Sylhet View 24 PRINT

ভানুগাছ-শমশেরনগর রেলপথে হাজার হাজার ক্লিপ-হুক চুরি

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৯-০৭-০৮ ০০:৪২:১৩

জয়নাল আবেদীন, কমলগঞ্জ :: পূর্বাঞ্চলীয় সিলেট-আখাউড়া রেল লাইনে ক্লিপ-হুক চুরি অব্যাহত রয়েছে। রেল লাইনের সাথে সংযুক্ত ক্লিপ-হুক চুরির ফলে দিন দিন দুর্বল হয়ে পড়ছে এসব রেল লাইন। বিষয়টি নজরে আসে বরমচাল এলাকায় ট্রেন দুর্ঘটনার পর থেকে। সেকশনের ভানুগাছ-শমশেরনগর মধ্যেবর্তী রেলপথে হাজার হাজার ক্লিপ, হুক চুরির ঘটনা ঘটছে। পাশাপাশি ব্রিটিশ আমলের তৈরি রেলসেতু ও কালভার্টগুলোর উপর জীনশীর্ণ কাঠের স্লিপারের সাথে বাঁশের ফালি স্থাপন করা হয়েছে। ফলে ট্রেন চলাচলের সময় যেকোনো মুহুর্তে দুর্ঘটনার আশঙ্কা রয়েছে।

সরেজমিনে রেলপথের শমশেরনগর-ভানুগাছ রেলওয়ে স্টেশন সংলগ্ন গোপালনগর রেলগেটের এলাকার কয়েকটি স্থান ঘুরে দেখা যায় ব্রিটিশ আমলের তৈরি পূর্বাঞ্চলীয় সিলেট-আখাউড়া রেলপথ ও কালভার্ট ব্রিজগুলোসহ লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের ভেতরের রেললাইনও সংস্কারের অভাবে দীর্ঘদিন ধরেই ঝুঁকিপূর্ণ রয়েছে। যেন লাউয়াছড়া বনের ভেতরের রেলপথ মৃত্যুর ফাঁদ। দেশের নিরাপদ যোগাযোগ ব্যবস্থার শীর্ষস্থানে রেলপথ থাকলেও সিলেট রেলপথের অধিকাংশ স্থানের অবস্থাই অত্যন্ত নাজুক। তার চেয়েও নাজুক লাউয়াছড়া বনের রেলপথটি।

১৯৯৭ সালে ১৪ই জুন কমলগঞ্জের মাগুরছড়া গ্যাসকূপ বিস্ফোরণে শত বছরের পুরনো সিলেট রেলপথটির লাউয়াছড়া বনের রেললাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে কয়েক মাস সিলেটের সঙ্গে সারা দেশের ট্রেন যোগাযোগ বন্ধ ছিল। পরে ক্ষতিগ্রস্থ লাইনটি সংস্কার করার পর বনের ভেতরের অংশ সংস্কার কিংবা মেরামত না করায় বনের ভেতরের ৮ কি.মি. রেলপথের পুরো লাইন জুড়েই রয়েছে নেই নেই অবস্থা। জয়েন্টে নাট-বল্টু নেই, স্লিপার ভাঙা, স্লিপারের হুক নাই, রেললাইনের স্লিপারে পাথর নেই, পাথরের পরিবর্তে স্লিপারের মধ্যখানে বালু দিয়ে রাখায় রেললাইনের নড়বড়ে অবস্থা। এ অবস্থায় নড়বড়ে এ রুটেই ঘটে দেশের সব চেয়ে বেশি ট্রেন লাইনচ্যুতের ঘটনা।

রেলপথে স্লিপার নাট-বল্টু দিয়ে রেল লাইন আটকানো থাকার কথা থাকলেও বিভিন্ন স্থানে ক্লিপ, নাট-বল্টু নেই। রেলপথ থেকে এসব যন্ত্রাংশ চুরি হচ্ছে। ভানুগাছ, শমশেরনগর, টিলাগাঁও স্টেশনের মাঝখানে অসংখ্য স্থানে ক্লিপ-হুক নেই। বিশেষ করে ভানুগাছ স্টেশন সংলগ্ন গোপালনগর রেলগেটের মাত্র পাঁচশ’ মিটার এর মধ্যে রেলপাতের সাথে ৪১২টিতেই ক্লিপ পাওয়া যায়নি। গোপালনগর ও ফাজিলপুর এলকার ৩০২/৭ নম্বর পিলার পর্যন্ত দু’ধারে প্রায় ৪১৬টি ক্লিপ নেই। এমনকি দু’টি লাইনের সংযুক্ত স্থানেও ক্লিপ চুরি হয়ে গেছে। রেলপথ থেকে এসব যন্ত্রাংশ চুরি হওয়ায় ফাঁকা হয়ে পড়ছে এসব লাইন। দিনের পর দিন ক্লিপ-হুক, নাটবল্টু, ফিশপে ট চুরি হওয়ায় সেকশনটি ঝুঁকির মুখে পড়েছে। ট্রেন চলাচলেও দুর্ঘটনার আশঙ্কা রয়েছে। চুরি যাওয়া ওসব যন্ত্রাংশ দ্রুত লাগানোর নিয়ম থাকলেও বছরের পর বছর তা লাগানো হচ্ছে না।

গত ৭ মে রাতে সিলেট-আখাউড়া রেল সেকশনের শমশেরনগর রেল স্টেশনের অদূরে দক্ষিণ পাশে ৩০৬/২ নম্বর রেলপথ এলাকায় রেলপথের পাতে ফাটল দিয়ে বারো ইি ফাঁক তৈরি হয়। এতে ট্রেনের বড় ধরণের দুর্ঘটনার ক্ষেত্র তৈরি হয়। এ সময়ে এক স্কুল শিক্ষার্থীর সচেতনতায় বড় ধরণের দুর্ঘটনা থেকে যাত্রীবাহী আন্ত:নগর উদয়ন এক্সপ্রেস ট্রেনটি রক্ষা পায়। সিলেট রেলপথের কমলগঞ্জ ও শ্রীমঙ্গল রেলওয়ে স্টেশনের দূরত্ব ১৩ কিলোমিটার। এরমধ্যে লাউয়াছড়া বনের ভেতরে রয়েছে ৮ কি.মি. রেলপথ। এই পথের মধ্যে ছোট-বড় ৬টি ব্রিজ রয়েছে।

শমশেরনগরের ব্যবসায়ী আকমল হোসেন, প্রণয় পাল, নুরুল মোহাইমীন, সমাজকর্মী সিদ্দিকুর রহমান বলেন, রেলপথ থেকে অসংখ্য স্লিপার ও হুক চুরি হওয়ায় ট্রেনে যেতে এখন ভয় করে। অতীতে ট্রলিযোগে প্রকৌশলী বিভাগের লোকজন নিয়মিত রেলপথ রক্ষণাবেক্ষণ কাজের জন্য রেলপথে ঘুরে বেড়াতেন। তাছাড়া শ্রমিকদেরও রেলপথ, কালভার্ট, ব্রিজে কাজ করতে দেখা যেতো। প্রতিনিয়ত সংস্কার কার্যক্রম পরিলক্ষিত হলেও বর্তমানে এচিত্র চোখে পড়ে না। এখন রেল সেকশনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে দুর্ণীতি গ্রাস করছে। স্টেশনে টিকিট বিক্রিসহ নানা বাণিজ্য নিয়ে মাস্টারসহ অন্যান্যরা ব্যস্ত থাকেন। ফলে ট্রেন, রেলপথ ও কালভার্ট-ব্রিজে কোন সমস্যা আছে কি না সেটি তাদের কাছে মুখ্য নয়। মানুষের জীবনের চেয়ে টাকা কামানোটাই মুখ্য।

লাউয়াছড়া বনের ভেতর মাগুরছড়া খাসিয়া পুঞ্জি থেকে চোংগার পুল পর্যন্ত রেললাইনের অবস্থা খুবই নাজুক। পাহাড়ি এলাকার এই অংশের মধ্যে রেললাইনের একটি স্থানে রেলপাত অংশ গলে ক্ষয়ে টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে পড়ছে। জয়েন্টের প্লেটের ৪টি নাট-বল্টুর মধ্যে কোথায় ২-৩টি রয়েছে। কোনো কোনো জয়েন্টে নাট থাকলে বল্টু নেই। আবার কোথাও নাট ক্ষয়ে যাওয়ায় কাপড় দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে। জয়েন্টে নাট-বল্টু না থাকায় রেলপাতগুলো উঁচুনিচু হয়ে বেশ কম অবস্থায় রয়েছে। এক স্থানে ১২টি স্লিপারের মধ্যখানে কোনো পাথর নেই, পাথরের পরিবর্তে দিয়ে রাখা হয়েছে বালু। অধিকাংশ স্লিপার ভাঙা। স্লিপার ধরে রাখার হুক খুলে পড়ে আছে। লাউয়াছড়া বনের পাহাড়ি রেলপথ এতটাই ঝুঁকিপূর্ণ যে যাত্রীরা দেখলে হয়তো এই পথে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করতেন না এ পথে।

এজন্য সব চেয়ে ভয়াবহ দুর্ঘটনাটি ঘটেছে ২৩শে জুন রাতে কুলাউড়ার বরমচাল এলাকার বড়ছড়া সেতুতে। ওইদিন সিলেট থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে ছেড়ে আসা আন্তঃনগর ‘উপবন এক্সপ্রেস’ ট্রেন সেতু ভেঙে দুর্ঘটনা ঘটলে বহু হতাহতের ঘটনা ঘটে। সাধারণ যাত্রীরা বলেন, ‘আমরা রেলপথকে সব চেয়ে নিরাপদ যোগাযোগ ব্যবস্থা মনে করি। কিন্তু সিলেট রেলপথটি এতটাই ঝুঁকিপূর্ণ যে কি বলব। এ রেলপথটি ঝুঁকিপূর্ণ হলেও রহস্যজনক কারণে এই পথটি সংস্কারের কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে না। এ বিষয়ে কথা বলার জন্য রেল বিভাগের স্থানীয় কৌশলীদের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও কথা বলা যায়নি। রেলের স্থানীয় পর্যায়ের কেউও এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি।

তবে কুলাউড়াস্থ রেলওয়ের গণপূর্ত বিভাগের উপ-সহকারী মনিরুল ইসলাম বলেন, ভানুগাছ স্টেশনের আউটারে একটি বেইলী ব্রিজ ঝুঁকিপূর্ণ রয়েছে। তবে কাজ চলছে কিছুদিনের মধ্যে সম্পন্ন হবে। তাছাড়া হুক, ক্লিপ না থাকলে সেখানে কাজ করা হবে। রেলপথ এখন স্বাভাবিক ও সমস্যাযুক্ত স্থানে কাজ চলছে বলে তিনি দাবি করেন। বাংলাদেশ রেলওয়ের ঢাকার প্রধান দপ্তরের বিভাগীয় প্রকৌশলী-২ আহসান জাবির বলেন, ১ হাজার কাঠের স্লিপার আনা হয়েছে। সিলেট বিভাগের যেসব স্থানে স্লিপার একেবারে নষ্ট হয়ে গেছে, সেখানে সেগুলো স্থাপন করা হবে। এ ছাড়া সিলেট বিভাগের সবকটি রেলসেতু নতুন করে নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে।

সিলেটভিউ২৪ডটকম/০৮ জুলাই ২০১৯/জেএ/ডিজেএস

সম্পাদক : মো. শাহ্ দিদার আলম চৌধুরী
উপ-সম্পাদক : মশিউর রহমান চৌধুরী
✉ sylhetview24@gmail.com ☎ ০১৬১৬-৪৪০ ০৯৫ (বিজ্ঞাপন), ০১৭৯১-৫৬৭ ৩৮৭ (নিউজ)
নেহার মার্কেট, লেভেল-৪, পূর্ব জিন্দাবাজার, সিলেট
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.