আজ বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ইং

হবিগঞ্জে এক সপ্তাহে ৫ খুন, বেড়েছে ডাকাতি-চুরি-ছিনতাই

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৯-০৬-১৫ ১১:৪২:১৯

কাজল সরকার, হবিগঞ্জ :: হবিগঞ্জে হঠাৎ করেই অপরাধের প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়ে গেছে। গত এক সপ্তাহে হবিগঞ্জে শুধুমাত্র স্বামীর হাতে তিন খুনসহ ৫টি হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। সেই সাথে ছোটখাটো সংঘর্ষ, চুরি-ছিনতাই ও রাহাজানিতো আছেই। এই অপরাধ প্রবণতার কারণ হিসেবে আইনশৃঙ্খলার অবনতিকেই অধিকাংশ ক্ষেত্রে দায়ি করছেন সচেতন মহল। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দায়ি করছে জনগণের অলস সময়কে।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, গত ৮ জুন শনিবার দুপুরে হবিগঞ্জের মাধবপুরে শাহজাহান মিয়া (৩৫) নামে এক চা দোকানীকে কুপিয়ে হত্যা করেছে প্রতিপক্ষের লোকজন। নিহত শাহজাহান মিয়া মাধবপুর উপজেলার খাটুরা গ্রামের বাসিন্দা। এই হত্যাকা-ের কারণ ছিলো জমি সংক্রান্ত বিরোধ।

এর আগের তিন অর্থাৎ ৭ জুন শুক্রবার জেলার লাখাইয়ে দু’পক্ষের সংঘর্ষে জহিরুল ইসলাম (৩৫) নামে এক ব্যক্তি নিহত হন। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন পুলিশসহ অন্তত ৩৫ জন।

ওইদিন সন্ধ্যা ৬টা থেকে ৭টা পর্যন্ত উপজেলার রূহিতনশী গ্রামে এ সংঘর্ষ চলে। নিহত জহিরুল ইসলাম ওই গ্রামের ছমেদ মিয়ার ছেলে। এই সংঘর্ষের কারণ ছিলো সমিতির টাকা ভাগ বাটোয়ারা। এ ঘটনায় পরদিন পুলিশ আড়াই হাজার গ্রামবাসীর বিরুদ্ধে ‘পুলিশ এসল্ট’ মামলা দায়ের করে।

এদিকে, সম্প্রতি পারিবারিক কলহের মাত্রাও হবিগঞ্জে দানব আকার ধারণ করেছে। গত তিনদিনে হবিগঞ্জের তিন উপজেলায় স্বামী হাতে প্রাণ দিতে হয়েছে তিন অভাগিনীকে। এই তিনটি খুনের একমাত্র কারণ ছিলো পারিবারিক তুচ্ছ কলহ।
গত ১৩ জুন বুধবার দিবাগত রাতে জেলার বাহুবলে রুমা বেগম (৩৫) নামে এক গৃহবধূকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে তার স্বামী কাওছার মিয়া। উপজেলার ইসলামাবাদ আবাসিক এলাকায় ঘটনাটি ঘটে। কাওছার পেশায় ট্রাকচালক।

হত্যার কারণ হিসেবে প্রাথমিক অনুসন্ধানে পুলিশ জানতে পারে- তিন সন্তান রেখে বাউল শিল্পী রুমা বেগম কাউছারের সাথে পালিয়ে বিয়ে করে। ঘটনার দিন রাত আড়াইটার দিকে হইহোল্লোর শুনে বাসার মালিক রুমা বেগমের ঘরে গিয়ে তাকে অচেতন অবস্থায় বিছানায় পড়ে থাকতে দেখেন। বিষয়টি পুলিশকে জানালে বাহুবল থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে রুমা বেগমের নিথর দেহ উদ্ধার করে বাহুবল স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে আসলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।

এ ব্যাপারে পুলিশ জানায়- প্রাথমিক তদন্তে তাকে শ্বারোধে হত্যার আলামত পাওয়া গেছে। যেহেতু ঘটনার পর স্বামী পলাতক তাই ধারণা করা হচ্ছে তার স্বামী তাকে হত্যা করেছে।

এর আগের দিন ১২ জুন বুধবার রাতে হবিগঞ্জের চুনারুঘাটে স্বামীর বিরুদ্ধে স্ত্রীকে শ্বাসরোধ করে হত্যার অভিযোগ উঠে। ঘটনার পর থেকে ঘাতক স্বামী পলাতক রয়েছে। নিহত রীনা আক্তার (৩৫) উপজেলার মিরাশী ইউনিয়নের আদমপুর গ্রামের মো. ফরিদ মিয়ার স্ত্রী।

পুলিশ লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য হবিগঞ্জ মর্গে প্রেরণ করে। এই হত্যার কারণও পারিবারি কলহ বলে ধারণা করছেন চুনারুঘাট থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কেএম আজমিরুজ্জামান। তিনি বলেন- ‘ধারণা করা হয়েছে শ্বাসরোধ করে তার স্বামী হত্যাকা-টি ঘটিয়েছে। ঘটনার পর থেকে স্বামীকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।’

এর আগে গত ১১ জুন জেলার শায়েস্তাগঞ্জে পারিবারিক কলহের জেড় ধরে স্ত্রী মুক্তা রাণী দাসকে কুপিয়ে হত্যা করে স্বামী কিশোর দাস। ঘটনার পর থেকেই অভিযুক্ত স্বামী পলাতক রয়েছেন। তাদের বাড়ি উপজেলার পূর্ব বড়চর গ্রামে। তবে তারা দু’জনেই ওলিপুর এলাকায় একটি কোম্পানিতে চাকরি করতেন। ওই এলাকাতেই বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতেন তারা।

পুুলিশ জানান, ঘটনার দিন স্বামী কিশোর দাস বাসায় আসলে তুচ্ছ বিষয় নিয়ে তাদের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়। এক পর্যায়ে কিশোর স্ত্রী মুক্তাকে দা দিয়ে কুপিয়ে জখম করে। তার চিৎকার শুনে স্থানীয়রা গিয়ে তাকে উদ্ধার করে হবিগঞ্জ সদর আধুনিক হাসপাতালে নেয়। কিন্তু অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় চিকিৎসকরা তাকে সিলেট এমএমজি ওসমানি মেডিকেল কলেজে পাঠায়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাত ১০টার দিকে মুক্তা মারা যান।

শুধু খুনই নয়, সমান তালে বেড়েছে চুরি ছিনতাই ও ডাকাতির ঘটনা। এমনকি ছিনতাইকারীর হাতে খুনের মতো ঘটনাও ঘটেছে।

গত ২৭ মে সোমবার রাত সাড়ে ১২টার দিকে টমটম অটোরিকশা চালক সাবাজ মিয়াকে (২৫) শহরের আনোয়ারপুর এ লাকা থেকে শায়েস্তাগঞ্জ যাওয়ার জন্য ভাড়া করেন একদল ছিনতাইকারী। ধুলিয়াখাল বাইপাস এলাকায় পৌঁছালে ছিনতাইকারীরা চালক সাবাজ মিয়াকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে রাস্তার পাশে ফেলে দেয়। পরে ছিনতাইকারীরা টমটম নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। যদিও এ সময় পুলিশ তিন ছিনতাইকারীকে আটক করেছে।

নিহত টমটম অটোরিকশা চালক সাবাজ মিয়া আনোয়ারপুর এলাকার মাতাব আলীর ছেলে।

এছাড়াও গত ১০ জুন সোমবার জেলার চুনারুঘাট উপজেলার রানীগাঁও ইউনিয়নের চাটপাড়া গ্রামে ও পরদিন ১১ জুন মঙ্গলবার ভোররাতে বাহুবল উপজেলার হরিপাশা গ্রামের ব্যবসায়ি মো. মকসুদ মিয়ার বাড়িতে দুর্ধর্ষ ডাকাতির ঘটনা ঘটে। দুটি ঘটনায়ই ডাকাতরা পরিবারের সদস্যদের অস্ত্রের মূখ জিম্মি করে ঘরে থাকা নগদ টাকা, স্বর্ণালঙ্কার ও মূল্যবান জিনিসপত্র নিয়ে পালিয়ে যায়।

অপর দিকে, হবিগঞ্জ শহরে মোটরসাইকেল চুরির হিড়িক পড়েছে। সাধারণ মানুষের পাশাপাশি সাংবাদিক এবং পুলিশও রেহাই পাচ্ছে না চোরদের কাছ থেকে।

গত ১১ জুন মঙ্গলবার দুুপুরে সদর হাসপাতালের সামন থেকে সাংবাদিক ফরহাদ হোসেনের মোটরসাইকেলটি চুরি হয়ে যায়। এর আগেরদিন ১০ জুন সোমবার দুপুরে জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সামনে থেকে তরফ বার্তার সম্পাদক এবং উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান মাহবুবুর রহমান আউয়ালের মোটরসাইকেল চুরি হয়।

হঠাৎ করে কেন এমন অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে হবিগঞ্জে? সচেতন মহল বলছেন আইনশৃঙ্খলার অবনতির কারণেই এসব অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। এর জন্য আইনশৃঙ্কলা রক্ষাকারী বাহীনিকে আরও সতর্ক অবস্থানে থাকার পরামর্শ দিয়েছেন তারা। একই সাথে আইনের সঠিক প্রয়োগ না হওয়া ও জামিন প্রবনতা বৃদ্ধিকে দায়ি করেছেন তারা।

এ ব্যাপারে সাংবাদিক ও আইনজীবি এমএ মজিদ বলেন- ‘আইনের ফাঁক-ফুকোর দিয়ে সহজেই অপরাধিরা জামিন পেয়ে যায়। এছাড়া যে কোন একটি মামলার দীর্ঘ সূতিকার সৃষ্টি হয়। যার কারণে অপরাধিরা যে কোন ধরণের অপরাধ করতে দ্বিধাবোধ করে না।’

তিনি বলেন- ‘আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে যারা আছেন তারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষার চেয়ে প্রশাসনিক অন্যসব কাজ নিয়ে বেশি ব্যস্ত থাকেন। যার ফলে অপরাধ প্রবণতা বেশি বৃদ্ধি পাচ্ছে।’ এ ব্যাপারে তিনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আরও কঠোর ওয়ার আহবান জানান।

মানবাধিকার সংগঠন ‘এসোসিয়েশন ফর ল রিসার্চ এন্ড হিউম্যান রাইটস’ (এলার্ট) এর হবিগঞ্জ জেলা শাখার সভাপতি ও সিনিয়র আইনজীবি মনসুর উদ্দিন আহমেদ ইকবাল বলেন- ‘ইদানিং হবিগঞ্জে খুন, দাঙ্গা, চুরি-ছিনতাই ও রাহাজানি উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এর কারণ জনসচেতনতার অভাব। দাঙ্গা প্রতিরোধে স্থানীয় প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি ও পুলিশসহ সবাইকে যৌথভাবে জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষে কাজ করতে হবে।’

অপরাধ প্রবনতা বৃদ্ধির বিষয়ে তিনি বলেন- ‘আইনের সঠিক প্রয়োগ না থাকার কারণে এবং অপরাধিদের সাজা না হওয়ায় অপরাধ প্রবনতা বাড়ছে। এর জন্য আইনের সঠিক প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।’

তবে খুনের প্রবনতা বৃদ্ধির বিষয়ে জনগণের অলস সময়কে দায়ি করলেন পুলিশ সুপার মোহাম্মদ উল্ল্যা। তিনি বলেন- ‘এখন বর্ষা মৌসুম হওয়ায় জনগণ অনেকটা অলস সময় কাটচ্ছে। যার কারণে সারাদিন বাড়িতে অবসর বসে থাকে। তুচ্ছ বিষয় নিয়ে ভাই-স্ত্রীর সঙ্গে কাটাকাটি হয়। এক পর্যায়ে খুনেরর মতো ঘটনাও ঘটে।’

তিনি বলেন- ‘হবিগঞ্জ একটি দাঙ্গাপ্রবন জেলা। তাই দাঙ্গা প্রতিরোধে পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। প্রতিনিধি ইউনিয়নের জনগণকে নিয়ে দাঙ্গার কুফল সম্পর্কে আলোচনা করা হচ্ছে। এছাড়া কুইজ ও বিতর্ক প্রতিযোগিতাসহ বিভিন্ন প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শন করা হচ্ছে।’

সিলেটভিউ২৪ডটকম/১৫ জুন ২০১৯/কেএস/ডিজেএস

@

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন