আজ শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ ইং

সিলেট শহরে হারিয়ে যাওয়া জলাধারের করুণ কাহিনী

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০২১-০৪-০৮ ২২:২৩:০৮

কৃষ্ণ পদ সেন :: আমার প্রাণের শহর, আমার স্মৃতির শহর আমার হারিয়ে যাওয়া শৈশব, কৈশোর আর যৌবনের শহর, সিলেট শহর। এই স্মৃতিময় শহরকে ক্ষত বিক্ষত করে এর স্বাভাবিক সৌন্দর্যকে ব্যবচ্ছেদ করা হয়েছে, তারই সৌন্দর্যবর্ধনের নাম করে। এ যেন প্লাস্টিক সার্জারির নামে মেডিক্যাল সায়েন্স যেভাবে একটা চেহারা বদলে দেওয়া হচ্ছে, ঠিক সেভাবেই।

আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে যারা এই সিলেট শহরে  বাস করতেন, তাঁরাই সঠিক শুদ্ধভাবে বলতে পারবেন, কতটা পরিচ্ছন্ন আর স্বাস্থ্যকর ছিল এই সিলেটের সামগ্রিক পরিবেশ। সুরমা নদীর কূল ঘেঁষে গড়ে উঠা এই প্রাচীন শহরটা কতটা আকর্ষণীয় ছিল। শহরতলীর পাহাড় টিলা পরিবেষ্টিত চা-বাগানে ঘেরা মুক্ত মাতাল হাওয়ার অবাধ বিচরণ ভূমি ছিল এই শহর। পাহাড় টিলা থেকে জন্ম নেয়া ছোট ছোট স্রোতের ধারা ভালবাসা আর মমতায় জড়িয়ে আঁকাবাকা পথে শহরকে বুকে যেন আলগে রেখেছিল আপন সন্তানের মত করে। সেই গোয়ালীছড়া, মালিনীছড়া ইত্যাদি সেই স্রোতস্বিনীরা আজ বিস্মৃতির অন্তরালে।

আর ছিল প্রচুর জলাধার বা জলাশয়। ছিল মনুষ্যনির্মিত প্রচুর দিঘি। এই জলাশয় আর দিঘিগুলো আজ ইতিহাস। ভবিষ্যতের প্রজন্ম জানতেই পারবে না, কোথায় এই জলাশয় আর দিঘিগুলোর অবস্থান ছিল।

দক্ষিণ সুরমা থেকে কিন ব্রীজ দিয়ে শহরে প্রবেশ করলে হাতের ডান দিকে যে জালালাবাদ পার্ক এবং সংলগ্ন জেলা পরিষদের ভবনটির অবস্থান, সেখানে এক সময় বাঁকা (সিলেটি ভাষায় বেকা দিঘি) নামে একটা দিঘির অস্তিত্ব ছিল। পাকিস্তান আমলের প্রথম দিকে দিঘিটা ভরাট করে দেওয়া হয়। তখন সেখানে শহরের বেশির ভাগ রাজনৈতিক সভা সমাবেশ এই বাঁকা দিঘির ময়দানে অনুষ্ঠিত হতো। যা বর্তমান প্রজন্মের জানার বাইরে।

কিন ব্রীজ থেকে নেমে ডান দিকে মোড় নিলে রাস্তা চলে গেছে বন্দর বাজার এলাকায়। আর বামদিকে মোড় নিয়ে খানিকটা এগিয়ে গেলে দেখতে পাওয়া যাবে, আপন অস্তিত্ব নিয়ে দাড়িয়ে আছে বিশাল ভবন। বাংলাদেশ ব্যাংক। এখানে এক সময় একটা বিশাল দিঘি ছিল। নাম ছিল তার তালদিঘি। আর এলাকার নাম ছিল তালতলা। শহরের বিশেষ করে এলাকার শিশু কিশোরদের বিনোদনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল এই তালদিঘি। এখানে সাঁতার শিখেছেন সেই সময়ের এলাকার শিশু কিশোররা। আজ সবই তাদের কাছে হারিয়ে যাওয়া ধূসর অতীত।

আরো একটু এগিয়ে যাই। গুলশান হোটেলের সামনে রাস্তা তিনমুখী, অর্থাৎ ডানে বামে আর সোজা। যদি সোজা চলেন তবে হয়তো বা চোখে পড়বে বুঁজে যাওয়া দুটি দিঘির ধ্বংসাবশেষ। মাছুদিঘি আর রামেরদিঘি। এই রাস্তায় আরো একটু এগোলেই মির্জাজাঙ্গাল  পয়েন্ট। বামে এগিয়ে গেলেই নিম্বার্ক আশ্রম। এককালে এই আশ্রমের পেছনে ছিল বিরাট এক দিঘি। এখন সেখানে কংক্রিটের দালান কোঠা। এই দাড়িয়াপাড়াতে  আরও অনেক পুকুরের অস্তিত্ব ছিল। নগরায়নের ধামাকায় এগুলো আজ বিলুপ্ত।

ছিল শহরের প্রাণ কেন্দ্রে লালদিঘি বা নবাব তালাব। বৃটিশ আমলের দলিল দস্তাবেজে এটাকে নবাব তালাব বলে রেকর্ড করা আছে। পরবর্তীতে এটা লালদিঘি নামে পরিচিতি লাভ করে। এই দিঘির দুই পাশে ছিল শহরের দুটি স্কুল। সিলেট পাইলট বয়েজ স্কুল আর রাজা গিরিশ চন্দ্র হাই স্কুল। এই দুটি বিদ্যালয়ের হাজার হাজার ছাত্রের শৈশব কৈশোরের স্মৃতি মাখা এই দিঘিটি আজ হারিয়ে গেছে। শুধু কোন এক অতীতের হারিয়ে যাওয়া স্মৃতি হয়ে কোন বৃদ্ধ বা প্রৌঢ়ের মানসপটে জীবনের অলস মুহূর্তে আলোর ঝলকানির মত ছুঁয়ে যাবে।হারিয়ে গেছে চালিবন্দর কাষ্টঘর মোড়ের সেই সরকারি পুকুরটি। যেখানে এই দুই মহল্লার ছেলেরা সাঁতার শিখেছেন। স্কুল ছুটির দিনে এই পুকুরটি ছিল সেই সময়ের বিনোদনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। আমি বা আমার মত যারা এই এলাকায় জন্ম বা বেড়ে উঠেছি, এই পুকুরটি আমাদের জীবনের এক অবিনাশী অঙ্গ হয়ে আছে।

ছিল জয়নগর, যতরপুরের দিঘিগুলো। জয়নগরের দিঘিটি মৃত প্রায়। শুনেছি এটা নাকি শরিকি সম্পত্তি। তবে যতরপুরের দিঘিটি এলাকার নাগরিকদের যত্ন আর পরিচর্যায় আকর্ষণীয় হয়েছে। এরজন্য এলাকার নাগরিকদের ধন্যবাদ জানাই।

এই শহরে কতগুলো পুকুর বা দিঘি ছিল বা আছে তার সঠিক হিসাব আমার কাছে নেই। তবে এলাকা মহল্লার নামের সাথে এই পুকুর দিঘিগুলোর অস্তিত্ব জড়িয়ে আছে। যেমন  সাগরদিঘির পার, লালাদিঘির পার- এই নামগুলি জানান দেয়, এখানে এই দিঘিগুলোর অস্তিত্ব ছিল।

শহরের হৃদয়ে ছিল আরো কিছু দিঘির অবস্থান। যেমন ধোপাদিঘি। যেটি আজ জীর্ণপ্রায়। তবে আপন যৌবন ধারন করে টিকে আছে রামকৃষ্ণ মিশনের দিঘি। এর জন্য সিলেট রামকৃষ্ণ মিশন কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই ধন্যবাদ দিতে হয়। আরও একটি দিঘির কথা বলতেই হয়। কাজলশাহ এলাকার দিঘি। এলাকাবাসীর আদর যত্নে প্রাণ প্রাচুর্যে এখনও সমৃদ্ধ এই দিঘিটি।

এভাবে আরো কত দিঘি পুকুর হারিয়ে যাচ্ছে তার হিসাব আমি জানিনা, জানবেন আমাদের পরিবেশবিদরা। জানবেন পরিবেশ নিয়ে যারা কাজকর্ম করেন তাঁরা।

আমি শুধু মনে করতে চাই, এই দিঘি পুকুর আর জলশয়গুলো এক সময় আমাদের শৈশব কৈশোর আর যৌবন মধুময় আর আনন্দময় করে রেখেছিল তারা বেঁচে থাকুক। বাস্তবে না হোক কল্পনায়, স্মৃতিতে বেঁচে থাকুক আমাদের অস্থিমজ্জায়, আমাদের ভালবাসায়। একসময় এই জলাধারগুলো আমাদের শহরকে প্রাণবায়ু অক্সিজেন সরবরাহ করেছে। এই কৃতজ্ঞতা যেন আমাদের থাকে।

আমার কৈফিয়ত:
এই স্মৃতিচারনে আরো অনেক দিঘি-পুকুরের কাহিনী হয়তো আমার স্মৃতির বাইরে চলে গেছে। এটা আমার ইচ্ছাকৃত অপরাধ হিসাবে না নিয়ে স্মৃতির দৈন্যতা হিসাবে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইলো। তবে আপনারা যারা এই অধমের স্মৃতিভ্রমের কাহিনী পড়বেন, তাঁদের কাছে বিনীত অনুরোধ- আপনারা এই না বলা অংশগুলো নিজগুণে প্রকাশ করে এই স্মৃতিচারণকে সমৃদ্ধ করবেন।

আমার এই লেখায় সংযুক্ত ছবিগুলো সরবরাহ করে প্রাণবন্ত এবং আমাকে কৃতজ্ঞতা পাশে আবদ্ধ করেছেন সিলেটভিউ২৪ডটকম\'র সহকারী সম্পাদক অনুজপ্রতিম পিংকু ধর।

সিলেটভিউ২৪ডটকম /৮ এপ্রিল ২০২১ / পিডি/ডালিম

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন