Sylhet View 24 PRINT

কমলগঞ্জে ঐতিহ্যবাহী 'চুঙ্গাপিঠা উৎসব'

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০২০-০১-২২ ১৭:৪০:২০

জয়নাল আবেদীন, কমলগঞ্জ :: হারিয়ে যাচ্ছে সময়ের পরিক্রমায় সিলেটের একটি প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী চুঙ্গা পিঠা তৈরির ঢলুবাঁশও। চুঙ্গাপোড়া পিঠা আগের মতো শীতের রাতে খড়কুটো জ্বালিয়ে সারারাত চুঙ্গাপোড়ার দৃশ্যই ছিল আলাদা।

আধুনিকতার ছোঁয়ায় এখন আর গ্রামীণ এলাকার বাড়িতে বাড়িতে চুঙ্গাপোড়ার দৃশ্য চোখে না পড়লেও শীতের কনকনে রাতে ঘটা করে এরকম মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার ২নং পতনঊষার ইউনিয়নের পতনঊষার গ্রামে কবি জয়নাল আবেদীনের বাড়ীতে দেখা গেছে।

সঙ্গে ছিল গান, পুথি পাঠ, কবিতা আবৃত্তি, কৌতুকসহ বিভিন্ন পরিবেশনা। কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, সংস্কৃতিকর্মী, সমাজসেবীম কৃষক, শ্রমিকসহ বিভিন্ন শ্রেণি পেশার প্রায় দুইশত লোকের উপস্থিতিতে জমে উঠেছিল হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্য গ্রাম বাংলার চুঙ্গা পিঠ উৎসব।

রবিবার রাত ৯টা থেকে রাত ১টা পর্যন্ত চলে এই পিঠা উৎসব।
 
এখানে চুঙ্গাপিঠা উৎসব এসোসিয়েশনের আহবায়ক কবি জয়নাল আবেদীনের সভাপতিত্বে ও সদস্য সচিক মো. আব্দুল মুকিত হাসানীর পরিচালনায় শুরুতেই পুথিপাঠ করেন মো. আব্দুস শহীদ।

এ চুঙ্গা পিঠা উৎসবে উপস্থিত ছিলেন- প্রভাষক মোহাম্মদ আব্দুল আহাদ, সমাজসেবক অলি আহমদ খান, নাট্যকার ডা: মানিক চন্দ্র দেবনাথ, কবি আব্দুল হাই ইদ্রিছি, কমলগঞ্জ প্রেক্লাবের সহ-সভাপতি প্রনীত রঞ্জন দেবনাথ, বাংলাদেশ সাংবাদিক সমিতি কমলগঞ্জ ইউনিটের সভাপতি নুরুল মোহাইমীন মিল্টন, সাংবাদিক জয়নাল আবেদীন, কৃষক সংগঠক তোয়াবুর রহমান তবারক, সংস্কৃতিকর্মী মহসীন আহমদ কয়েছ, মুহিবুল ইসলাম, ওমর মাহমুদ আনছারী, কমরেড আফরোজ আলী, মিজানুর রহমান মিস্টার, আজিজুল হক পিপলু, হরমুজ আলী প্রমুখ।
 
প্রভাষক মোহাম্মদ আব্দুল আহাদ বলেন, পিঠা বাঙালীর খাদ্য সংস্কৃতির অন্যতম ঐতিহ্য। বাংলাদেশের প্রতিটি অঞ্চলে কোন না কোন পিঠা পাওয়া যায়। স্বাদ ও গুণে প্রত্যেক অঞ্চলের পিঠা অন্যন্য। দেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতো সিলেট অঞ্চলেও রয়েছে পিঠার নিজস্ব ঐতিহ্য। ঢলু বাঁশের লম্বা ছোট চোঙ্গায় বিন্নি চালের গুঁড়া। ‌'নাড়ার' আগুনে বাঁশের ভেতর সিদ্ধ হয়ে তৈরি হলো লম্বাটে সাদা পিঠা। চোঙ্গার ভেতরে তৈরি বলে এর নাম চুঙ্গাপিঠা।
 
কৃষক সংগঠক তোয়াবুর রহমান তবারক বলেন, ঐতিহ্যবাহী এ চুঙ্গাপিঠা তৈরির প্রধান উপকরণ ঢলু বাঁশ ও বিন্নি ধানের চাল সরবরাহ আধুনিকতার ছোঁয়ায় হ্রাস পেয়েছে। অনেক স্থানে এখন আর আগের মতো এসব ধান চাষাবাদও হয় না। এসব ধান দিয়েই চাল তৈরির পর শীতের এই মৌসুমে পিঠাপুলির আমেজ তৈরি হতো। পিঠাপুলির মধ্যে চুঙ্গা পিঠার জন্য পাহাড়ি এলাকা ছাড়া ও বিভিন্ন উপজেলার টিলায় টিলায়, চা-বাগানের টিলা ঢলুবাঁশ পাওয়া যেতো। জুড়ির চুঙ্গাবাড়ী ও এক সময় প্রসিদ্ধ ছিলো ঢলুবাঁশের জন্যে।

হত্তর সিলেট অঞ্চলে এক সময় শীত মৌসুমে ভাপা, পুলি আর মালপো পিঠার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে উৎসব মাতালেও এই পিঠার এখন দেখা পাওয়াই দুষ্কর। এক সময় বাড়িতে জামাই এলে এই চুঙ্গা পিঠার সঙ্গে হালকা মসলায় ভাজা মাছ বিরাণ ও নারিকেল ও কুমড়ার মিঠা বা রিসা পরিবেশন করতেন। কুয়াশা মোড়া রাতে রাতভর চলতো চুঙ্গাপুড়া তৈরি। কালের স্রোতে আজ হারিয়ে যেতে বসেছে।
 
চুঙ্গাপিঠা উৎসব এসোসিয়েশনের আহবায়ক ও আয়োজক কবি জয়নাল আবেদীন বলেন, চুঙ্গাপুড়া পিঠা খাওয়া ছিলো সিলেটের একটি অন্যতম ঐতিহ্য। অগ্রহায়ণে ধান উৎপাদনের পর ঢেঁকিতে ভাঙ্গা হতো দেশীয় প্রজাতির বিভিন্ন ধানের চাল। চাল ভেঙ্গে সেই চালের গুড়া দিয়ে চুঙ্গা পিঠা তৈরীতে ব্যতিব্যস্ত থাকতেন আমাদের মহিলারা। আর এই চুঙ্গা পিঠা তৈরির জন্য প্রয়োজন হতো পাহাড়ি ঢলু বাঁশের। এই বাঁশ কেটে আটি বেঁধে বাজারে বিক্রি করতেন আগেকার লোকজন। চুঙ্গা পিঠা তৈরীর জন্য বাজার থেকে অধিকাংশরাই ঢলু বাঁশ সংগ্রহ করা হতো।

তিনি আরও বলেন, এ ঐতিহ্য ধরে রাখতে প্রতিবছর বছরের ন্যায় এবার আমার নিজ বাড়ীতে পরিবারের পাশাপাশি বন্ধুবান্ধকে নিয়ে চুঙ্গার বাঁশ সংগ্রহ করে চুঙ্গা পিঠা বানানোর উৎসব চলে। এর মধ্য দিয়ে আত্বীয় সৃজনসহ এলাকার সকলের সাথে যোগসূত্রতাও তৈরি হয়। তাই এ উৎসব প্রতিবছর অব্যাহত থাকবে।
 
স্থানীয় প্রবীনরা জানান, বর্তমানে হারিয়ে যেতে বসেছে ঐতিহ্যবাহী চুঙ্গাপিঠা। কারণ ঢলু বাঁশ ছাড়া চুঙ্গাপিঠা তৈরী করা যায় না। এই বাঁশে অত্যধিক রস থাকায় এটি সহজে আগুনে পোড়ে না। এই সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে ঢলু বাঁশের চোঙ্গায় পিঠা তৈরির বিভিন্ন উপকরণ ঢুকিয়ে দীর্ঘ সময় আগুনের তাপে ভেতরের পিঠা সিদ্ধ করা হয়। যে বাঁশের চোঙ্গায় চাল ভরা হয় সেগুলো লম্বায় দুই থেকে তিন ফুট হয়ে থাকে। এগুলো স্থানীয়ভাবে ‘চুঙ্গার বাঁশ’ নামে পরিচিত।
 
ঢলু বাঁশের চোঙ্গায় পিঠা তৈরির উপকরণ ঢুকিয়ে ভিন্ন স্বাদের পিঠা তৈরি করা হয়। কেউ কেউ চোঙ্গার ভেতরে বিন্নি চাল, দুধ, চিনি, নারিকেল ও চালের গুঁড়া দিয়ে পিঠা তৈরি করেন। পিঠা তৈরি হয়ে গেলে তা চোঙ্গার ভেতরেই চোঙ্গা থেকে আলাদা হয়ে যায়। চুঙ্গা পিঠা পোড়াতে খড়ের প্রয়োজন হয়। এটি যে বাড়ীতে বানানো হতো হয় সে বাড়ীতে উৎসবের আমেজ দেখা যায়। আশে পাশের বাড়ীর ছোট বাচ্চারা এসে জড়ো হয় চোঙ্গা পোড়ানোর সময়। চুঙ্গা পিঠার বাঁশ আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু, বান্ধব, পাড়া-প্রতিবেশীদের দেয়া হতো। এখন চুঙ্গার অপ্রতুলতায়, আগ্রহের অভাবে চুঙ্গা পিঠা খাওয়া হয় না।


সিলেটভিউ২৪ডটকম/২২ জানুয়ারি ২০২০/জেএ/এসডি

সম্পাদক : মো. শাহ্ দিদার আলম চৌধুরী
উপ-সম্পাদক : মশিউর রহমান চৌধুরী
✉ sylhetview24@gmail.com ☎ ০১৬১৬-৪৪০ ০৯৫ (বিজ্ঞাপন), ০১৭৯১-৫৬৭ ৩৮৭ (নিউজ)
নেহার মার্কেট, লেভেল-৪, পূর্ব জিন্দাবাজার, সিলেট
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.