আজ শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ইং

কুলাউড়ায় চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন ভাষা সৈনিক রওশন আরা বাচ্চু

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৯-১২-০৪ ১৭:১৪:২০



শাকির আহমদ, কুলাউড়া :: মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়ায় সর্বস্তরের মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে চির নিদ্রায় শায়িত হলেন ভাষা সৈনিক রওশন আরা বাচ্চু।

বুধবার (৪ ডিসেম্বর) কুলাউড়ার নবীন চন্দ্র সরকারী মডেল উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে এই মহীয়সী নারীর মৃতদেহ আনা হয়। ৫২’র ভাষা আন্দোলনে ১৪৪ ধারা ভেঙে রাজপথে নেমে পুলিশের ব্যারিকেড ভাঙা এই জাতির বীর এই ভাষা সেনানীর প্রতি ফুল দিয়ে শ্রদ্ধাঞ্জলী জানায় সর্বস্তরের মানুষ।

মরহুমার বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা ও তাঁর শোকসন্তুপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করে বক্তব্য রাখেন জেলা প্রশাসক নাজিয়া শিরিন, জেলা পুলিশ সুপার ফারুক আহমদ (পিপিএম), কুলাউড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এ টি এম ফরহাদ চৌধুরী, উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি রফিকুল ইসলাম রেনু, সাধারণ সম্পাদক আসম কামরুল ইসলাম, কুলাউড়া উপজেলা পরিষদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মাও. ফজলুল হক খান সাহেদ প্রমূখ।

এসময় রওশন আরা বাচ্চুর ছোট মেয়ে তাহমিদা খাতুন বলেন, ‘আমার মায়ের শেষ ইচ্চে ছিলো তাঁর নিজ জন্মস্থানে শায়িত হবেন। আমরা সেই আশা পূর্ণ করেছি। আমার মায়ের নামে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান করতে চাই। এটি হলেই আমার মায়ের আত্মা শান্তি পাবে।’

পরে সকাল ১১টায় ওই মাঠে জানাজা শেষে উনার নিজ বাড়ির পূর্বপার্শ্বে পুকুর পারে পারিবারিক কবরস্থানে রওশন আরা বাচ্চুর দাফন সম্পন্ন করা হয়। এসময় উপস্থিত ছিলেন মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।

বার্ধক্যজনিত শারীরিকভাবে সমস্যায় গত মঙ্গলবার (৩ ডিসেম্বর) রাজধানীর অ্যাপোলো হাসপাতালে জীবনের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ভাষাসৈনিক রওশন আরা বাচ্চু। (ইন্নালিল্লাহি ..... রাজিউন)। মৃত্যুকালে উনার বয়স হয়েছিলো ৮৭ বছর। রওশন আরার মৃত্যুতে গভীর শোক জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রওশন আরা বাচ্চুর স্থান পুরণ হওয়ার নয় বলে জানিয়েছেন দেশের অনেক খ্যাতিমান ভাষাবিদ, শিক্ষাবিদ, রাজনৈতিকসহ নানা শ্রেণী পেশার মানুষ।

শ্রদ্ধানুষ্ঠানে মৌলভীবাজার জেলা পুলিশ সুপার ফারুক আহমদ পিপিএম বলেন-‘কুলাউড়ায় অনেক গুনী ব্যক্তিদের জন্ম হয়েছে। এর মধ্যে রওশন আরা বাচ্চু অন্যতম শ্রেষ্ঠ কৃতি সন্তান। উনাদের আন্দোলনের ফসল হলো আমাদের এ প্রাণের বাংলাদেশ।’

মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসন নাজিয়া শিরিন শ্রদ্ধাজ্ঞাপন শেষে বলেন- রওশন আরা বাচ্চুর স্মৃতি রক্ষার্থে রাষ্ট্রীয়ভাবে আমরা নিশ্চয়ই কাজ করবো। ৫২ সালে তিনি ভাষাসংগ্রামী হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করেছিলেন। রওশন আরা বাচ্চু অত্যন্ত সাহসী নারী ছিলেন। ভাষা আন্দোলন থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত বাংলা ভাষার প্রশ্নে তিনি সর্বদাই সোচ্চার ছিলেন। আমি তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করি।’

এরআগে মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ৩টার দিকে বাংলা একাডেমি থেকে রওশন আরা বাচ্চুর মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে। সেখানে তাঁর প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় তাঁর পশ্চিম মণিপুরের বাসায়। এশার নামাজের পর সেখানকার বায়তুল আমান জামে মসজিদে তাঁর দ্বিতীয় জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। পরে মরদেহবাহী গাড়ি ঢাকা থেকে সাইরেন বাজিয়ে রাত ৩টায় পৌঁছায় কুলাউড়াস্থ উছলাপাড়া গ্রামে তাঁর নিজ বাড়িতে। এসময় আত্মীয়-স্বজন পাড়া প্রতিবেশীদের কান্নায় ভারী হয়ে উঠে চারদিকের পরিবেশ।

উনার জীবদ্দশায় তিনি বলতেন, ‘ভাষা বাঁচলে দেশ বাঁচবে। আমি আমার জীবনে যা কিছু করতে পেরেছি তার জন্য মায়ের অবদানই বেশী। যে যুগে আমি পড়াশোনা করেছি, তা যদি আমার মা না দেখতেন তাহলে হতো না।’ মৃত্যুকালে উনার চার মেয়ে রেখে গেছেন। উনার স্বামী শামসুদ্দীন মোহাম্মদ আবদুল তৈমুর মারা গেছেন ২০১৭ সালে।

প্রসঙ্গত, ভাষাসৈনিক রওশন আরা বাচ্চু ১৯৩২ সালের ১৭ ডিসেম্বর মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার উছলাপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা এ এম আশ্রাফ আলী, মা মনিরুন্নেসা খাতুন। রওশন আরা বাচ্চু ১৯৪৭ সালে পিরোজপুর গার্লস স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। এরপর বরিশাল বিএম কলেজ থেকে ১৯৪৯ সালে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। ১৯৪৯ সালে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে। ১৯৫৩ সালে অনার্স পাস করেন। রওশন আরা বাচ্চু ‘গণতান্ত্রিক প্রগ্রেসিভ ফ্রন্ট’-এ যোগ দিয়ে ছাত্ররাজনীতি শুরু করেন। তিনি সলিমুল্লাহ মুসলিম হল এবং উইমেন স্টুডেন্টস রেসিডেন্সের সদস্য নির্বাচিত হন। রওশন আরা বাচ্চু সর্বশেষ বিএড কলেজে শিক্ষকতা করেছেন। অবসর নেন ২০০২ সালে।

রওশন আরা বাচ্চুর পরিবার নানাভাবে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিল। দাদা আহমদ আলী পড়াশোনা করেন কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে। তিনি ব্রিটিশ সরকারের ইন্সপেক্টর জেনারেল অব রেজিস্ট্রেশনের দায়িত্বে ছিলেন। চাচা ছিলেন কংগ্রেস পার্টির সদস্য।

সিলেটভিউ২৪ডটকম/৪ ডিসেম্বর ২০১৯/শাআ

@

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন