আজ শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ ইং

দালালদের প্রতারণা: আমিরাতে বেতন পাচ্ছেন না হবিগঞ্জের কয়েক হাজার শ্রমিক

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৯-০৭-১২ ১১:৩১:৩৭

কাজল সরকার, হবিগঞ্জ :: মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত। ধনী দেশের তালিকার মধ্যে অন্যতম একটি রাষ্ট্র যেখানে বাংলাদেশের জন্য রয়েছে বিশাল শ্রম বাজার। পরিবারের স্বচ্ছলতা ফেরাতে রঙিন স্বপ্নে বিভোর হয়ে সেখানে পাড়ি জমিয়েছেন কয়েক লাখ বাংলাদেশী। কিন্তু পরিবারের স্বচ্ছলতা ফেরানো কিংবা স্বপ্ন পূরণতো দূরের কথা, উল্টো নিজেকেই না খেয়ে মরতে হচ্ছে পরবাসে।

তিন থেকে চারমাস ধরে কাজ করেও বেতন পাচ্ছেন না আরব আমিরাতে কর্মরত হবিগঞ্জের কয়েক হাজার শ্রমিক। দিনরাত পরিশ্রম করিয়ে বেতন দিচ্ছে না বাঙালী দালালরা। বিশেষ করে যারা ভিজিট ভিসায় এসেছে তাদের বেশিরভাগই এই সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছেন। তিন চার মাস কাজ করিয়ে মজুরি না দিয়ে পালিয়ে যাচ্ছেন বাংলাদেশের কিছু অসাধু লাইসেন্সধারী। কিন্তু ‘আইডি কার্ড’ না থাকার দেশী-বিদেশেী কোন সংস্থার কাছে অভিযোগও করতে পারছেন না তাঁরা। এ অবস্থায় আরব আমিরাতে প্রবাসী শ্রমিকদের না খেয়ে মরলেও দালালরা হচ্ছেন আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ।

সেখানে বসবাস প্রবাসীদের তথ্যমতে- দুবাই, শারজাহ্, আবুধাবী, আজমান, আল-আইন, ফজিরা শহরে হবিগঞ্জের প্রায় ত্রিশ হাজারের অধিক শ্রমিক রয়েছেন। এর মধ্যে ভিজিট ভিসায় সেখানে বসবাস করছেন অন্তত ১২/১৫ হাজার শ্রমিক। যাদের কাছ করতে হচ্ছে বাঙালী লাইসেন্সধারী শ্রমিকের আওতায়। আইডি না থাকায় দালালদের কথাতমো বিভিন্ন কোম্পানীতে কঠোর পরিশ্রম করতে হচ্ছে ভিজিটর শ্রমিকদের। অথচ এত পরিশ্রমের পরও কেউ তিনমাস আবার কেউ চারমাস ধরে বেতন পাচ্ছেন না। বেতন চাইলে দালালরা প্রতিশ্রুতি দেন আবার কখনো কখনো হুমকি-ধামকিও দেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।

এদিকে, বেতন না পেয়ে মানবেতর জীবন যাপন করতে হচ্ছে হবিগঞ্জের কয়েক হাজার শ্রমিককে। কেউ আবার অত্মিয়-স্বজনদের কাছ থেকে ধার-দেনা করে চলছেন। আবার যাদের আত্মিয়-স্বজন নেই তাদের কেউ কেউকে বাড়ি থেকে টাকা নিয়ে চলতে হচ্ছে।

প্রবাসীদের তথ্যমতে বেতন না পাওয়া শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ১০ হাজারের অধিক হবে। যার অধিকাংশই হবিগঞ্জের বিভিন্ন এলাকার। তবে সব চেয়ে বেশি রয়েছে বাহুবল উপজেলার। এছাড়া বানিয়াচং, চুনারুঘাট ও লাখাই উপজেলার শ্রমিকও রয়েছেন।

এই অবস্থার কারণে সয়-সম্পত্তি বিক্রি করে বিদেশে যাওয়া অনেকে মানষিকভাবে ভেঙে পড়েছেন। কেউ কেউ এই অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে নিজের ইচ্ছামতো সিআইডির কাছে ধরা দিচ্ছে। আবার কেউ কেউ আরব আমিরাত ইমিগ্রেশন ও বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে আউট পাস সংগ্রহ করে দেশে ফিরতে বাধ্য হচ্ছেন।

অনেক শ্রমিক অভিযোগ করেন- দালালদের মাধ্যমে ৪/৫ লাখ টাকা খরচ করে পরিবারের স্বচ্ছলতা ফেরাতে সংযুক্ত আবর আমিরাতে ফাড়ি জমিয়েছেন। দালালরা দৈনিক ৮ ঘণ্টা ডিউটি, সপ্তাহে ১ দিন ছুটি ও বেসিক ১৩৫ দিনার (২৭ হাজার ৭৩০ টাকা) বেতন দেবে বলে সেখানে পাঠিয়েছে। কিন্তু সেখানে তাদেরকে ১২ থেকে ৩৬ ঘণ্টা পর্যন্তও একটানা ডিউটি করিয়েও গত ৩/৪ মাস ধরে বেতন নাই। ছোট খাট কোনো ভুল হলেই ৫০ দিনার (১০ হাজার ২৭০ টাকা) বেতন কাটা হয়।

ভাগ্য পরিবর্তনের চেষ্টায় সংযুক্ত আরব আমিরাত যাওয়া হবিগঞ্জের বাহুবল উপজেলার সাতকাপন ইউনিয়নের মানিকপুর গ্রামের বাসিন্দা মো. আরশ মিয়া টেলিফোনে বলেন- ‘দেশে হাঁসের খামার করতাম। ভালোই দিন কাটছিল। দুবাই এসেছিলাম বেশি রোজগারের আশায়। কিন্তু এখানে এসে দেখি ভাগ্য পরিবর্তনতো দূরের কথা আমি ঠিক মতো খাইতে পারতেছি না।’

তিনি বলেন- ‘আর আমার বউ বাচ্চাকে কি খাওয়াব। চার মাস যাবত এক কোম্পানিতে কাজ করতেছি। এখন পর্যন্ত একটা টাকাও পাই নাই। বাড়ি থেকে বারবার টাকার জন্য টেলিফোন আসছে। এখন কি করব কিছুই বুঝতে পারতেছি না।’

চুনারুঘাট উপজেলার উবাহাটা ইউনিয়নের উবাহাটা গ্রামের বাসিন্দা মো. কামরুল ইসলাম নামে এক প্রবাসী শ্রমিক বলেন- ‘এসএসসি পরীক্ষা শেষ করে পরিবারের আখের গোছাতে দুবাই এসেছিলাম। এসে খুব বিপদে পরে গেছি। এক সাইটে কাজ করেছিলাম তিনমাস ধরে। কিন্তু এখন পর্যন্ত একটা টাকাও পাই নাই। বাড়িতে টাকা দেয়াতো দূরের কথা, কিভাবে খাব, রুম ভাড়া দেব বুঝতে পারছি না।’

বাহুবলে উপজেলার সাতকাপন ইউনিয়নের গগলপুর গ্রামের মো. বিলাথ মিয়া নামে এক শ্রমিক বলেন- ‘কয়েকমাস ধরে বেতন না পাওয়ায় আমার এক সহকর্মীর কাছ থেকে টাকা ধার করে চলতে হচ্ছে। কিন্তু বাড়িতে দুশ্চিন্তা করবে বলে কিছুই বলতে পারছি না।’

একই ইউনিয়নের বক্তারপুর গ্রামের বাসিন্দা মো. হাফিজ মিয়া বলেন- ‘বাড়ি থেকে টাকা এনে চলতে হচ্ছে আমাকে। ৪/৫ লাখ টাকা খরচ করে বিদেশ এসেছিলাম পরিবারের দায়িত্ব নেব বলে। উল্টো আমার ভরণ-পোষণ এখনও আমার পরিবার করতে হচ্ছে।’

বাহুবল সদরের বাসিন্দা মো. সেলিম মিয়া বলেন- ‘অনেক স্বপ্ন নিয়ে বিদেশ এসেছিলাম। কিন্তু স্বপ্ন পূরণ দূরের কথা এখন না খেয়ে মরতে হবে মনে হচ্ছে।’

তিনি বলেন- ‘বাঙালী হয়েও বাঙালীর দুঃখ বুঝে না। আমাদের জীবন নিয়ে খেলছে কিছু অসাধু বাঙালী।’

সিলেটভিউ২৪ডটকম/১২ জুলাই ২০১৯/কেএস/ডিজেএস

@

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন