আজ শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ইং

প্রধানমন্ত্রী কওমি স্বীকৃতি উত্তম, শহীদুলকে মুক্তি দিন

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৮-০৮-২৯ ০০:২৮:৩৬

পীর হাবিবুর রহমান :: এবার ঈদের দিন সন্ধ্যায় এক অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলাম। সমাজের প্রতিনিধিত্বশীল বিভিন্ন পেশার লোকজন সেখানে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন। সবার সঙ্গে যখন কুশল বিনিময় করছিলাম, তখন হাল আমলের এক নব্য আওয়ামী লীগার ও টকশোর আলোচক সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, আপনার কাছ থেকে একটি আগুনঝরা লেখা আশা করেছিলাম। বিস্ময়ের সঙ্গে জানতে চাইলাম, কোন বিষয়ে? তিনি বললেন, কওমি মাদ্রাসার সঙ্গে দাওরায়ে হাদিসের সনদকে মাস্টার্স ডিগ্রি সমমান আইনের খসড়া নীতিগত অনুমোদন দেওয়ার বিরুদ্ধে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে বললাম, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যতগুলো ভালো কাজ করেছেন, এটা তার মধ্যে অন্যতম কৌশলগত দূরদর্শী পদক্ষেপ। আমি তো এটাকে সমর্থন করি। তিনি আর কথা বাড়ালেন না। মন খারাপ করে অন্যদিকে চলে গেলেন। আমি তাঁকে বলতে ভুলিনি যে, মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরাও এ দেশের সন্তান। এদের মূল ধারায় যুক্ত করা ও আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করার পদক্ষেপ নিতেই হবে।

বিভিন্ন দেশেই নয়, খোদ ব্রিটেনেও মাদ্রাসা শিক্ষা চালু রয়েছে। আমার সঙ্গে যুক্ত হলেন, ৭১ টিভির প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোজাম্মেল বাবু। তিনি বললেন, তাদের দূরে রাখব কেন? কাছে টেনে আধুনিক করব। সুমহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে জাতির মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠালগ্নে সত্তরের নির্বাচনে যে গণরায় নিয়েছিলেন, সেখানে বিপুল ভোটে আওয়ামী লীগ জয় লাভ করলেও দেখা গেছে, ধর্মভিত্তিক দলগুলো উলেস্নখযোগ্য সংখ্যক ভোট পেয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে একটি অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন জাতির জনক। একজন ধর্মপ্রাণ মুসলমান পরিবারের সন্তান তিনি যেমন ছিলেন, তেমনি আওয়ামী লীগের বিপুলসংখ্যক নেতা-কর্মী ছিলেন ধর্মপ্রাণ মুসলমান পরিবারের। ব্যক্তিগত জীবনে ধর্মীয় অনুশাসন তারা মেনে চললেও চিন্তা-চেতনায় ছিলেন অসাম্প্রদায়িক। মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষা থেকে বঙ্গবন্ধু ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কিন্তু পরিবার-পরিজনসহ তাঁকে হত্যা করার মধ্য দিয়ে যাঁরা পালাক্রমে ক্ষমতায় এসেছিলেন, তারা সেই চেতনাকে ভূলুণ্ঠিতই করেননি, ধর্মকে সামনে টেনে এনে ক্ষমতার রাজনীতি করেছেন।

সেনা শাসন থেকে পরবর্তী গণতান্ত্রিক শাসনামলগুলোতেও যখন যাঁরা ক্ষমতায় তাঁরাই মাদ্রাসা শিক্ষার প্রসার ঘটাতে অনুদান দিতে কার্পণ্য করেননি। দেশের উলেস্ন্লখযোগ্য সংখ্যক অনগ্রসর সমাজের সন্তানরা যেমন মাদ্রাসা শিক্ষা নিচ্ছেন, তেমনি এতিম সন্তানদের থাকা-খাওয়া ও পড়ালেখার ব্যবস্থাও করেছে মাদ্রাসাগুলো। এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ ধর্মপ্রাণ মুসলমান হলেও, জুমার নামাজে মসজিদগুলোতে মুসল্লিদের ঢল নামলেও, তুরাগের তীরে বিশ্ব ইজতেমায় লাখো মুসল্লির আলস্ন্লাহু আকবার ধ্বনিতে মুখরিত হলেও কোনো ধর্মীয় রাজনৈতিক শক্তিকে গণরায়ে যেমন কখনো ক্ষমতায় বসতে দেয়নি, তেমনি একুশে ফেব্রুয়ারিতে শহীদ মিনারমুখী হতে কিংবা বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের বর্ণাঢ্য উৎসব পয়লা বৈশাখে আনন্দের গণজোয়ারে ভাসতেও ভুল করেনি।

সুমহান মুক্তিযুদ্ধে সব ধর্ম-বর্ণের মানুষ যেমন অংশগ্রহণ করেছেন, নেতৃত্ব দিয়েছেন, যুদ্ধ করেছেন, রক্ত দিয়েছেন, তেমনি দেশকে উন্নয়নের পথে নিয়ে যেতে অনন্য অসাধারণ ভূমিকা রেখেছেন। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের দেশ হলেও জন্মগত চেতনার জায়গা থেকে বাংলাদেশ একটি অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে উদারনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে পশ্চিমাশক্তির কাছ থেকে মডারেট মুসলিম দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। আর ঐতিহ্যের বন্ধন হচ্ছে, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে নাগরিক অধিকার থেকে মানুষে মানুষে গভীর সামাজিক বন্ধন। সব নাগরিকের সমান অধিকার সাংবিধানিকভাবে নিশ্চিত করা হয়েছে। ধর্ম যার যার ব্যক্তিগত চর্চার বিষয় হলেও রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য ও ভালোবাসা সবার। জনপ্রতিনিধিরা প্রশাসন কিংবা সরকার অনুদানের খাতে মসজিদ-মন্দির-গির্জা এক কথায় সব ধর্মের উপাসনালয়কেই মর্যাদার সঙ্গে তালিকাবদ্ধ করেন। এখানে মুসলমানদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার উৎসব যেমন মুসলমানরা প্রাণভরে উপভোগ করেন, তেমনি হিন্দু সম্প্রদায় তাদের শারদীয় দুর্গাপূজা, খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীরা বড়দিন ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা বৌদ্ধ পূর্ণিমার উৎসব পালন করেন। এক ধর্মের উৎসবে অন্য ধর্মের স্বজনরা আমন্ত্রিত হয়ে অংশগ্রহণ করেন। ধর্মের ঊর্ধ্বে উঠে সামাজিক বন্ধনে বসবাসের ঐতিহ্য এখানে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া।

নানা সময়ে উপ-মহাদেশজুড়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা আমাদের জন্য বেদনার ক্ষত বয়ে এনেছে। সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী শান্তিবাদী মহাত্মা গান্ধীর মতো মহান নেতা উগ্রপন্থি হিন্দু ঘাতক নথুরাম গডসের হাতে জীবন দিয়েছেন। শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর মতো নেত্রীকে উগ্রপন্থি শিখ দেহরক্ষীর প্রতিহিংসার গুলিতে প্রাণ হারাতে হয়েছে। ধর্মনিরপেক্ষ ভারতে যেমন নানা সময়ে সাম্প্রদায়িক নিপীড়ন বা দাঙ্গা সুখকর হয়নি ও উগ্রপন্থিদের কাছে মানুষের চেয়ে গরুর মূল্য বেশি তখন তাদের উদার ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রীয় চরিত্রের ইমেজে আঁচড় বসে। আমাদের এখানে যখন নানা নিপীড়ন হামলা-দাঙ্গায় নানা সময়ে সংখ্যালঘুরা দেশ ছেড়ে চলে যায়, তখন অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক চিন্তা-চেতনায়ই আঘাত আসে না, মুক্তিযুদ্ধের গৌরবের অহংকার মাটিতে লুটিয়ে পড়ে এবং সংখ্যালঘুরা দেশ ছেড়ে চলে গেলে রাষ্ট্র তার সব ধর্ম-বর্ণ মানুষের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের সৌন্দর্য যেমন হারায়, তেমনি রাষ্ট্রের নাগরিক নিরাপত্তা হোঁচট খায়। ধর্মকে রাজনীতির বাইরে রেখে যেমন আমরা ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে জাতিসত্তার ওপর বাস করতে চাই, তেমনি কারও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করতে চাই না। মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের নাক ছিটকে যারা দূরে রাখতে চান, কার্যত প্রগতির নামে তারা ফ্যাশন করেন, মুখোশ পরে হাঁটেন। প্রগতি হচ্ছে সেটাই, যেটি ঐক্যবদ্ধভাবে সংঘবদ্ধ হয়ে সমাজকে এগিয়ে নেয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একদিকে একজন ধর্মপ্রাণ মুসলমানই নন, অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির ঐক্যের প্রতীকও। আরেকদিকে রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে তিনি জনগণের   প্রতিনিধি হিসেবে একদিকে যেমন বৈষম্যের অবসান করবেন, তেমনি সবার দাবি-দাওয়া আমলে নিয়ে বিদ্যমান নানামুখী অসন্তোষের অবসানও ঘটাবেন। হেফাজতে ইসলাম যখন শাপলা চত্বরে প্রলয় ঘটিয়েছিল, তখন তথাকথিত প্রগতিশীলরা রুখতে পারেননি; মোকাবিলা করতে হয়েছে সরকারকেই। রাষ্ট্র পরিচালনায় থাকলে সমাজের শান্তি-শৃঙ্খলা ও শান্তি নিশ্চিত করার দায়িত্ব তাদের ওপরই পড়ে। সেখান থেকে আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের উত্তম পথেই হেঁটেছেন।

কওমি মাদ্রাসার শিক্ষাকে স্বীকৃতি দিয়ে মূলধারায় ফিরিয়ে এনে তিনি দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন। এই শিক্ষাকে কওমি সনদের স্বীকৃতি আইনি কাঠামোতে এখন নিয়ে আসা হচ্ছে। সারা দেশে এখন ছয়টি বোর্ড কওমি মাদ্রাসাগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করছে। এদের নিয়ে সরকার এখন কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড গঠন করবে। যার কার্যালয় হবে ঢাকায়।

২০১৭ সালের ১১ এপ্রিল কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান শাহ আহমদ শফী, কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা পর্যালোচনা কমিটির আহ্বায়ক মাওলানা ফরীদউদ্দীন মাসঊদসহ কয়েকশ আলেমের উপস্থিতিতে এক অনুষ্ঠানে কওমির সনদকে স্বীকৃতি দেওয়ার ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রীর ওই ঘোষণাকে হেফাজতে ইসলামের মতো ইসলামী দলগুলোর কাছে ‘নতিস্বীকার’ হিসেবে দেখিয়ে বিভিন্ন বাম সংগঠন ও সুশীলসমাজের একটি অংশ সমালোচনাই করেননি, এটাকে বাংলাদেশে জঙ্গিরা জেঁকে বসতে পারে বলে হুঁশিয়ার করেন। এর জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যৌক্তিক বক্তব্যই দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, দেশের প্রায় ৭৫ হাজার কওমি মাদ্রাসা থেকে প্রতি বছর ১৪ লাখ শিক্ষার্থী বের হচ্ছে। তাদের জীবনটাকে কি আমরা ভাসিয়ে দেব? তারা কি এ দেশের নাগরিক না? তাদের জীবনের কি কোনো মূল্য নেই? তাদের কি আমরা অন্ধকারে ঠেলে দেব? তাদের কি আমরা আলোর পথ দেখাব না? সেদিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যথার্থই বলেছিলেন।

এখন মাদ্রাসা শিক্ষা নতুন পথ খুঁজে পাবে। সবার চোখের সামনে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিতই নয়, লেখাপড়ার কারিক্যুলাম এবং জাতীয় ইতিহাসের সঙ্গে সত্যের প্রতি পাঠ দেওয়া হবে। এ দেশে এক সময় গণবিচ্ছিন্ন বামপন্থিরা নিজেদের বাম বলে এক ধরনের অহংকার থেকে ফ্যাশনে দাঁড় করিয়েছিলেন। জনগণের আবেগ-অনুভূতি ও ধর্মীয় বিশ্বাস বুঝতে ব্যর্থ হয়েছিলেন বলে নিজেরা নিঃশেষ হয়েছেন। এ দেশের মানুষ কখনোই অতি ডান ও অতি বামের সঙ্গে যায়নি। মধ্যপন্থিই পছন্দ করেছে।

পশ্চিমবঙ্গে যেখানে বামরা ৩৫ বছর শাসন করেছে, সেখানে একই আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে এ দেশে দাঁড়িয়ে তারা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যাওয়ার মতো সংগঠন দাঁড় করানো দূরে থাক, বারবার জনসমর্থন আদায়ে ব্যর্থ হয়েছেন। এখনো যে কোনো স্থানীয় নির্বাচনে যে কোনো ইসলামপন্থি দলের প্রার্থীদের চেয়ে বামপন্থি প্রার্থীরা অনেক কম ভোট পান। বাস্তবতা ও সত্য থেকে দূরে থাকা বামপন্থিরা অন্যের কাঁধে চড়ে না হয় নিজেদের রাজনীতি ছেড়ে সংসদে বা সরকারে বিচ্ছিন্নভাবে ব্যক্তিগত অবস্থান থেকে ক্ষমতার অংশীদারিত্ব ভোগ করেছেন। আদর্শবাদী বামরা এখনো যাঁরা বাতি জ্বালিয়ে রেখেছেন, তারা সংগঠনই শক্তিশালী করতে পারেন না। একদল সুশীলেরও অবস্থা হয়েছে সেরকম। মানুষের ভাষা থেকে তাদের ভাষা অনেক দূরে। মানুষের বুকের ভাষা পড়তে না পারা তাদের কার্যত নির্বাসিত করে রেখেছে জনগণ থেকে। যারা মাদ্রাসা ছাত্রদের দিকে জঙ্গিবাদের অভিযোগ তুলে নাক সিটকাতেন তারা দেখেছেন, তারা নিজেরাই নন রাজনৈতিক শক্তি ও রাষ্ট্রযন্ত্রও সত্যের গভীরে পৌঁছতে কতটা ব্যর্থ হয়েছে। অনগ্রসর সমাজে গরিবের সন্তানরা মাদ্রাসায় গিয়ে ভয়ঙ্কর হয়ে না উঠলেও ধনীর দুলালরা বিজ্ঞান মনস্ক ইংরেজি শিক্ষা নিয়ে সমাজের সর্বোচ্চ সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে জঙ্গিবাদের খাতায় নাম লিখিয়েছে। হলি আর্টিজানের ট্র্যাজেডি আমাদের ঘুম ভাঙিয়ে দিয়েছে।

জঙ্গিবাদ কার্যত নির্দিষ্ট কোথাও বাস করে না। সন্ত্রাসবাদ-জঙ্গিবাদ চিন্তা ও মননে বাস করে। অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি থেকে জনগোষ্ঠীর বড় অংশকে আগে থেকেই দূরে না ঠেলে কাছে টেনে চিন্তা-চেতনার জগেক প্রভাবিত করার লক্ষ্য শেখ হাসিনার উত্তম সিদ্ধান্ত। শেখ হাসিনা জঙ্গিবাদ দমনে জিরো টলারেন্স নিয়ে যেমন অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন, তেমনি যেসব অল্পবিদ্যা ভয়ঙ্করী বা মূর্খ নাস্তিক হাল আমলের ফ্যাশন নিয়ে মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করেন, আলস্নাহ-রসুলকে নিয়ে কটাক্ষ করে মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে সমাজকে অশান্ত করতে চান, তাদের চিন্তাধারাকে বিকৃত বলে তিরস্কৃত করেছেন। জঙ্গি ও নাস্তিক দুটোই সমাজের অশান্তি। অনেকে যেমন ইসলামের শান্তির বাণীকে অপব্যাখ্যা করে জিহাদের নামে মানুষ হত্যার পথ নিয়েছেন, সন্ত্রাসের আগুন ছড়াতে চেয়েছেন, তাদের যেমন কঠিন হাতে দমন করেছেন, তেমনি মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করা নাস্তিকদেরও প্রশ্রয় দেননি। একটি গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় যে কেউ ধর্ম বিশ্বাসী নাও হতে পারেন। কিন্তু তিনি যেমন কারও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত বা উসকানি দিয়ে সমাজকে অশান্ত করতে পারেন না, তেমনি ধর্মের নামে জিহাদের কথা বলে কেউ আইনকে হাতে তুলে মানুষ হত্যার পথে পা বাড়াতে পারেন না।

কোরবানির ঈদ এলে অনেকে মুসলমানদের ধর্মীয় আবেগ-অনুভূতির প্রতি শ্রদ্ধা-সম্মান না রেখে একে পশুহত্যা বলে ব্যাপক প্রচারে নামেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মানবিক হয়ে ওঠেন। কিন্তু মুসলমানদের ওপর ধর্মীয়ভাবে এটি ওয়াজিব। মুসলমানরা আলস্নাহর সন্তুষ্টির জন্য আত্মত্যাগের মহিমায় পশু কোরবানি দিয়ে থাকেন। সারা বছর যারা মাংস খান, রোজ অজস্র জবাই হওয়া পশুর খবর রাখেন, তারাও এই সময় কোরবানি নিয়ে এক ধরনের জিগির তোলেন। নাস্তিকদের সঙ্গে বুঝে না বুঝে অনেকে তাল দেন। গেল বছরও ধর্মের মর্মবাণী ধারণ ও লালনে ব্যর্থ যাঁরা অসুস্থ প্রতিযোগিতা থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কিনে আনা অধিক চড়া মূল্যের পশুর ছবি দিতেন, এমনকি কোরবানির রক্তাক্ত পশুর ছবি দিতেন সমালোচনার মুখে তাঁরা সেটি কমিয়েছেন। আলস্ন্লাহর নৈকট্যের জন্য যার যার সামর্থ্য অনুযায়ী পশু কিনবেন। কোরবানি দেবেন। এ নিয়ে অসুস্থ প্রতিযোগিতার কোনো কারণ নেই। এটি অশোভন। লোক দেখানোর বিষয় নয়। সমাজে নামডাক বাড়ানোর বিষয় নয়। যার সামর্থ্য নেই, তিনি কোরবানি দেবেন না। তেমনি যারা কোরবানি বিশ্বাস করেন না, তারাও কোরবানি না দিতে পারেন।

ধর্মীয়ভাবে সব বিচারের মালিক আলস্ন্লাহ নিজে, তেমনি নিজে কোরবানি দেবেন না আপত্তি নেই। কিন্তু অন্যের কোরবানিকে পশু হত্যার নির্দয়তা বলে মানবিকতা দেখানো আরেকজনের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়া যেটি গ্রহণযোগ্য নয়। বৌদ্ধ ধর্মের প্রবর্তক গৌতম বুদ্ধ বলেছেন, জীব হত্যা মহাপাপ। চীনেও কুকুর হত্যার উৎসব হয়। মিয়ানমারে চলে গণহত্যা। মানুষ হত্যায় যাদের প্রতিবাদে মুখর হতে দেখা যায় না, তারাও কোরবানি নিয়ে অতিমানবিক হয়ে ওঠেন। অনেকের ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে ইসলামের সমালোচনা, মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়া এবং মুসলমানদের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান নিয়ে প্রশ্ন তোলাই যেন নাস্তিকতা। যেন আধুনিকতা, বিজ্ঞানমনস্কতা ও প্রগতিশীলতা! এটা সমাজকে অশান্ত করে। জঙ্গি, নাস্তিক কারও উগ্রতায় সমাজের শান্তি বয়ে আনে না। সবাইকে এখানে সতর্ক থাকা উচিত।

আগস্ট মাসের শুরুতে নিরাপদ সড়কের দাবিতে ছাত্রদের উত্তাল আন্দোলন সরকারসহ সব মহলের সমর্থন পেয়েছে। আন্দোলনের শেষ পর্যায়ে গুজব, সন্ত্রাস অনেক ঘটনাই ঘটে গেছে।  সবকিছুই আমাদের সবার জানা। আন্দোলনের এই মহাপ্রলয়ে গোটা রাষ্ট্রযন্ত্র ও জনগণ প্রবল ঝাঁকুনি খেয়েছে। ফিটনেসবিহীন গাড়ি, লাইসেন্সবিহীন চালক নিষিদ্ধ করাসহ শাস্তির বিধান নিশ্চিত করে আইনও হয়েছে। সব দাবি সরকার মেনেও নিয়েছেন। তবুও সড়ক দুর্ঘটনায় একের পর এক মানুষের মৃত্যুর মিছিল থামছে না। কর্তৃপক্ষ বসে নেই। নিরাপদ সড়কের জন্য কাজ করছেন। প্রশাসনকে আরও বেশি কঠোর ও দায়িত্বশীল যেমন হতে হবে, তেমনি আমাদের জনগণকেও সচেতনতা বাড়াতে হবে। সড়কে পরিবহন চালকরা যেমন বেপরোয়া তেমনি রাস্তা পারাপারে চলাফেরায় নাগরিকরা দায়িত্বহীন। অস্থিরতায় ফুটপাথ দিয়ে চলছে মোটরসাইকেল আরোহীরা। রাজপথে পালস্না দেয় লেগুনা। সবাইকে আইন ও নিয়মনীতি না মানলে সব বিফলে যাবে। এই আন্দোলন ঘিরে অনেক গুজব হয়েছে। হামলা হয়েছে। সন্ত্রাস হয়েছে। গুজব রটনাকারী থেকে আন্দোলনে শরিক হওয়া আটককৃত প্রায় অর্ধশত ছাত্রকে সরকার ঈদের আগে মুক্তি দিয়ে প্রশংসা কুড়িয়েছে। সবার আকুতি প্রধানমন্ত্রী গ্রহণ করেছেন। এ জন্য ধন্যবাদ জানাতে হয়। আলোকচিত্রী শহীদুল আলমের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত কোনো পরিচয় নেই। দেশ-বিদেশজুড়ে তার যে এত নামডাক, এত খ্যাতি ও কৃতিত্ব তার সবটাও গ্রেফতার না হলে আমার জানা হতো না। এটা আমার অজ্ঞতা।

আল-জাজিরায় ছাত্রদের নিরাপদ সড়কের আন্দোলন নিয়ে বক্তব্য রাখতে গিয়ে সরকারবিরোধী কঠোর কথাও বলেছেন। সরকারবিদ্বেষী একটা মনোভাব ফুটে উঠেছে। কিন্তু এটা দেখা যায়নি, তিনি সরকার উত্খাতে কোনো ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন। তার মুক্তির জন্য দেশে-বিদেশে অনেকেই দাবি তুলেছেন। তার রিমান্ড হয়েছে। তার মায়ের হাতে আগের শাসনামলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বাধীনতা পদকও তুলে দিয়েছেন। সরকারদলীয় কট্টর সমর্থকরা শহীদুলকে কঠিন সমালোচনার তীরে ক্ষত-বিক্ষত করে তার চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করেছেন। সে সবের যাচাই-বাছাই করতে আমি যাচ্ছি না। বিশ্বনন্দিত ১১ জন নোবেল বিজয়ী বিনাশর্তে তার মুক্তি চেয়ে বিবৃতি দিয়েছেন। শান্তিতে নোবেলজয়ী ডেসমন্ড টুটুও রয়েছেন। এ ছাড়া ১৭ জন বিশিষ্ট ব্যক্তি তার মুক্তি চেয়েছেন। যাদের মধ্যে নরওয়ের সাবেক প্রধানমন্ত্রী, বোম্বের নায়িকা শাবানা আজমি, হলিউডের শ্যারন স্টোনও রয়েছেন। চমস্কি থেকে অরুন্ধতি রায়, অর্থনীতিতে নোবেলজয়ী অমর্ত্য সেনও চেয়েছেন।

তথ্য-প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় আটক শহীদুল আলম একজন উচ্চশিক্ষিত আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চিত্রগ্রাহক। তার জন্য বাইরের দুনিয়া থেকে যেভাবে বিবৃতি এসেছে সেভাবে এত ছাত্রের গ্রেফতারে কারও মানবতা জাগতে দেখা যায়নি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছোটবোন শেখ রেহানার কন্যা টিউলিপ সিদ্দিক ব্রিটেনের পার্লামেন্ট সদস্য হিসেবে শহীদুল আলমের মুক্তি চেয়েছেন। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশকে তার নিজের নাগরিকদের বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক মানদ- মেনে চলতে হবে। দ্য টাইমস এই সংবাদ দিয়েছে। শহীদুলকে যখন আটক করা হয়, তখন নির্মম গুজব ছড়িয়ে ধানমন্ডির আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে হামলা চালানো হয়েছে। সেই সময় কর্তব্যরত ফটো সাংবাদিকদের ওপরও সন্ত্রাসীরা হামলা চালায়। সেই হামলাকারীদের গ্রেফতার করা হোক। কিন্তু মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে নিবেদন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে কারারুদ্ধ করা হলেও, যেখানে বিদেশে কোনো প্রতিক্রিয়া হয়নি, সেখানে একজন প্রখ্যাত আলোকচিত্রী শিল্পী শহীদুল আলমের গ্রেফতার বিশ্ব বিবেককে নাড়িয়েই দেয়নি, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলছে। সরকারের ইমেজের জন্য, দেশের ইমেজের জন্য বিষয়টি গভীরভাবে চিন্তা করার মতো। বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনা শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, লেখকদের জন্য আলাদা মমত্ববোধ রাখেন। সেই জায়গা থেকে সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে অনুরোধ করছি, আইনি প্রক্রিয়ায় আলোকচিত্রী শিল্পী শহীদুল আলমকে মুক্তি দিন। একজন খ্যাতিমান ক্রিয়েটিভ লোক। রাজনীতি করেন না। ড়্গমতায়ও যেতে চাননি। যথেষ্ট শাসিত্মভোগ হয়েছে তার। দয়া করে এবার তাকে মুক্তি দিন।

লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন