আজ বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ইং

সিলেটে রাস্তার মোড়ে জীবিকার অন্বেষা

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০২০-০২-২৯ ০৯:৪৩:৫৯

মো. রেজাউল হক ডালিম :: এক হাতে কোদাল। আরেক হাতে টুকরি। রাস্তার মোঁড়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা। একসময় কেউ একজন এসে নিয়ে যায় সারাদিনের জন্য দর কষে। গোধূলিবেলায় ওদের মজুরি (পারিশ্রমিক) কাজ ও বয়েসভেদে ৩-৫শ’ টাকা। একদিন কাজ না পেলে অন্ন জুটে না পরিবারের সদস্যদের। এটাই ওদের জীবন-জীবিকার দৈনন্দিন গথবাধা ছক।

ওরা শ্রমিক- দিনমজুর। নারী-পুরুষ ভেদাভেদ নেই। ঘুম ভাঙে রাত শেষে পূর্বাকাশে সুর্যের আগমনী লালিমার রঙ ফোটার আগেই। শুরু হয় কোদাল (মাটি কোপানোর অস্ত্রবিশেষ) আর টুকরি (মাটি/পাথর বহনের ঝুড়ি) নিয়ে ঘাম না শুকানো জীবনের আরেকটি দিন। ঝড়-তোফান-কালবৈশাখি কিংবা হাঁড়কাপানো শীত, সব উপেক্ষা করে কাকডাকা ভোরে কোদাল-টুকরি নিয়ে ঠাই নিতে হয় সিলেট শহরের কোনো ব্যস্ত রাস্তার মোড়ে- জীবিকার অন্মেষায়।

গতকাল শুক্রবার (২৮ ফেব্রুয়ারি) সরেজমিনে দেখা গেছে, প্রতিদিনের মতো শুক্রবারও সাতসকালে সিলেট নগরীর বন্দরবাজার, জেলরোড পয়েন্ট,  শিবগঞ্জ, টিলাগড়, মেজরটিলা, আম্বরখানা, চৌহাট্টা, রিকাবিবাজার, মদিনামার্কেট, টুকেরবাজার, ওসমানী মেডিক্যাল কলেজের সম্মুখ, শাজালাল উপশহর, হুমায়ুন চত্বর, শাহপরাণ গেইটসহ মোড়ে ভিড় জমেছে দিনমজুরদের। একেক রাস্তার মোড়ে ৭০-৮০ জন শ্রমিক লাইন ধরে কোদাল-টুকরি বসে আছেন- মানুষ এসে কাজে নিয়ে যাবে এই প্রত্যাশায়। শ্রমিকরা জানান, দুপুর পর্যন্ত চলে এ অপেক্ষার পালা।

কাজের সন্ধানে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থাকা এসব শ্রমিকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে- এদের বেশিরভাগই মাটিকাটা, পাথর বহন ও রাজমিস্ত্রীর সহকারীর (জোগালি) কাজ করে থাকেন। নারী শ্রমিকদের পুরুষালী কাজ ছাড়াও ঘরকন্যা এবং সামাজিক বিভিন্ন আপ্যায়ন অনুষ্ঠানে ধোয়া-মুছার কাজে নিয়ে যায় মানুষ। এসব ছাড়াও সামর্থ অনুযায়ী যে কোনো কাজ করেন পুরুষ-নারী শ্রমিকরা। জোয়ান-বুড়ো মানুষ এবং কঠিন-হালকা কাজভেদে দিনশেষে এসব মজুরদের মজুরি (পারিশ্রমিক) হয় ৩ থেকে ৫ শ’টাকা। যারা কাজে নেন তারা আধাবেলা গড়িয়ে গেলে খাবার দেন একবার। সকালবেলা নেওয়ার পর কেউ চা-নাস্তা দেন, আবার কেউ দেন না।

জেল রোড পয়েন্টে দাঁড়িয়ে থাকা আবু বক্কর নামের এক দিনমজুর এ প্রতিবেদককে বলেন, কাজও জুটে না অনেক দিন। সেদিন রিক্ত হস্তে ফিরে যেতে হয় বাসায়। কাজের সন্ধানে বেরোনোর যাতায়াত খরচটাও থাকে লসের (ক্ষতির) হিসাবে। বাসায় ফেরার সময় হাতে করে কিছু নিয়ে যেতে না পারার জন্য পরিবারের সদস্যদের মুখ থাকে মলিন, রাতটুকু কাটাতে হয় কষ্টেসৃষ্টে।

এদের বেশিরভাগই সিলেটের বাইরের অন্যান্য জেলার মানুষ। সিলেট নগর কিংবা শহরতলির বিভিন্ন স্থানে কলোনি আর ছোট খুপড়ি ভাড়া করে থাকেন দিনের পর দিন মানবেতর অবস্থায়। কেউ থাকেন একা, কেউবা পরিবার-পরিজন নিয়ে। দৈননিন্দন চাহিদার তুলনায় কম ওই পারিশ্রমিক দিয়েই করতে হয় প্রতিদিনের চাল-ডালের বন্দোবস্ত, সন্তান লালন-পালনসহ অনেকের অসুস্থ মা-বাবার চিকিৎসার ব্যয়ভারও বহন করতে হয় ওই টাকায়। মাস শেষে ঘরভাড়া দিতে হয় পেটে অন্ন- পরিধানে বস্ত্র থাকুক না থাকুক। জীবন চালাতে রীতিমতো তারা হিমশিম খান এই পারিশ্রমিকে।

জিতু মিয়ার পয়েন্টে থাকা শাহিন আহমদ নামের এক শ্রমিক বলেন, এছাড়াও রয়েছে বিভিন্ন বিড়ম্বনা। অনেক মানুষ যে পারিশ্রমিক নির্ধারণ করে কাজে নেন দিনশেষে সে কথা রাখেন না। ‘কম কাজের অজুহাত’ দেখিয়ে অর্ধেক কিংবা তারচেয়েও কম টাকা দিয়ে হুমকি-ধমকি দিয়ে শ্রমিক বিদায় করে দেন। অনেক সময় শারীরিক নির্যাতনও জুটে ওদের পোড়া কপালে।

নগরের জিতু মিয়ার পয়েন্টে দাঁড়িয়ে কাজ খুঁজতে আসা আব্দুল মালেক জানান, ‘মামা, আমরা গরিবদের কথা কি আর কেউ জানতে চায়? যারা কাজে নেয় তারা অনেকে ভালো মানুষ। আবার অনেকেই বাজে মানুষ। সারাদিন বলদের মতো খাটিয়ে নির্ধারিত পারিশ্রমিক না দিয়ে উল্টো ধমক দিয়ে বিদায় করে দেয়। আমরা দুর্বল মানুষ বিধায় কাউকে কিছু বলতে পারি না।’ মালেক জানান, শহরতলির টুকেরবাজারে মা-বাবা ও ভাই-বোন নিয়ে থাকেন। পরিবারে একমাত্র মালেকই উপার্জনকারী। তার বাবা বেশ কয়েকটি জটিল রোগে আক্রান্ত। অর্জিত টাকার সিংহভাগই খরচ হয়ে যায় বাবার চিকিৎসাবাবদ। বাকি টাকা দিয়ে একবেলা- আধাবেলা খেয়ে কোনোমতো চলে তার ৭ সদস্যের পরিবার।

আজাদ মিয়া নামে আরেকজন জানান, ‘সহজেই কাজ মেলে না। তার উপর প্রতি পয়েন্টে আমাদের মধ্যে ঠিকাদার গোছের কয়েকজন থাকে। তারা দর-দাম ঠিক করে দেয়। তাদের কমিশনও দিতে হয়।’

এমন কমিশনগ্রহীতা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজনের সাথে কথা বললে তিনি জানান, ‘‘আমরা যে এলাকায় থাকি সে এলাকার কিছু ‘বড় ভাইদের’ নিয়মিত ‘কিছু’ দিতে হয়। সেজন্যই সবার কাছ থেকে সামান্য হারে টাকা নেই। আর তাছাড়া অনেক শ্রমিক ঠিকমতো কথা বলে পারিশ্রমিক নির্ধারণ করতে পারে না। মানুষ তাদের ঠকায়। তাই আমরা কথা-টথা বলে মজুরি ঠিক করে দেই- বিনিময়ে তারা ‘খুশি হয়ে’ আমাকে কিছু টাকা দেয়।’’

শাহজালাল উপশহর পয়েন্টে আসা নারী শ্রমিক সুফিয়া বেগম জানান, ‘আমরা মাইয়া মানুষ বলে আমাদের মজুরি থাকে কম। যদিও অনেক পুরুষ থেকে আমরা কাজ করি অনেক বেশি। তার উপর মালিকরা (যারা কাজে নেয়) নারী শ্রমিকদের সাথে দুর্ব্যবহার করে মাঝে-মধ্যে। অনেক সময় শরীরেও হাত উঠায়। তবে যাদের স্বামী সাথে যায় তাদের সঙ্গে তেমন আচরণ করা হয় না। 

এতসব প্রতিকুলতা পেরিয়ে এভাবেই ভাগ্যের জীর্ণ পাতায় লিপিবদ্ধ হয় রাস্তার মোড়ে জীবিকার অন্মেষণে দাঁড়িয়ে থাকা নারী-পুরুষ দিনমজুর মানুষগুলোর জীবন সংগ্রামের একেকটি সকাল- প্রত্যেকটি দিন।

সিলেটভিউ২৪ডটকম/২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০/আরএইচডি/মিআচৌ

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন