আজ বুধবার, ১৭ এপ্রিল ২০২৪ ইং

সিলেটে ডাক্তার দেখাতে যুদ্ধ লাগে!

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০২০-০২-২৬ ১৬:১৫:৪৩

মো. রেজাউল হক ডালিম :: কয়েক দিন থেকে শরীরটা ভালো যাচ্ছে না সিলেটের দক্ষিণ সুরমার মিনা বেগম নামের এক গৃহিনীর। বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ নেবেন এই উদ্দেশ্যে ৩ দিন ধরে সিলেট স্টেডিয়াম মার্কেটের একজন ডাক্তারের টিকিটের জন্য নির্ধারিত মোবাইল ফোন নাম্বারে নির্দিষ্ট সময়ে ডায়াল করেন, কিন্তু একটা দিনও ওই নাম্বারে কল ঢুকাতে পারেননি। কল করার জন্য নির্ধারিত থাকা মাত্র এক ঘন্টার ভেতরে তিনি প্রায় প্রতিটি সেকেন্ডে ডায়াল করে ওই নাম্বারটি ব্যস্ত পেয়েছেন। কোনোভাবেই কল ঢুকেনি। আর এক ঘণ্টা পর নাম্বারটাই বন্ধ। সারাদিনই আর খোলা পাওয়া যায়নি। সন্ধ্যা পর ওই নাম্বারে কল ঢুকলেও টিকিট দেয়ার দায়িত্বে থাকা লোক মিনা বেগমকে ধমক দিয়ে বললেন- \\\'টিকিটের জন্য এখন ফোন দিছেন কোন আক্কেলে? সকালে কল করতে পারেন না? টিকিটের জন্য প্রতিদিন সকালে ৮ টা থেকে ৯টার মধ্যে কল করবেন।\\\'

এমন ঘটনা শুধু দক্ষিণ সুরমার মিনা বেগমের সঙ্গেই ঘটছে না, সিলেটে প্রতিদিনই ডাক্তার দেখাতে ইচ্ছুক হাজার হাজার নারী-পুরুষের সঙ্গে ঘটছে এমন চরম অমানবিক ঘটনা।  বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের টিকিট সংগ্রহ করতে গিয়ে সিলেটবাসীকে  পোহাতে হয় চরম ভোগান্তি। অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে টিকিট সংগ্রহ করলেও ডাক্তার পর্যন্ত পৌঁছতে রোগীরা পদে পদে আরও বিভিন্নভাবে হয়রানি আর ভোগান্তির শিকার হন। ভুক্তভোগী ও সচেতন মহলের প্রশ্ন- সিলেটে এই বিষয়গুলো দেখার বা তদারকির কেউ নেই?

মোবাইল ফোনে টিকিট সংগ্রহে ভোগান্তি ::
সিলেটের বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজ, ডায়াগনেস্টিক সেন্টার, রোগী দেখার আউটডোরবিশিষ্ট হাসপাতাল, স্টেডিয়াম মার্কেটসহ যেসব স্থানে ডাক্তাররা প্রাইভেট রোগী দেখেন সেই স্থানগুলোতে বিভিন্ন রোগের সংশ্লিষ্ট বিভাগের বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের অভাব না থাকলেও ডাক্তারের টিকিট সংগ্রহের ক্ষেত্রে চরম হয়রানির শিকার হন মানুষ। টিকিট প্রদানের বেলায় ডাক্তারদের অদ্ভূত এবং অবিবেচিত নিয়মের কারণে শুধু লোকজন হয়রানির শিকারই হন না, রোগীরা ভোগেন সীমাহীন কষ্ট-যন্ত্রণায়। 

ভুক্তভোগীদের অভিযোগ- সিলেটে সকল বিভাগেরই বেশিরভাগ ডাক্তারের টিকিট এখন দেয়া হয় মোবাইল ফোনকলের মাধ্যমে। কল করার সময় থাকে সকালে মাত্র এক ঘণ্টা বা আধা ঘণ্টা। কিন্তু এক ঘণ্টা বা আধা ঘণ্টার ভেতরে রোগী বা তার অভিভাবকরা ফোনে কল ঢুকাতে পারেন না কিছুতেই। কারণ- সবাই চান নিজেকে বা নিজের রোগীকে দেখাতে।  তাই একের পর এক বিরামহীন নির্দিষ্ট নাম্বারে কল আসতেই থাকে। এর ফলে অনেক সময় মুমূর্ষু  রোগীরা বঞ্চিত হন একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সেবা থেকে। এছাড়াও অনেক সময় রোগীর জীবন পর্যন্ত হয়ে পড়ে সঙ্কটাপন্ন।

ডাক্তারের এ্যাটেনডেন্টরা টাকার বিনিময়ে অনিয়ম করেন সিরিয়ালে :
ডাক্তার দেখাতে আসা বেশিরভাগ মানুষের অভিযোগ- যথাসময়ে যথানিয়মে টিকিট না নিয়েও অনেকে সংশ্লিষ্ট ডাক্তারের অসাধু এ্যাটেনডেন্টদের কাছ থেকে টাকার বিনিময়ে টিকিটের ব্যবস্থা করে নেন। এতে বিপাকে পড়েন সিরিয়ালে থাকা  রোগীরা। ডাক্তার দেখাতে বিলম্ব হয় নিয়ম মেনে টিকিটের সিরিয়াল নেয়া রোগীদের, কষ্টে ভোগেন তারা।

গত সোমবার এমন হয়রানির শিকার হলেন গোলাপগঞ্জের এক মহিলা রোগী। সিলেট স্টেডিয়াম মার্কেটে পাকস্থলী বিশেষজ্ঞ একজন ডাক্তারকে দেখাতে সকালে ফোনে বহুবার চেষ্টা করে ১৩ নাম্বার টিকিট সংগ্রহ করেন গোলাপগঞ্জ উপজেলার আমুড়ার হালিমা বেগম। তাকে বলা হয়- \\\'সন্ধ্যা ৭টায় আসলে ডাক্তার দেখাতে পারবেন।\\\' হালিমা বেগম সাড়ে ৬টায় ডাক্তারের চেম্বারে চলে আসলেও তিনি ডাক্তার দেখান রাত সাড়ে ৯টায়। তার আগে এ্যাটেনডেন্ট টাকার বিনিময়ে সিরিয়াল না নিয়ে আসা অন্তত: ৫ জন রোগীকে অনিয়ম করে ডাক্তারের চেম্বারে ঢুকিয়েছেন- এমন অভিযোগ হালিমার।

ওই দিন স্টেডিয়াম মার্কেটে ডাক্তার দেখাতে আসা অনেকেই জানান, এ্যাটেনডেন্টরা ভূয়া নামে ৮/১০টা টিকিট রেখে দেয়। যারা নিয়মমতো টিকিট নেয়, তাদের ৮/১০ জনের পর থেকে সিরিয়াল দেয়া হয়। পরে টাকার বিনিময়ে ওই ভূয়া নামের টিকিটগুলো বিক্রি করেন এ্যাটেনডেন্টরা। 


এক-দেড় মাস আগে টিকিট :
সিলেটে কয়েকজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার আছেন, যাদের টিকিট এক-দেড় মাস আগে সংগ্রহ করতে হয়। অনেক সময় এত আগে টিকিট নিয়েও ডাক্তার দেখাতে পারেন না রোগীরা। বিষয়টি চরম অমানবিক ও অযৌক্তিক বলে মন্তব্য করছেন সংশ্লিষ্টরা। এক-দেড় মাস আগে টিকিট দেয়া ডাক্তারদের মধ্যে সিলেটের নিউরোলজি বিশেষজ্ঞ ডা. মতিউর রহমান, হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. খালেদ মহসিন এবং হৃদরোগ ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. শিশির বসাক অন্যতম। অনেকের অভিযোগ- এদের টিকিট এক-দেড় মাসে আগে সংগ্রহ করেও রোগী দেখানোর নিশ্চয়তা থাকে না।

\\\'বিএমএ\\\' সিলেট শাখার সভাপতির মন্তব্য :
বাংলাদেশের চিকিৎসা পেশাজীবীদের জাতীয় সংগঠন বাংলাদেশ মেডিকেল এ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ)-এর  সিলেট শাখার সভাপতি প্রফেসর ডা. রুকন উদ্দিন আহমদ সার্বিক বিষয়ে সিলেটভিউ২৪-কে বলেন, এসব নিয়ে আসলে সবার সচেতনতা প্রয়োজন। ফোনে টিকিট দেয়ার ক্ষেত্রে ডাক্তাররা মানুষের সুবিধাটাকেই যুক্তি হিসেবে উপস্থাপন করেন। বেশিরভাগ এ্যাটেনডেন্ট টাকার বিনিময়ে সিরিয়াল আগ-পিছ করেন বিষয়টি মেনে নিয়ে তিনি বলেন, এ্যাটেনডেন্টরা এ সমাজেরই মানুষ। ডাক্তাররা কী করবে বলুন, এই দোষে একজন বিদায় করলে পরবর্তীজনও কিছুদিন পরে এটা শুরু করে দেয়। এ বিষয়ে যারা রোগী দেখাতে আসনে- তাদেরও নৈতিকতা থাকতে হবে। এখন রোগীর স্বজন যদি এ্যাটেনডেন্টকে টাকা দিয়ে সিরিয়াল আগে নিতে চান সেটাও তো অন্যায়।
এক-দেড় মাস আগে টিকিট দেয়ার বিষয়ে বিএমএ-এর  সিলেট সভাপতি বলেন, এটা হয়তো তারা রোগীর চাপ কমাতে করে থাকেন।

‘সুজন’ যা বলছে :
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)-এর সিলেট জেলা কমিটির সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী সিলেটভিউ২৪-কে বলেন,  ফোনে টিকিট দেয়ার নামে যে হয়রানি করা হয় সে বিষয়ে আমি অবগত। কয়েকদিন আগে আমার এক আত্মীয় একঘণ্টায় ১২৫ বার কল দিয়েও তিনি একজন ডাক্তারের টিকিট সংগ্রহ করতে পারেননি। এ ক্ষেত্রে আমি মনে করি- সিলেটের ডাক্তারগণকে ঢাকার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের ফলো করা উচিৎ। ঢাকার বড় বড় ডাক্তারের টিকিট সংগ্রহের ফোন নাম্বার অফিসিয়াল সময় খোলা পাওয়া যায়। টিকিট নিতে লোকজন ফোনে কল করলে ওই দিনের টিকিট শেষ হয়ে গেলে ধারাবাহিকভাবে পরবর্তী দিনগুলোর সময় উল্লেখপূর্বক পুরো এক সপ্তাহের টিকিট দেয়া হয়। এ পদ্ধতি অনুরসণ করলে মনে হয় মানুষের ভোগান্তি কমবে। 

টাকার বিনিময়ে সিরিয়াল আগ-পিছ করা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এটি ঠিক নয়। এ ক্ষেত্রে সবার আগে ডাক্তারদেরই পদক্ষেপ নিতে হবে। নিজেদের এ্যাটেনডেন্টরা যাতে মানুষের সঙ্গে এমন দুর্ব্যবহার করতে না পারে সেজন্য ওদেরকে কঠোর নজরদারিতে রাখতে পারেন ডাক্তাররা।  প্রয়োজনে চেম্বারের সামনে এ বিষয়ক একটি অভিযোগ বক্সও রাখতে পারেন তারা। শুধু রাখলেই হবে না, ফ্রি সময়ে বক্স খুলে অভিযোগের সত্যতা পেলে এ্যাটেনডেন্টদের বিরুদ্ধে যেন ব্যবস্থা নেন ডাক্তাররা।

এক মাস টিকিট দেয়ার বিষয়ে ফারুক মাহমুদ চৌধুরী বলেন, এর কোনো যুক্তি নেই। রোগে মানুষ কষ্ট পাচ্ছে- এই অবস্থায় এক মাস পরের টিকিট দিয়ে রোগী কী করবে? আমি মনে করি, মানবিতকতা আর স্বচ্ছতার তাগিদে এমন অবস্থা থেকে ডাক্তারদের সরে আসা প্রয়োজন। চিকিৎসার বিষয়টাকে তো শুধু বাণিজ্যিক দৃষ্টিতে দেখলে চলবে না।  এটি একটি সেবার ক্ষেত্রও। মানুষকে যদি সেবা দিতে গিয়ে যদি কষ্ট দেন, তবে তো সেটা আর সেবা থাকলো না।  তিনি বলেন, যত বড় ডাক্তারই হোন- যেদিন রোগী দেখবেন ওই দিনই যাতে মানুষ টিকিট নিতে পারেন সেই ব্যবস্থা করাই হবে মানবিক।

সিলেটের সিভিল সার্জন যা বললেন :
সিলেট সিভিল সার্জন কার্যালয়ের সিভিল সার্জন ডা. প্রেমানন্দ মন্ডল সিলেটভিউ২৪-কে বলেন, বিষয়গুলোকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে হবে। এসব ক্ষেত্রে সরকারি কোনো নির্দিষ্ট নীতিমালা না থাকায় অনেক ডাক্তার যা ইচ্ছা তাই করেন। তিনি বলেন, ফোনে টিকিট দেয়ার কোনো বৈধতাও নেই- অবৈধতাও নেই।  মানুষের সুবিধার্তে যেটা করা প্রয়োজন সেটাই করতে হবে। সেবার নামে হয়রানি করা যাবে না। 
অনেক আগে টিকিট দেয়ার ব্যাপারে তিনি বললেন- এটা খুবই অমানবিক। এটার কোনো যুক্তি নেই।  তবে এ বিষয়ে সরকারি কোনো নীতিমালা নেই বলেই এমনটি করার সুযোগ পান ডাক্তাররা। 

এ্যাটেনডেন্টদের অনিয়মের বিষয়ে সিভিল সার্জন বলেন, এ ক্ষেত্রে দু\\\'পক্ষেরই দোষ আছে। যারা ঘুষ দিয়ে সিরিয়াল আগে নিতে চায়, আর যারা ঘুষ নিয়ে সিরিয়াল এগিয়ে দেয় উভয়েই দোষী।  
সবশেষে তিনি বললেন, সবাইকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে সচেতন হতে হবে এবং অনৈতিকতাকে বর্জন করতে হবে।   সর্বোপরি সরকারের সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে আইন করে পদক্ষেপ নিতে হবে। তিনি বলেন, আমরা আমাদের পক্ষ থেকেও কী করা যায় দেখছি।

বিভাগীয় পরিচালক (স্বাস্থ্য)-এর বক্তব্য :
সিলেট বিভাগীয় পরিচালক (স্বাস্থ্য) ডা. দেবপদ রায় সিলেটভিউ২৪-কে বলেন, বিষয়গুলো নিয়ে আমি দ্রুত সিলেটের সিভিল সার্জনের সঙ্গে বসবো এবং কী করা যায় তা নিয়ে আলোচনা করবো।

সিলেটভিউ২৪ডটকম/২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২০/ডালিম

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন