আজ শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ ইং

মৌলভীবাজারের ২০০ বছরের ঐতিহ্যের মাছের মেলায় মানুষের ভিড়

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০২০-০১-১৪ ২১:১২:৪৮

সিলেটভিউ ডেস্ক :: পৌষ সংক্রান্তি উপলক্ষে মৌলভীবাজারের শেরপুরে শুরু হয়েছে দুই দিনব্যাপী ঐতিহ্যবাহি মাছের মেলা। নানা জাত আর আকারের মাছের সমারোহ নিয়ে শুরু হয়েছে সিলেটের সর্ববৃহৎ মাছের মেলা। কুশিয়ারা নদীর পাড়ে প্রায় ২০০ বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে বসে এই ঐতিহ্যবাহি মেলা।

মঙ্গলবার (১৪ জানুয়ারি) দিন থেকে ভোর অব্দি পর্যন্ত এই মেলাটির স্থায়িত্বকাল। মেলাটি শুরু হয় সোমবার (১৩ জানুয়ারি) বিকেল থেকে।

সিলেটের হাকালুকি, টাঙ্গুয়া, কুশিয়ারা নদী, হাইল হাওর, কাউয়াদীঘি হাওর, বড় হাওর, সুরমা ও মনু নদীসহ সিলেট অঞ্চলের প্রাকৃতিক জলাশয়ের মাছ নিয়ে আসেন মৎস্য ব্যবসায়ীরা। মৌলভীবাজার, সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে হাওর, নদী, বিলসহ নানা জলাশয়ের মাছ নিয়ে এখানে আসেন ব্যবসায়ীরা। কোথাও তিল পরিমান জায়গা খালি থাকে না, সর্বত্র মানুষের আনাগোনা। কেউ মাছ ক্রয় করছেন, অনেকে আসছেন মাছের সমাহার দেখতে।

সরেজমিনে (মঙ্গলবার) ২টার দিকে শেরপুর মাছের মেলায় গিয়ে দেখা যায়, হাজারো ক্রেতা বিক্রেতায় মাছ মেলা জমে উঠেছে। হৈ হুল্লোড়, চিৎকার, চেঁচামেচির মধ্যেই চলছে মাছ কেনা বেঁচা। দরদাম চলছে ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যে।

বাজারের ব্যবসায়ী বরুণা নিবাসী নাসির আহমদ কুশিয়ারা থেকে সংগৃহিত ৩২ কেজি আইড় মাছের দাম হাঁকছেন ৬০ হাজার টাকা, মাছ ব্যবসায়ী আব্দুল আজিজ ভৈরব থেকে সংগৃহিত ১০ কেজি আইড় মাছের দাম হাঁকছেন ২২ হাজার টাকা, জমির মিয়া ২৫ কেজি মাশুল মাছের দাম হাঁকছেন ৪৫ হাজার টাকা, ১ মন মাশুল মাছের দাম হাঁকছেন ৮০ হাজার টাকা। মাছ ছাড়াও মেলা উপলক্ষে বসেছে নানা সৌখিন জিনিসপত্রের হাটবাজার। এদিকেও মানুষের ভিড় লেগেই আছে। সন্ধ্যা যত ঘনিয়ে আসছে, মানুষের ভিড় বাড়ছে।

বোয়াল, আইড়, বাঘাইড়, চিতল, কাতলা, বাউশ, কালাবাউশ, রুই; ছোট-মঝারি-বড় নানা আকারের মিঠা পানির সু-স্বাদু মাছ। কোনোটার আকার ১৫ কেজি, কোনটা আবার ৮ কেজি। কোনোটা ওজন ছাড়িয়ে গেছে ৫০ কেজি। সিলেট অঞ্চলের প্রাকৃতিক জলাশয়ের সুস্বাদু মাছ ক্রয় করতে দূর-দূরান্ত থেকে ক্রেতারা আগ্রহ নিয়ে আসেন এই মাছ মেলায়।

সন্ধ্যার পর বৈদ্যুতিক বাতি আর কুপির আলোয় ঝলমলে বড় বড় রুই-কাতলা আর চিতল-বোয়ালের রুপালি শরীর। পাইকার আর খুচরা ক্রেতা-বিক্রেতার হাঁকডাকে শীতের রাতে সরগরম হয়ে ওঠে কুশিয়ারার পাড়। এর টানে মাছের মেলায় জড়ো হন দেশ-বিদেশের লাখো মানুষ। এটাই এখানকার ঐতিহ্য।

মৌলভীবাজারের জেলা শহর থেকে প্রায় ২২ কিলোমিটার দূরে শেরপুর মাছের মেলা ঘুরে স্থানীয় মানুষের সাথে আলাপ করে জানা গেছে, ঐতিহ্যবাহী এই মেলা প্রতি বাংলা সনের পৌষ মাসের শেষ দিনে কুশিয়ারা নদীর পাড়ে শেরপুরে আয়োজন করা হয়।

এখানে রাত যত গভীর হয় বেচাকেনার হুলস্থুল ততই বাড়ে। দূর-দূরান্ত থেকে মাছ নিয়ে যেমন বিক্রেতারা আসেন, তেমনি আসেন পাইকারি ও খুচরা ক্রেতারা। একসঙ্গে বড়আকারের বিভিন্ন জাতের মাছ একসাথে দেখার সুযোগ হাতছাড়া না করতে নানা শ্রেণিপেশার মানুষ আসেন এখানে। তাঁরা ঘুরে ঘুরে মাছ দেখেন, দাম জানতে চান।

মেলার মধ্যে ঢুকতেই চোখে পড়ে আড়তে আড়তে স্তূপ করে রাখা নানা জাতের মাছ। পাইকার আর খুচরা ক্রেতা বিক্রেতারা নিজেদের মধ্যে দেনদরবার করে মাছ কেনা বেচা করেন। একেকটি আড়তে মাছের বাক্স-পেটরা খোলা হয়, আর দরদাম হাঁকা নিয়ে চলে চিৎকার-চেঁচামেচি।

পাইকারি মাছ ব্যবসায়ী দলা মিয়া বলেন, মাছের মেলা এ অঞ্চলের একটি ঐতিহ্য। মেলাকে কেন্দ্র করে এই এলাকা উৎসবমুখর হয়ে ওঠে। বৃহত্তর সিলেটের মধ্যে মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জের বিভিন্ন হাওর-নদীর মাছ ছাড়াও খুলনা, সাতক্ষীরা, যশোর, রাজশাহী, চাঁদপুর, ময়মনসিংহসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের মাছ এখানে আসে।

স্থানীয় বাসিন্দা আব্দুল মতিন বলেন, হাজার টাকার নিচে এখানে কোন মাছ পাওয়া যায় না। বড় ব্যবসায়ীরা সপ্তাহ খানেক পূর্বে বড় বড় মাছ সংগ্রহ করতে থাকেন। সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জের বিভিন্ন স্থান থেকে পাইকাররা এসে আড়ৎ থেকে ছোট বড় অনেক জাতের মাছ নিয়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়েন। মেলায় ছোট আকারের মাছের দাম হাকানো হয় ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা, মাঝারি সাইজের মাছের দাম হাঁকানো হয় ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা এবং বড় সাইজের মাছের দাম ৫০ হাজার থেকে ২ লাখ টাকাও হাঁকানো হয়। এক রাতেই মাছের মেলায় কোটি কোটি টাকার মাছ বিক্রি হয়ে থাকে। অনেকের ধারণা, মেলায় শত কোটি টাকার বাণিজ্য হয়।

সিলেট থেকে এসেছেন প্রবাসি আমিরুল ইসলাম। ১২ হাজার টাকায় কিনেছেন একটি চিতল মাছ। মৌলভীবাজারের আরেক ক্রেতা সাদিকুর রহমান ২৫ হাজার টাকায় কিনেছেন এ অঞ্চলের বিখ্যাত আইড় মাছ। এসময় তিনি বলেন, দাম বিষয় নয়। শখটাই বড়। পুরো বছর এ দিনটির জন্য অপেক্ষা করি। আরেক ক্রেতা আব্দুল হাকিম বলেন, আজকালের ছেলেমেয়েরা মাছ চেনেনা। তাদের মাছ চেনাতেই বাজারে নিয়ে এসেছি।

মাছ ব্যবসায়ী উমেদ মিয়া বলেন, লাখ টাকার মাছ নিয়ে এসেছি। আশা করছি ভালো বিক্রি হবে।

কুশিয়ারা নদীর প্রসিদ্ধ চিতল মাছ মেলায় তুলেন শামছুল ইসলাম নামে এক ব্যবসায়ী। প্রায় ২০ কেজি ওজনের চিতল মাছটি ৩২ হাজার টাকা দাম হাঁকছেন তিনি। হাকালুকি হাওর থেকে বিশাল আকারের ১ জোড়া কাতল ও ১ জোড়া বোয়াল নিয়ে এসেছেন হিরা মিয়া ও লাল মিয়া। কাতলের জোড়ার দাম হাঁকছেন ২৬ হাজার এবং বোয়ালের জোড়ার দাম হাঁকছেন ৪৮ হাজার টাকা। মাছের এমন দাম শুনে আশপাশের অনেকের চোখ ছানাবাড়া। তাঁরা বলেন, এ রকম দামের অনেক মাছ রাত ১২টার মধ্যেই বিক্রি হয়ে যায়।

স্থানীয় লোকজন জানান, বিভিন্ন সময় মনুর মুখ, পারকুল, শেরপুর বাজারে মাছের মেলার জায়গা বদল হলেও কখনও বন্ধ হয়নি। এদিকে মেলায় মাছ ছাড়াও গৃহস্থালী সামগ্রী, হস্ত শিল্প, গ্রামীণ ঐতিহ্যবাহী পণ্য, খেলনা সামগ্রী, নানা জাতের দেশীয় খাবারের দোকান, কাঠের তৈরী ফার্নিচার এবং সব ধরণের পণ্য পাওয়া পায়। মেলায় সস্তা দরে জিনিসপত্র ক্রয় করতে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে ক্রেতা-বিক্রেতারা এখানে আসেন।

এদিকে এক সময় মেলার অনুসঙ্গী হয়ে ওঠা পুতুল নৃত্যের আড়ালে অশ্লীল নৃত্য এবং জুয়ার আসর এখন আর বসে না। পুলিশ, প্রশাসন এবং জনপ্রতিনিধিদের তৎপরতায় এটা সম্ভব হয়েছে বলে জানান স্থানীয়রা। এতে সাংবাদিকসহ সচেতন মানুষের অন্যতম ভূমিকা রয়েছে।

যেভাবে যেতে হবে: ঢাকা থেকে মৌলভীবাজার যাওয়া যায় বাসে করে। অথবা ট্রেনে চড়ে শ্রীমঙ্গলে আসা যায়। মৌলভীবাজার ও শ্রীমঙ্গল থেকে বাস, সিএনজি চালিত অটোরিকশা কিংবা প্রাইভেট গাড়িতে শেরপুর মাছের মেলায় যাওয়া যায়।
কোথায় থাকবেন:মৌলভীবাজার জেলা শহর, কমলগঞ্জ ও শ্রীমঙ্গলে প্রায় শতাধিক আধুনিক হোটেল, রিসোর্ট রয়েছে। আছে পাঁচ তারকা মানের হোটেল থেকে শুরু করে ইকো রিসোর্টও।
সিলেটভিউ২৪ডটকম/১৪ জানুয়ারি ২০২০/ডেস্ক/পিডি

@

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন