। দারিদ্রতার কারণে তাদের স্বপ্নগুলো বাস্তবায়ন হবে কিনা এমন শঙ্কায় দিন কাটছে এই তিন অধম্য মেধাবীর।

উপজেলার সদর ইউনিয়নের ঘরগাঁও গ্রামের মাতৃহীন আজমল হোসেন রাজনগর পোর্টিয়াস মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এবারের এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে জিপিএ-৫ পেয়েছে। স্বপ্ন বড় হয়ে ডাক্তার হবে। সেবা করবে তার পরিবারের মতো অসচ্ছল মানুষের। বছর দুয়েক আগে তার মা ছামতি বেগম মারা গেছেন। বাবা বেলাল আহমদ (৫২) প্যারালাইসি রোগী। তার এক পা ও এক হাত ৫ বছর ধরে নাড়াতে পারেন না। শারীরিক অক্ষমতার কারণে কোনো কাজ করতে পারেন না। নিজেদের কোনো ভিটেমাটি নেই। নেই কোনো চাষের জমিও।

রাজনগর সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান দেওয়ান খয়রুল মজিদ ছালেকের ৫ শতাংশ জমিতে মৌখিক অনুমতি নিয়ে ঘর বানিয়ে থাকছেন। মাঝে মাঝে এলাকার কিছু মানুষ আর্থিক সহযোগিতা করলে সেই টাকায় সংসার চলে তাদের। এতো সমস্যার মাঝেও মেধাবী আজমল দমে যায়নি। নিজের লেখাপড়ার খরচ যোগার করতে সে ৩/৪টি টিউশনি করে। সেখান থেকে আয় হাজার চারেক টাকা। সেই টাকা থেকে অসুস্থ বাবার চিকিৎসা ও খাওয়ার ব্যবস্থা হয়। বই-খাতা কিনতে এলাকার মানুষের সহযোগিতা নিতে হতো তাকে। লেখাপড়ার আগ্রহ দেখে বিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও আলাদা যত্ন নিতেন। প্রতিবন্ধকতার মাঝে ভালো ফলাফল করেও এখন সে হতাশায় ভুগছে। দরিদ্র ও পঙ্গু বাবার পক্ষে যেখানে চিকিৎসার খরচ যোগার করা কঠিন সেখানে সন্তানের লেখাপড়ার খরচ চালানো অসম্ভব। অন্যদিকে উচ্চ শিক্ষার জন্য এতো বড় অঙ্কের খরচ চালিয়ে নেয়া তার পক্ষেও সম্ভব নয়। ফলে মেধাবী আজমলের ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন এখন হতাশার কালো মেঘে ঢেকে যাচ্ছে।

আাজমল হোসেন বলেন, খুব কষ্ট করে লেখাপড়া করেছি। বাবার চিকিৎসা ও ঔষধ কিনতে অনেক টাকা প্রয়োজন হয়। নিজে টিউশনি করে এতদূর এসেছি। অনেকে সহযোগিতা করেছেন। উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করতে অনেক টাকা প্রয়োজন। এতো টাকা আমি ও আমার বাবার পক্ষে যোগার করা অসম্ভব।

উপজেলার মনসুরনগর ইউনিয়নের গোবিন্দবার্টি এলাকার মেধাবী ফাতেমা আক্তার ইমা’র বাবা থেকেও নেই। জন্মের পর ইমার বয়স যখন ১১ মাস তখন মা সেলিনা বেগমকে ডিবোর্স দেন বাবা জয়নাল মিয়া। তারপর আর কোনোদিন স্ত্রী-সন্তানদের কোনো খোঁজ নেননি তিনি। সেই থেকে জীবন যুদ্ধে লড়াই করে আসছেন ইমার মা সেলিনা বেগম। সেলিনা বেগম সেলাইয়ের কাজ করেন। সেলাই করে যে টাকা আয় হয় তা দিয়ে কোনো মতে চলছে তাদের মা-মেয়ের সংসার। এতো দারিদ্রতার মাঝেও ইমার লেখাপড়ায় আগ্রহ ও ভালো ফলাফল করছে দেখে মেয়ের লেখাপড়া বন্ধ করেননি সেলিনা বেগম। ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন দেখা ইমা এবারের এসএসসি পরীক্ষায় রাজনগর আইডিয়েল হাইস্কুল থেকে অংশগ্রহণ করে সকল বিষয়ে জিপিএ-৫ পেয়েছে। অষ্টম শ্রেণিতেও জিপিএ-৫ পেয়েছিল। অভাব-অনটনের সংসারে যেখানে খাবারের ব্যবস্থা করা কঠিন সেখানে লেখাপড়ার স্বপ্ন দেখাটা যেন তার কাছে দিবাস্বপ্ন। তাই সবসময় স্বপ্ন ভাঙ্গার শঙ্কায় দিন কাটছে ইমার।

ফাতেমা আক্তার ইমা বলেন, আমার মা সেলাই করে সংসার চালিয়েছেন। লেখাপড়ার খরচ চালাতে তার কষ্ট হলেও বন্ধ করে দেননি। স্কুলের শিক্ষকরাও আমাকে সহযোগিতা করেছেন। আরো লেখাপড়া করে ডাক্তার হতে চাই। যে মা কষ্ট করে এতোদূর পর্যন্ত এনেছেন ডাক্তার হয়ে তার সেবা করতে পারলে নিজেকে ধন্য মনে করবো। তবে এতো দরিদ্রতার মাঝে স্বপ্ন পূরণ হবে কিনা জানি না। বিত্তবানদের সহযোগিতা পেলে হয়তো লেখাপড়া করে এগিয়ে যেতে পারবো।

এদিকে রাজনগর আইডিয়েল হাই স্কুল থেকে বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছে আরেক অধম্য মেধাবী তাহমিদা আক্তার। তাহমিদার বাবা নজরুল ইসলাম পেশায় একজন রাজমিস্ত্রী। দরিদ্র বাবা নিজের হাতে অন্যের স্বপ্নের বাড়ি তৈরির কাজ করলেও মেয়ের স্বপ্ন পূরণে তিনি অক্ষম। পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণিতেও তাহমিদা জিপিএ-৫ পেয়েছিল। ৩ বোন ও ১ ভাইয়ের মধ্যে তাহমিদা তৃতীয়। রাজমিস্ত্রিীর কাজ করে দিন শেষে যে টাকা আয় হয় তা দিয়ে পরিবারের ছয় সদস্যের মুখে খাবার তুলে দিতেই মিহশিম খেতে হয় বাবা নজরুল ইসলামকে। অভাব-অনটনের কারণে লেখাপড়ার খরচ বহন করতে না পেরে তাহমিদার বড় দুই বোনকে ইতিমধ্যে বিয়ে দিয়েছেন দরিদ্র বাবা। ডাক্তার হওয়ার স্বপ্নে বিভোর তাহমিদাকে সহযোগিতা করেছেন তার বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। লেখাপড়ার প্রতি প্রবল আগ্রহ দেখে বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তাকে বিনা বেতনে পড়াতেন। মানবিক বিবেচনায় এসএসসি পরীক্ষার ফরম পূরণেও ফি নেয়ার ক্ষেত্রেও তাকে সুযোগ দিয়েছেন। মেধাবী তাহমিদাকে টাকা না নিয়েও প্রাইভেট পড়াতেন শিক্ষকরা। সবার সহযোগিতায় এপর্যন্ত লেখাপড়া করলেও উচ্চশিক্ষার পথ অমসৃণ দেখছে সে।

উচ্চ মাধ্যমিকের খরচ বহন করা তার দরিদ্র বাবার পক্ষে সম্ভব নয়। এতো ভালো ফলাফল করে যেখানে আনন্দিত হওয়ার কথা ছিল সেখানে ভবিষ্যতের ভাবনায় দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পেড়ছে তাহমিদা। তার ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন পূরণে এখন প্রধান বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে পরিবারের দারিদ্রতা। সমাজের বিত্তবানরা তার উচ্চশিক্ষার সারথি হলে দারিদ্রতার অন্ধকার পথ পাড়ি দিয়ে আলোর পথে এগিয়ে যেতে পারবে অধম্য মেধাবী তাহমিদা আক্তার।

রাজনগর আইডিয়েল হাই স্কুলের শিক্ষক আবুর রাইয়্যান শাহীন বলেন, আমাদের বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তাকে বিনা পয়সায় প্রাইভেট পড়িয়েছেন। বৃত্তি পাওয়ায় তাকে বেতন দিতে হতো না। তবে বৃত্তি পাওয়ার আগেও তাকে বেতন দিতে হয়নি। স্কুলের কোন ফি তার কাছে থেকে আমরা কখনো নেই নি।

এতো দারিদ্রতার মধ্যেও সে যে ফলাফল করেছে তাতে বিদ্যালয়ের সব শিক্ষক-শিক্ষিকারা খুশি হয়েছেন। তবে দরিদ্রতার কারণে তাহমিদার লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়া নিয়ে শিক্ষকরা শঙ্কিত।



সিলেটভিউ২৪ডটকম/২১ মে ২০১৯/এআরএস/এসডি

@

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন