আজ শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ ইং

সিলেটের ঐতিহ্যবাহী বাড়ি বাঁচানোর সংগ্রাম তাঁর

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৭-০৯-২১ ০০:০৫:৫৪

ছবি: সাকী চৌধুরী

মামুনুর রশীদ চৌধুরী :: শামসুল মজিদ চৌধুরী, বন্ধু ও সাংস্কৃতিক মহলে সাকী চৌধুরী নামে সমধিক পরিচিত। সত্তরের দশকের শেষের দিকে জার্মানপ্রবাসী হওয়ার আগ পর্যন্ত সিলেট শহরের সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়াঙ্গনের এক নিবেদিতপ্রাণ। চাঁদের হাট, লিও ক্লাব, প্রান্তিক নাট্যগোষ্ঠী, সিলেট স্কুল হকি টিম ইত্যাদির সঙ্গে তিনি জড়িত ছিলেন। তৎকালীন সিলেট শহরের প্রগতিশীল ও বামধারা রাজনীতির যে উন্মেষ ঘটেছিল, তাতে তাঁর সক্রিয় ভূমিকা ছিল। বর্তমানে তিনি জার্মানভিত্তিক অরাজনৈতিক সংগঠন বাংলাদেশ ফোরামের সমন্বয়ক।

শামসুল মজিদ বিশ্ব সিলেট সম্মেলনে যোগ দিতে সুদূর জার্মানি থেকে নিউইয়র্কে এসেছেন। তাঁর সঙ্গে আলাপচারিতায় সাকী চৌধুরী বলেন, সুদীর্ঘ চার দশক ধরে দেশের বাইরে থেকেও দেশের সঙ্গে আমার বন্ধন নিবিড়। বিশেষ করে জন্মস্থান সিলেট নিয়ে যে বৃহদাকারের মিলনমেলা হচ্ছে। অনেক পুরোনো বন্ধুবান্ধব ও সতীর্থদের সঙ্গে দেখা হবে, যাঁরা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছেন।

সিলেট নিয়ে এই স্বাতন্ত্র্য সম্মেলন কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে শামসুল বলেন, সিলেট অঞ্চলের প্রচুর লোক প্রবাসী। তাঁদের মধ্যে একধরনের নিজস্বতা বজায় রেখে নিজেদের মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগের জন্য এই সম্মেলন।

রবাসে থেকে সিলেটিরা নিজেদের কতটুকু সিলেটি আর কতটুকু বাঙালি মনে করেন? এমন প্রশ্নে সাকী চৌধুরী বলেন, ‘দেখুন, আমি বিভাজিত হতে চাই না। অবশ্যই আমরা বাঙালি এবং বাংলাদেশের নাগরিক। তারপরও ভাষা ও সমৃদ্ধির দিক থেকে আমাদের এক নিজস্বতা থেকে যায়। যেকোনো কারণেই হোক, দূর দেশে আজ ছড়িয়ে পড়া সিলেট অঞ্চলের লোকজন বাংলাদেশের প্রবাসীদের অগ্রদূত হিসেবে কাজ করছেন। সিলেটকে নিয়ে নিজেদের অহংকার, নিজেদের গৌরব গর্ব থাকলেও বিশ্বের সর্বত্র সিলেট অঞ্চলের লোকজন নিজেদের বাংলাদেশি পরিচয় দেন। দেশের ভালোমন্দ নিয়ে তাঁরা সব সময় ভাবেন।

প্রবাসে থেকেও দেশের জন্য, নিজের শিকড়ের জন্য সৃষ্টিশীল চিন্তায় ব্যস্ত থাকেন সাকী চৌধুরী। তাঁর কাছ থেকে জানা গেল এমনই এক ব্যতিক্রমী কর্মপ্রয়াসের খবর। সাকী চৌধুরী জানান, ‘জার্মানির দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে রাইন-বার্গিশ অঞ্চলে যেখানে আমার বসবাস, সেই অঞ্চলের ঐতিহ্যগত বাড়িঘরের রক্ষণাবেক্ষণ আর মানুষের কাছে নিজেদের ঐতিহ্য তুলে ধরা এবং এই ঐতিহ্য নিয়ে গর্ববোধ করা জার্মানদের প্রয়াস আমাকে দারুণভাবে আকর্ষণ করে। আমার কাছে আশ্চর্যের বিষয় ছিল, এই ১৬ থেকে ১৯ শতাব্দীর তৈরি ঘরবাড়িগুলো দেখতে অবিকল আমাদের সিলেটের ঐতিহ্যগত আসাম টাইপ হেরিটেজ হাউসের মতোই!

কেবল আমাদের ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে তৈরি সিলেটি ঘরবাড়িগুলো অনেক বেশি নান্দনিক ও কারিগরি দিক থেকে অনেক বেশি টেকসই ছিল। নির্মাণসামগ্রীতে আমরা ব্যবহার করেছি কাঠ, পারস্পরিক সংযুক্ত এল পেটার্নের লোহার বার আর চুন-সুরকি।

জার্মানরা ব্যবহার করেছে কাঠ ও কাদামাটির সঙ্গে খড়কুটার মিশ্রণ। ওরা ব্যবহার করেছে টালির চাল আর আমরা ব্যবহার করেছি ঢেউটিন। উভয় ক্ষেত্রেই (আমাদের ও জার্মানদের) ঘরবাড়ি পরিবেশবান্ধব। ভেতরের পরিবেশ শীতে গরম এবং গরমে ঠান্ডা রাখে। উভয় ক্ষেত্রেই কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ তুলনামূলক কম হয়, বিশেষ করে মানুষের প্রাণহানির আশঙ্কা কম থাকে।

সাকী বলেন, একনাগাড়ে প্রায় ১০ বছর জার্মানিতে অবস্থানের পর আশির দশকের শেষ দিকে সিলেটে গিয়ে দেখি আমাদের সুন্দর, সাজানো, পরিচ্ছন্ন ও নির্মাণশৈলীতে অনন্য সিলেট শহরের এক দুঃখজনক পরিণতি! পরিকল্পনাহীন বেড়ে ওঠা কংক্রিটের অরণ্য!

আবাসিক এলাকায় দোকানপাট, উঁচু দেয়াল আর একে একে হারিয়ে যাওয়া আমাদের স্মৃতির সুন্দর আসাম টাইপ হেরিটেজ হাউস। একদিন আমার সম্পর্কে ভাবি সিলেটের পরিচিত ব্যক্তিত্ব ফাহমিনা নাহাস চৌধুরী লিপির সঙ্গে বসে আলাপচারিতায় আমরা প্রতিজ্ঞা করলাম, দুজনই এই পরিণতির বিরুদ্ধে কিছু একটা দাঁড় করতে চাই।

১৮৯৫ সালের ভূমিকম্পের পর দুর্যোগ প্রতিরোধক পরিবেশবান্ধব আর নান্দনিক অনন্য এই সিলেটি ঐতিহ্যের প্রতি মানুষের মনোভাব পরিবর্তনের জন্য মানুষের কাছে অবশিষ্ট বাড়িগুলো আর এর সৌন্দর্য নিয়ে গর্ববোধ করার মতো কিছু একটা তুলে দিতে হবে।

পরের কয়েক বছর ছুটি নিয়ে দেশে গিয়ে কেবল ছবি তোলার কাজে ব্যস্ত থেকে আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস একটি অ্যালবামে সামাজিক মাধ্যমে ছেড়ে দিই। সিলেট তথা পুরো বাংলাদেশে এমনকি ভারতের আসামসহ পুরো বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চল এবং সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে থাকা সিলেটিদের মধ্যে আমাদের এই প্রচেষ্টার প্রতি অসাধারণ আগ্রহ আমাদের অভিভূত করেছে। এর কিছুদিন পর থেকেই আমাদের কাজের সাফল্য আসতে শুরু করে।

দেখা যায়, সিলেটে অবশিষ্ট বাড়িগুলোর প্রতি মানুষের যত্ন নেওয়া বেড়ে গেছে! যখন স্বপ্রণোদিত হয়ে নিজের বাড়ি বা আত্মীয়স্বজনের বাড়ির ছবি তুলে পরিচিত, অপরিচিত মানুষ আমাদের অ্যালবামে সংযুক্ত করার জন্য পাঠাতে শুরু করি।

আবার দেখতে শুরু করলাম, মানুষ এই রকম বাড়িতে বসবাস করেন বলে এখন আবার গর্ববোধ করছেন। সযত্নে পুরোনো বাড়িগুলো মেরামত করেন, আবার সংস্কারের পর আমাদের গর্ব করে জানান।

আমার বন্ধু ওয়াশিংটনের স্বনামধন্য আর্কিটেক্ট আনওয়ার ইকবাল কচির অনেক দিনের স্বপ্ন, একটু সময় পেলেই আমরা এই অ্যালবাম বই আকারে প্রকাশ করে একটি ঐতিহাসিক ঐতিহ্যের তথ্য হিসেবে বর্তমান ও আগামী প্রজন্মের সিলেটিদের কাছে গর্বের ধন ও নিজেদের পরিচয়ের মাত্রা হিসেবে তুলে দেওয়া।

নিজের এমন সৃষ্টিশীল প্রয়াসের গল্প বলে সাকী চৌধুরী দেশ নিয়ে, নিজের ফেলে আসা শহর নিয়ে কথায় হারিয়ে গেলেন। দূর দেশে নিত্যদিন দেশকে, নিজের শহর সিলেটকে লালন করেন—কথাটি জানালেন বেশ অহংকারের সঙ্গে।

কৃতজ্ঞতা: প্রথম আলো
সিলেটভিউ২৪ডটকম/২১ সেপ্টেম্বর ২০১৭/আরআই-কে

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন