আজ শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ইং

ইচ্ছাপূরণের ডাক দিয়ে যায় এমসি কলেজ

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৯-০৯-১২ ০০:০২:১৮

আশরাফ আহমেদ, এমসি কলেজ :: গ্রামের এক বড় আপু শহরে পড়তেন। মাঝেমধ্যে বাড়িতে আসলে আমাদের সাথে তার কলেজের শিক্ষাব্যবস্থা, সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের গল্প শুনাতেন। রুবানা আপুর কাছে এমসির কথা শুনতে শুনতে কলেজটিকে একনজর দেখার জন্য আঁকুতি জানাতে থাকি। পরে আপুর সাথেই একদিন চলে আসি টিলাগড়ের এই ক্যাম্পাসে। বিশাল ক্যাম্পাস ঘুরতে ঘুরতে দুপুর গড়িয়ে যায়। কলেজের মনোরম পরিবেশ আমাকে এতটাই তাড়িত করে যে, স্বপ্ন দেখতে থাকি এমসি কলেজে পড়ার। পরে মাধ্যমিক-উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় কাক্সিক্ষত ফলাফল করে উচ্চশিক্ষার জন্য প্রথমে আবেদন করি সিলেটের এই সবুজ আঙ্গিনায়।

ছোটবেলা থেকে বুনো স্বপ্নপূরণের কথাগুলো একঝলক রূপালি হাসির মাধ্যমে এমনিভাবেই বলছিলেন এমসি কলেজের দর্শন বিভাগেরঅনার্স প্রথম বর্ষের ছাত্রী সায়মা ইসলাম। সুনামগঞ্জের দিরাইর প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে উঠে আসা সায়মা বলেন, স্বপ্নের এমসি কলেজে লেখাপড়া করার সুযোগ পেয়ে সত্যিই নিজেকে গর্বিত মনে হচ্ছে।

ইংরেজি বিভাগে নতুন ভর্তি হওয়া আজহার সৌরভি, নামের আরেক শিক্ষার্থী বলেন, বাবা বলতেন এমসি কলেজে পড়ার জন্য কত চেষ্টাই না করেছিলাম। ভাগ্যে নেই, যে কারণে আর পড়া হয়নি। বাবা প্রায়ই মায়ের সাথে গল্পের ছলে বলতেন, আমি পারিনি তো কি হয়েছে মেয়েকে এমসিতে পড়াব। ছোটবেলা থেকেই বাবার মুখে তার স্বপ্নের কথাগুলো শুনতে শুনতে একসময় আমি ও স্বপ্ন দেখতে থাকি এমসিয়ান হওয়ার। সৌরভি বলেন, বাবা-মেয়ের স্বপ্নপূরণ হয়েছে। ভাবতেই ভাল লাগছে। আজ আমিও একজন মুরারিয়ান (এমসি কলেজের শিক্ষার্থীদের মুরারিয়ান বলা হয়) ।

শুধু সায়মা আর সৌরভিই নয় এরকম লাখো শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া করা স্বপ্নের প্রতিষ্ঠানের তালিকার শুরুতেই থাকে সিলেটের ঐতিহ্যবাহী মুরারিচাঁদ (এমসি) কলেজের নামটি। ১৮৯২ সালে রাজা গিরিশ চন্দ্রের প্রতিষ্ঠিত বিদ্যাপীটটি বাংলাদেশের শতবর্ষী কলেজগুলোর মধ্যে অন্যতম।

দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় শহর সিলেটের সর্ববৃহৎ প্রাচীণ এই কলেজটির বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যেগুলো দেশের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে একইসাথে পাওয়া যায় না।পাহাড়-টিলাঘেরা ক্যাম্পাসের আঁকাবাঁকা পথ, সারিবাঁধা বৃক্ষরাঁজি, সুবিশাল কাজলদিঘী তার মধ্যে থাকা শ্বেতপদ্মগুলো ক্যাম্পাসে আসা নতুনদের মোহাবিষ্ট করে। আকর্ষীক ভঙ্গিমায় দাড়িয়ে থাকা দৃষ্টিনন্দন ফটক দুটি দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। তাছাড়া মোগল স্থাপত্যের আদলে তৈরি করা কলেজের সুবিশাল কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারটি সিলেট তথা সারাদেশের প্রাচীন লাইব্রেরিগুলোর মধ্যে অন্যতম। লাইব্রেরিতে বর্তমানে ২৪ হাজার পাঠযোগ্য বই আর বিভিন্ন ধরনের কবিতা,গল্প-উপন্যাস, দেশি-বিদেশি জার্নাল সহ প্রায় ৬০ হাজারের ও বেশি বই রয়েছে।

শিক্ষার্থীদের থাকার জন্য এখানে রয়েছে আলাদা আলাদা ছাত্রাবাস ও ছাত্রী হোস্টেল। আছে বিশালাকৃতির খেলার মাঠ। মাঠটি এতই বড় যে, একইসাথে অনেকগুলো দল অনায়াসেই এর মাঝে খেলাধুলা করতে পারে। বৈচিত্রময় ক্যাম্পাসে একইসাথে এত সুযোগ সুবিধা রয়েছে, যেগুলো দেশের খুব কমসংখ্যক কলেজে পাওয়া যায়। প্রতিষ্ঠানটি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে থাকলেও এখানে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীরা কিছু কিছু ক্ষেত্রে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মতই অনেক সুযোগ সুবিধা পেয়ে থাকে। যে বিষয়গুলো এখানে ভর্তি হতে নতুনদের আগ্রহ জাগায়।

সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে কলেজ প্রশাসনের রয়েছে সহযোগিতামূলক মনোভাব। বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় শিক্ষার্থীদের ঈর্ষনীয় সাফল্য রয়েছে। নতুন ছাত্র-ছাত্রীদের এখানে ভর্তি হওয়ার ক্ষেত্রে এ বিষয়টিও বিশেষভাবে প্রাণিত করে।

দেশের সপ্তম প্রাচীন বিদ্যাপীট ঐতিহ্যবাহী কলেজটি ১২৪ একর জায়গা নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হলেও বর্তমানে এর আয়তন ১৪৪ একর। ১৮ জন শিক্ষার্থী নিয়ে প্রতিষ্ঠা পাওয়া কলেজটিতে বর্তমানে উচ্চ মাধ্যমিক (বিজ্ঞান), ডিগ্রি (পাস) এবং স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তরের ১৬টি বিভাগে ১৪ হাজারের ও বেশি শিক্ষার্থী লেখাপড়া করেছেন। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ হিসেব অনুযায়ী আয়তন ও শিক্ষার্থীর দিক থেকে সিলেট অঞ্চলের শ্রেষ্ঠ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান এটি।

দুটি পাতা, একটি কুড়ি আর ৩৬০ আউলিয়ার দেশ হিসেবে পরিচিত আধ্যাত্মিক নগরী সিলেট বাংলাদেশের অন্য যেকোনো জায়গা থেকে অনেক বেশি নিরাপদ। যে কারণে সুশৃঙ্খল পরিবেশ আর মানসম্পন্ন লেখাপড়া করার জন্য সিলেট ছাড়াও দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শিক্ষার্থীরা এখানে ছুটে আসেন।
গত জুন মাসের ২৭ তারিখে ১২৮ বছরে পদার্পণ করা কলেজটি সিলেট অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের উচ্চিশক্ষা অর্জনের ক্ষেত্রে অনন্য ভূমিকা রেখে চলেছে । কলেজটিকে টানা তিনবার অঞ্চলসেরার স্বীকৃতি দিয়েছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়।

কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক বিভূতিভূষণ বলেন, কোন প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়ার পূর্বে অভিভাবকসহ শিক্ষার্থীরা যে বিষয়গুলো প্রথমেই মূল্যায়ন করে থাকেন, সেগুলো হল, বিগত সময়ে এখানটার একাডেমিক রেজাল্ট কেমন। বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের প্রতিযোগিতায় শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ ও সাফল্যের হার। প্রতিষ্ঠানের ইতিহাস-ঐতিহ্য, সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের ধরণ, এবং প্রতিষ্ঠানের শৃঙ্খলা। এছাড়াও ক্যাম্পাসের সুন্দরের দিকটাও অনেকের কাছেই মুল্যায়িত হতে পারে। বিভূতিভূষন বলেন, উল্লেখিত বিষয়গুলো এমসি কলেজে একই সাথে বিদ্যমান রয়েছে, যেকারণে এখানে ভর্তি হওয়ার জন্য এ অঞ্চলের শিক্ষার্থীরা অনেক বেশি আগ্রহ দেখায়।

ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীটটার একই সাথে এতো বিশেষত্ব থাকার ফলে সিলেট বিভাগের কলেজগুলোর মধ্যে এমসিতে আবেদন করা শিক্ষার্থীদের সংখ্যাটিও চোখে পড়ার মতোই।

কলেজসূত্রে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, গত বছর অনার্স কোর্সে পড়ার জন্য ২২০৫ টি আসনের বিপরীতে ৭ হাজারেরও বেশি শিক্ষার্থী আবেদন করে। আর ডিগ্রি (পাস) পড়তে ১৫০০ সিটের বিপরীতে আবেদন করে সাড়ে তিন হাজারের বেশি শিক্ষার্থী। একাদশ (শুধুমাত্র বিজ্ঞান) শ্রেনীতে থাকা ৩২০ টি সিটের জন্য আবেদন করে ১৩ শ 'র বেশি শিক্ষার্থী। কলেজ কর্তৃপক্ষ বলছে এবছর আবেদনের হার আরো বাড়বে।

কলেজ অধ্যক্ষ প্রফেসর নিতাই চন্দ্র চন্দ বলেন, তৎকালীন আসাম প্রদেশের একমাত্র উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান হওয়ায় এখান থেকে অনেক প্রখ্যাত ব্যক্তিরা লেখাপড়া করেছেন। নিতাই বলেন, কলেজের প্রাকৃতিক সুন্দর্যগুলো শিক্ষার্থীসহ সবাইকে দারুণ ভাবে আকর্ষিত করে। এখানে পড়তে আসা শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার পাশাপাশি সামাজিক, সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে অংশ নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়। তাছাড়া ও সাংস্কৃতিক সংগঠন গুলোর সাথে রাজনৈতিক সংগঠনসমূহের ইতিবাচক মনোভাব এখানটার সাংস্কৃতিক কর্মযজ্ঞে সহায়ক হিসেবে একটি অনন্য উদাহরণ। যেটা শান্তিপূর্ণ ক্যাম্পাস গঠনে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়ই।

অধ্যক্ষ আরো বলেন, বাংলাদেশের মধ্যে সিলেটকে শান্তির শহর হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সিলেটের মানুষ দেশের অন্যান্য জেলার মানুষের চেয়ে অনেক বেশি আন্তরিকতাপূর্ণ হয়ে থাকেন। নতুন শিক্ষার্থী ভর্তি হওয়ার ক্ষেত্রে যেগুলো অভিভাবকদের ভাবনামুক্ত রাখে।

কলেজটির বিগত সময়ের গৌরবগাঁথা অর্জনগুলো উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই ইতিবাচক বিষয় গুলো এমসি কলেজে বিদ্যমান থাকার ফলে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি অভিভাবকরা ও তাদের সন্তানদের এখানে পড়াতে বেশ আগ্রহ দেখান।

সিলেটভিউ২৪ডটকম/১২ সেপ্টেম্বর ২০১৯/এএ/পিডি

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন