আজ শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ইং

সিলেটে ১০ কোটি টাকার জমি: ঢাকঢোলে উদ্ধার, নিরবেই ফেরত!

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৯-১১-১২ ০০:৩৯:০০

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক :: দিনটি ছিল চলতি বছরের ২১ জুলাই। স্থান সিলেট নগরীর শেখঘাট খুলিয়াপাড়া। সিলেট সিটি করপোরেশনের (সিসিক) আটজন কাউন্সিলর, দুইজন কর্মকর্তা এবং অন্তত পাঁচজন পুলিশ কর্মকর্তাকে সাথে নিয়ে হাজির মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। খবর পেয়ে সংবাদমাধ্যমকর্মীরাও হাজির। আরিফের নেতৃত্বে মহাসমারোহে ওই এলাকা থেকে ‘উদ্ধার’ করা হয় প্রায় ৩৭ শতাংশ জমি; যেটির মূল্য প্রায় ১০ কোটি টাকা। কিন্তু ‘উদ্ধারকৃত’ সেই জমি নিরবেই মালিক পক্ষকে সমঝিয়ে দিয়েছে সিসিক।

‘উদ্ধার’ অভিযানের সময় সিসিকের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল, শেখঘাট খুলিয়াপাড়া মিউনিসিপালিটি মৌজার জে এল নং-৯১ এর ৩৭৫১ ও ৩৭৫২নং দাগে প্রায় ৩৭ শতক জমির মালিক সিলেট সিটি করপোরেশন (সিসিক)। ১৯৪৭ সালে তৎকালীন মিউনিসিপালিটি কর্তৃপক্ষ জমিটি ওই এলাকার জনৈক এক ব্যক্তিকে শর্তসাপেক্ষে লিজ দেয়। প্রায় ৭২ বছর পর এই মূল্যবান জমি ‘দখল’ থেকে উদ্ধার করা হলো।

ওই সময় মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী বলেছিলেন, ‘সিসিকের মালিকানাধীন প্রায় ৩৭ শতক জমি স্থানীয় কতিপয় প্রভাবশালীদের দখলে ছিল। জমি দখল করে এখানে ঘর-বাড়ি, দোকানপাট নির্মাণ করা হয়েছিল। দখলে নেওয়া সিসিকের জমি ছাড়তে দখলদারদের বার বার নোটিস দিলেও তাতে কোন কাজ না হওয়ায় এ অভিযান চালানো হয়।’

ওই জমি ‘উদ্ধার’ করে সিসিক সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দেয়। পরে জমির চারপাশে দেয়াল তুলে সেখানে ওয়্যার হাউজ (গুদামঘর) নির্মাণ করে সিসিক।

জানা গেছে, ওই জমি মালিকানার বিষয়টি আদালতে বিচারাধীন ছিল। এরকম অবস্থায়ই জমি ‘উদ্ধার’ করে সিসিক। কিন্তু পরবর্তীতে জমির মালিকপক্ষ বিষয়টি আদালতের দৃষ্টিতে আনে। আদালত ওই জমি মালিকপক্ষকে সমঝিয়ে দিতে সিসিক মেয়রকে নির্দেশ দেন। সোমবার (১১) সকালে ওই জমিতে ওয়্যার হাউজে থাকা নিজেদের জিনিসপত্র সরিয়ে নেয় সিসিক। পরে জমি সমঝে নেন মালিপক্ষ মরহুম সফিউর রহমান চৌধুরীর উত্তরাধিকারীরা। ওই সময় স্থানীয় ১৩নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর শান্তনু দত্ত সনতু উপস্থিত ছিলেন।

ভূমির মালিক মরহুম সফিউর রহমান চৌধুরীর ছেলে হুমায়ুন কবির চৌধুরী জানান, শেখঘাট খুলিয়াপাড়া মিউনিসিপ্যালিটি মৌজার জে এল নং-৯১ এর ৩৭৫১ ও ৩৭৫২নং দাগে মোট ৩৭ শতক জমির প্রকৃত মালিক তারা। বাবার ক্রয়সূত্রে তারা এ জমির উত্তরাধিকারী হন।

তিনি জানান, ১৯২৮ সালে যুগেশ ব্যানার্জী নামের এক ব্যক্তি তৎকালীন মিউনিসিপ্যালিটি থেকে ২০ বছরের জন্য এ ভূমি লিজ আনেন। তিনি মারা গেলে এর উত্তরাধিকারী হন তার ছেলে সুধাংশু ব্যানার্জী। ১৯৪৭ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার ‘টাউন ট্যালেন্স অ্যাক্ট’ ঘোষণা করে। এ আইনে বলা হয়, যে যেখানে আছেন তিনিই ওই ভূমির মালিক। ফলে সুধাংশু ব্যানার্জী আইনগতভাবে মালিকানা লাভ করেন।

হুমায়ুন কবির চৌধুরী আরো জানান, সুধাংশু ব্যানার্জীর কাছে ৫ হাজার টাকা পেতেন সফিউর রহমান চৌধুরী। দেশ ভাগের পর সুধাংশু চলে যান ভারতে। পরে টাকা চেয়ে সফিউর রহমান চিঠি দেন সুধাংশুকে। ফিরতি চিঠিতে সুধাংশু বলেন, তিনি যদি টাকা দিতে না পারেন, তবে দেশে তার যে জায়গা (ওই ৩৭ শতাংশ) আছে, তা সফিউর রহমানের হয়ে যাবে। সুধাংশু দেশে ফিরেননি, টাকাও ফেরত দেননি। সফিউর রহমান ১৯৪৯ সালে তৎকালীন ভারতের আদালতে মামলা করেন। ১৯৫৩ সালে ওই ভূমি সফিউর রহমানকে সমঝিয়ে দিতে রায় দেন আদালত। ১৯৫৬ সালে তার নামে এ জমির রেকর্ড হয়।

সফিউর রহমান চৌধুরীর ছেলে জানান, ১৯৮৬ সালে তৎকালীন পৌরসভা জমি উদ্ধারের মামলা করে। ১৯৯০ সালে আদালত সফিউর রহমানের পক্ষে রায় দেয়। ২০০২ সালে তৎকালীন পৌরসভা উচ্চ আদালতে জমি উদ্ধারের জন্য আপিল করে। পরে উচ্চ আদালত আদেশ দেন, এ জমি নিয়ে সিআর নং ৬৫১৬/০২ মোকদ্দমা বিচারাধীন এবং এটি নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত মালিকানার বিষয়ে স্থগিতাদেশ বহাল থাকবে।

হুমায়ুন কবির চৌধুরী জানান, উচ্চ আদালতের পরবর্তী কোনো আদেশ না নিয়েই এবং মালিক পক্ষকে কোনো নোটিস না দিয়েই গেল ২১ জুলাই এ জমি উদ্ধার করে সিসিক। পরে ২৪ জুলাই মালিকপক্ষের আইনজীবী মঞ্জুর আল মতিন সিসিক মেয়রকে কারণ দর্শানোর নোটিস দেন। মেয়র নোটিসের জবাব দেননি। বিষয়টি উচ্চ আদালতের নজরে আনা হলে মেয়রকে শোকজ করেন আদালত এবং জমিটি প্রকৃত মালিককে সমঝিয়ে দিয়ে আদালতে হাজির হতে নির্দেশ দেন। এ প্রেক্ষিতেই সোমবার জমিটি সমঝিয়ে দেওয়া হয়।

এ ব্যাপারে কথা বলতে সিসিক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীর ব্যক্তিগত মোবাইল ফোনে কয়েক দফায় কল করা হলেও সেটি বন্ধ পাওয়া যায়।

সিলেটভিউ২৪ডটকম/১২ নভেম্বর ২০১৯/আরআই-কে

@

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন