আজ বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪ ইং

সিনেমা ভাঙলে মিলন আনন্দ দেয় বিচ্ছেদ কাঁদায়

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৮-০৯-১৯ ০০:৩৮:৫৪

পীর হাবিবুর রহমান :: ছেলেবেলায় সিনেমা হলে দিনদুপুরে ছবি দেখতে যেতাম। সেই শোটি ছিল মেটিনি শো। স্কুল ছাত্ররাই এই শোতে বেশি দর্শক থাকতেন। নায়কের হাতে খলনায়কের মার খাওয়া ও নায়িকার সঙ্গে শত ঝড়-ঝাপটার পর মহামিলনের দৃশ্যতে তুমুল করতালি দিয়ে যখন দর্শকরা বের হয়ে আসতেন, তখন বাইরের রোদ ও আলো চোখ ধাঁধিয়ে দিত। তবু নায়ক-নায়িকার মিলন দৃশ্যের মধ্য দিয়ে সিনেমা ভাঙলে দর্শকরা খুশি হতেন। মুগ্ধ হতেন। বিচ্ছেদ হলে অনেকে মন খারাপ করতেন। কেউ কেউ কাঁদতেন।

বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে সরকার ও বিরোধীপক্ষের যার যার অনড় অবস্থান এখনো বহাল তবিয়তে রয়েছে। সব দলের অংশগ্রহণে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ভোট উৎসবের আশা নিয়ে দেশের মানুষ বসে আছে। দেশজুড়েই প্রার্থীদের শোডাউন, সমাবেশ, জনসংযোগের মধ্য দিয়ে নির্বাচনী হাওয়া বইছে। জাতীয় রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি পরস্পরের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাল্টা অভিযোগ এনে বাহাস চালিয়ে যাচ্ছে। নির্বাচন ঘিরে রাজনীতি এখনো অমীমাংসিত পথে হাঁটছে।

জাতীয় ঐক্যের নামে সরকারবিরোধী মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সব শক্তিকে নিয়ে একটি বৃহত্তর ফ্রন্ট গঠনের চেষ্টাও জোরেশোরে চলছে। বিএনপি ইতিমধ্যে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও তাবিথ আউয়ালকে নিইয়র্কের জাতিসংঘের সদর দফতরে পাঠিয়ে তাদের মধ্যস্থতা চেয়েছে।

ভোটের হাওয়া যেমন বইছে, নির্বাচন ঘিরে উত্তাপ, উৎকণ্ঠা-উদ্বেগও তেমনি বাড়ছে। শেষ পর্যন্ত বিএনপি নির্বাচনে আসবে কিনা, শেষ পর্যন্ত শান্তিপূর্ণভাবে সবার অংশগ্রহণে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হচ্ছে কিনা এসব নিয়ে নানা প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে। জাতীয় রাজনীতিতে সরকারপক্ষ থেকেও নির্বাচন বানচলের ষড়যন্ত্রের অভিযোগ যেমন উঠেছে, তেমনি রাজনৈতিক মহল থেকে রাজনৈতিক-সচেতন মানুষেরা এ আশঙ্কা উড়িয়ে দিচ্ছেন না। এরই মধ্যে সোমবার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ওয়াশিংটন ভিত্তিক বেসরকারি সংস্থা ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনাল নির্বাচন ঘিরে ‘শান্তিতে বিজয় শীর্ষক’ প্রচার কর্মসূচি উদ্বোধন করেছে।

বাংলাদেশের সব দলের অংশগ্রহণে অবাধ-সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের প্রত্যাশা করেছেন কূটনীতিকরা। দেশের ৪০ জেলায় এ সংস্থা শান্তিতে প্রচার অভিযান শুরু করে। সোমবারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সারা দেশ থেকে দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সাড়ে চারশ নেতা-কর্মী যোগ দেন। এ সময় তারা দেশের শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখতে শপথবাক্য পাঠ করেন। বাংলাদেশে নিযুক্ত আমেরিকার রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাট বলেন, একটি গণতান্ত্রিক দেশের জন্য, বিশেষ করে মধ্যম আয়ের দেশ হওয়ার পথে থাকা একটি রাষ্ট্রের জন্য অবাধ, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সব রাজনৈতিক দল, ব্যক্তি শান্তিপূর্ণ পরিবেশে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারে, সেই পরিবেশ তৈরি করতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মসূচি ও বক্তব্য বাধাহীনভাবে সারা দেশে প্রচারের সুযোগ দিতে হবে। আগামী নির্বাচনের মাধ্যমে যারাই ক্ষমতায় আসুক, তাদের মেনে নেওয়ার মানসিকতা থাকতে হবে রাজনৈতিক দলগুলোর। তিনি বলেন, নির্বাচনের আগে ও পরে নির্বাচনী সহিংসতা যেন না হয়, সেজন্য বাংলাদেশি ভোটারদের এখনই রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর চাপ দেওয়া উচিত। নির্বাচন প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম বলেন, সুষ্ঠু, স্বচ্ছ, অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আওয়ামী লীগের প্রতিজ্ঞা। এ প্রতিজ্ঞা থেকে আওয়ামী লীগ সরে আসবে না। নির্বাচনে ভুল, মিথ্যা, বিদ্বেষপূর্ণ প্রচারণা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়ে এইচ টি ইমাম বলেন, সত্যকে সত্য বলব। অনর্থক কাউকে গালি দেব না। এসব যদি আমরা করতে পারি, তাহলে ভবিষ্যতে শান্তিতে, উৎসবে নির্বাচন করতে পারব। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. মঈন খান বলেন, শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের আগে রাজনীতিতে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত করা জরুরি।

সংস্থাটির প্রধান উপস্থিত দুই দলের নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে বলেন, আপনারাই আপনাদের দলের প্রতিধ্বনি। আপনাদের দৃঢ় অংশগ্রহণই আমাদের আশ্বস্ত করে আগামী নির্বাচন হবে অংশগ্রহণমূলক। অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. মঈন খানের উষ্ণ করমর্দন দৃশ্য গণমাধ্যমে ঠাঁই পেয়েছে। অনুষ্ঠানের ভিতরে যারা উপস্থিত ছিলেন দুই পক্ষের এ মহামিলন দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হয়েছেন। কিন্তু শান্তিতে বিজয় সিনেমার মিলন দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হয়ে বের হয়ে এসে বাইরে রাজনীতিতে দুই পক্ষের মধ্যে যখন সমঝোতা বা শান্তি ও সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক দেখছেন না, দেখছেন তিক্ততা আক্রমণ পাল্টা আক্রমণের ভাষা, তখন বিরহ-বিচ্ছেদে যন্ত্রণা ভোগ করছেন। কাঁদছেন না তবে মন খারাপ করছেন সেই সিনেমার বিয়োগান্ত বিচ্ছেদ দৃশ্যের মতন।

এ দেশের মানুষের কাছে সব বড় উৎসবের মধ্যে জাতীয় নির্বাচনে গণরায় প্রদানের ভোট উৎসব অন্যতম। যখন নির্বাচনের প্রতি আস্থা-বিশ্বাস নিয়ে সব দল স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করে, তখন সেটি হয় ভোট উৎসব। আর যখন এক পক্ষ ভোটের পক্ষে আরেক পক্ষ বর্জন-প্রতিরোধ আন্দোলনে নামেন তখন দেখা দেয় সন্ত্রাস-নৈরাজ্য ও রক্তক্ষয়ী ঘটনাগুলো। কখনো-সখনো নির্বাচন বানচালের মধ্য দিয়ে অগণতান্ত্রিক শক্তিরও আগমন ঘটে যায়। যা শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক শক্তি, দেশ ও মানুষের জন্য কার্যত কল্যাণ বয়ে আনে না। নিকট অতীতের ওয়ান-ইলেভেন তারই একটি। যদিও শোনা যাচ্ছে বিএনপি প্রয়োজনে কারাবন্দী বেগম খালেদা জিয়াকে বাদ দিয়েই তার মুক্তি ইস্যুতে সরকার বদলের সেøাগান তুলে ভোটযুদ্ধে অংশগ্রহণ করবে। কিন্তু সেলুলয়েডের ফিতায় বা রাজনীতির ক্যানভাসে এখনো তারা নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন ও বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি এবং নির্বাচনের পরিবেশ নিশ্চিত করার দাবিতে অনড় রয়েছে।

সরকার বিএনপির সংলাপের প্রস্তাব বার বার নাকচ করে দিয়ে মহাজোটগতভাবে নির্বাচনের পথেই হাঁটছে। এরশাদের জাতীয় পার্টি সরকারি দল আওয়ামী লীগের জন্য ভোটযুদ্ধের বড় মিত্র শক্তি হলেও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ ও মহাসচিব এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদারকেও নানামুখী মনস্তাত্ত্বিক চাপে রেখেছে। জাতীয় পার্টির অন্দর মহলেও কথা হচ্ছে, এরশাদকে বেদনাহত করে ঐক্য স্বতঃস্ফূর্ত আস্থা-বিশ্বাসের ওপর দাঁড়াতে পারে না। জাতীয় পার্টিকে ভোটযুদ্ধে সম্পূর্ণভাবে পাশে রাখতে চাইলে এরশাদের মানসিক স্বতঃস্ফূর্ত আস্থা ও বিশ্বাস দিয়েই তার ওপরই ভরসা করতে হবে।

বিএনপি তার দীর্ঘদিনের মিত্র নির্বাচন কমিশনে বাতিল হওয়া যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত জামায়াতকে এখনো ছাড়েনি। যুক্তফ্রন্টের কেউ কেউ এটাকে আমলে না নিলেও বিকল্প ধারা যেমন এদের সঙ্গে পরোক্ষ ঐক্য রাখা যাবে না বলছে, তেমনি ড. কামাল হোসেন পরিষ্কার বলেই দিয়েছেন, জামায়াত নিয়ে ঐক্যের প্রশ্নই আসে না। সরকারের মহাজোটের বিপরীতে বিরোধী শিবিরের বৃহত্তর ঐক্যের মঞ্চ এখনো তাই দৃশ্যমান হওয়া দূরে থাক, গড়েই ওঠেনি। ভাবমূর্তির বিচারে যুক্তফ্রন্ট ও জাতীয় ঐক্যের নেতারা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে বিএনপির কাছে যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনি ভোটযুদ্ধের শক্তির অঙ্কে নিবন্ধন বাতিল জামায়াতের বিষয়টি আরও বেশি প্রয়োজনীয়। যদিও অনেকে বলছেন, রাজনৈতিক ইতিহাসে এমন দুঃসময় অতিক্রম করছে বিএনপি যে বৃহত্তর ঐক্য গড়তে বিএনপি সর্বোচ্চ ছাড় দিতে রাজি হবে। কিন্তু জামায়াতকে বাদ দিয়ে বিএনপির পক্ষে কতটা সম্ভব সেটি আগামী কয়েক দিনের মধ্যে পরিষ্কার হয়ে যাবে।

নানা কারণে সরকারবিরোধী যে জনমত তৈরি হয়েছে, সেটি বিএনপির ভোট রাজনীতির জন্য যেমন লোভনীয় বিষয়, তেমনি তার নেতা-কর্মীদের ওপর ধরপাকড়ের অভিযান ততটা উদ্বেগ ও ভীতির। এতকিছুর পরও সবার প্রত্যাশা এবার নির্বাচন হবে সব দলের অংশগ্রহণে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ। যে নির্বাচনে বড় দল হয়ে বিএনপিকেই সর্বোচ্চ ছাড় দিতে হচ্ছে না, তারা নির্বাচনে যোগ দিলে আওয়ামী লীগের মতো শক্তিশালী রাজনৈতিক শক্তিকেও ভোটের পাল্লায় জেতার জন্য এরশাদের জাতীয় পার্টিসহ বাকি শরিকদেরও বড় ধরনের ছাড়ই দিতে হবে।

দেশের রাজনৈতিক মঞ্চে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে দৃশ্যমান সংলাপ, আলাপ-আলোচনা বা সমঝোতা দেখা না দিলেও পর্দার অন্তরালে বিদেশি গণতান্ত্রিক বন্ধু শক্তির অনুঘটকের ভূমিকা সমঝোতা তৈরিতে ভূমিকা রাখবে না এমনটি নিশ্চিত বলা যায় না। অতীতের রাজনৈতিক ইতিহাস ঘাঁটলে সেই আলামতও পাওয়া যায়। যেমন ১৯৯৬ সালে জাতীয় নির্বাচনের আগে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ডেভিড এন মেরিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে পর্দার আড়ালেই মধ্যস্থতা করেছিলেন।

শান্তিতে বিজয় উদ্বোধনের রাতে চ্যানেল আই টকশোতে এটিকে দুই দলের মহামিলনের সিনেমা ভাঙার দৃশ্যের সঙ্গে তুলনা করে বলেছিলাম, বাইরে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতাদের মধ্যে সামাজিক সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কের চিত্রপট দেখা যায় না। আনুষ্ঠানিক সংলাপ দূরে থাক, অনানুষ্ঠানিক আলোচনাও নিজেরা করছেন না। কেউ কারও সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানে যোগ দিচ্ছেন না। প্রশ্ন রেখেছিলাম, প্রতীকী অর্থে এইচ টি ইমাম ও ড. মঈন খান একে অন্যের অসুস্থতার কথা শুনলে দেখতে যান কিনা? যদিও টকশো শেষে সঞ্চালক মতিউর রহমান চৌধুরীকে ড. মঈন খান টেলিফোন করে বলেছেন, এইচ টি ইমাম যখন অসুস্থ ছিলেন, তখন তিনি তাকে দেখতে গিয়েছিলেন। রাজনীতির এ সৌহার্দ্য আমাদের ঐতিহ্যের অংশ। যদিও আজ তা তিরোহিত হয়ে গেছে। এখানে এইচ টি ইমাম ও ড. মঈন খানকে ব্যক্তিগতভাবে বলা হয়নি, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতাদের প্রতীকী অর্থে আনতে গিয়ে তাদের নাম বলা হয়েছে। আমরা জানি, একুশের গ্রেনেড হামলা ও পরবর্তীতে বিএনপি সরকারের ভূমিকা সমঝোতার রাজনীতি শেষ করে ক্ষতের সৃষ্টি করেছিল। পুত্র হারা শোকার্ত খালেদা জিয়াকে দেখতে গেলে শেখ হাসিনাকে প্রবেশ করতে না দেওয়ার অপমান সেই ক্ষতের ঘা বাড়িয়েছে। এর মধ্যে ১০ অক্টোবর গ্রেনেড হামলার বিচারের রায় দুই পক্ষের দূরত্ব আরও বাড়াবে বলেই মনে করেন অনেকে।

শান্তিতে বিজয় উদ্বোধনী অনুষ্ঠানকে যদি সেলুলয়েডের বা সিনেমার মহামিলনের দৃশ্যের সঙ্গে তুলনা করে মুগ্ধ হই তাহলে বলতে হয়, সেখানকার সিনেমায় মিলন দৃশ্য মুগ্ধ করলেও মানুষকে বাইরের বিচ্ছেদ ও প্রতিহিংসার রূপ যন্ত্রণাবিদ্ধ করে রাখে। এ যন্ত্রণা থেকে পরিত্রাণ পেতে চায় মানুষ। মিলন দৃশ্যের সুখ নিয়ে সব দলের অংশগ্রহণে ভোট উৎসবে মেতে উঠতেই প্রস্তুত বাংলাদেশ।

ভোটের চ্যালেঞ্জ আন্দোলনের অংশবিশেষ হলেও বিএনপির জন্য গ্রহণ করা অনিবার্য। এ নির্বাচন আওয়ামী লীগের জন্য যেমন আবার ক্ষমতায় এসে জাতির জনকের শতবর্ষ উদযাপন এবং রাষ্ট্রের জন্মের সুবর্ণ জয়ন্তী পালন করা স্বপ্নের, তেমনি বিএনপির জন্য এ নির্বাচন অস্তিত্ব রক্ষা বা ঘুরে দাঁড়ানোর সর্বোত্তম লড়াই। ভোট ঘিরে বিচ্ছেদ নয়, বিরহ নয়, মহামিলনের উৎসবই দেখতে চায় বাংলাদেশ।

আমাদের সবার আকুতি, সম্পাদক পরিষদ থেকে গণমাধ্যম কর্মীদের সব মতামত, প্রস্তাব অগ্রাহ্য করে শেষ পর্যন্ত সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের আশ্বাস নির্বাসনে পাঠিয়ে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের বহুল বিতর্কিত ৫৭ ধারার বিষয়গুলো নানাভাবে বহাল রেখে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংসদে পাস করতে যাচ্ছে সরকার। সংসদীয় স্থায়ী কমিটি সোমবার বিলটি সংসদে উত্থাপন করেছে। স্বাধীন গণমাধ্যমের সঙ্গে ও সংবিধান প্রদত্ত অধিকারের সঙ্গে সাংঘর্ষিক এ আইনটি পাস হলে ইতিহাসে কালো আইন হিসেবেই চিহ্নিত হবে না; গণমাধ্যমের কণ্ঠ চেপে ধরা হবে। গুপ্তচরবৃত্তি শব্দটি বাদ দিলেও ‘কলোনিয়াল যুগের অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট’ অন্তর্ভুক্ত করে এর পরিধি আরও বড় করা হয়েছে। অর্থাৎ ডিজিটাল মাধ্যমে কেউ অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট ভঙ্গ করলে বা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ভঙ্গ করলে সর্বোচ্চ ১৪ বছর কারাদ- হবে। আইনে গ্রেফতারি পরোয়ানা ছাড়া তল্লাশি ও গ্রেফতারের ক্ষমতা বহাল আছে। এক্ষেত্রে শুধু ডিজিটাল নিরাপত্তা এজেন্সির মহাপরিচালকের অনুমতি নেওয়ার বিধান যুক্ত করা হয়েছে। মানহানির তথ্য প্রকাশের বিরুদ্ধে কঠোর বিধান করে মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে খর্ব করা হয়েছে। কার্যত এটা নিবর্তনমূলকই হবে না, পুলিশকে বেপরোয়াই করবে না, ক্ষমতাসীন শক্তি অপব্যবহারও করবে।

এ উপমহাদেশে আওয়ামী লীগ একটি প্রাচীন গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। এ দেশের সব গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়েছে আওয়ামী লীগ। সব গণতান্ত্রিক আন্দোলন স্বাধিকার-স্বাধীনতা ও সুমহান মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানের মহিমায় উদ্ভাসিত আওয়ামী লীগ আজ ক্ষমতায় থেকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের নামে যে খড়গ নামিয়ে আনছে আজ তা আমলে না নিলেও যখন ক্ষমতায় থাকবে না, তখন তার চড়া মাশুল নিয়ত গুনতে থাকবে এ কথা আগাম বলা যায়। ৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইন ৭৫-এর পর ২১ বছর আওয়ামী লীগকে নিপীড়নে সহায়ক হয়েছে। আওয়ামী লীগের কর্মকা-কেই বিরোধী দলে গেলে এ আইন বাধাগ্রস্ত করবে না, আওয়ামী লীগের পাশে দাঁড়ানো দূরে থাক, স্বাধীনভাবে মানুষের জন্য গণমাধ্যমের সাহসী ভূমিকা রাখার শক্তিটিও সেদিন কেড়ে নেবে। এখনো যদি সময় থাকে সরকারকে আরও সময় নিয়ে এটি আইনে পরিণত করার আগে বিবেচনা করা জরুরি।

কোটা সংস্কার আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে অবশেষে সরকার গঠিত কমিটি যে রিপোর্ট দিয়েছে, সেখানে বিসিএস ক্যাডার, ননক্যাডার সার্ভিসের প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি কর্মচারী নিয়োগে সব কোটা তুলে দেওয়ার প্রস্তাব করেছে। সার্বিক বিবেচনায় এটাকে গ্রহণযোগ্য বলা যায়। এখন সরকারকে তা গেজেট আকারে প্রকাশ করার সময় কড়া নাড়ছে।

এদিকে ডাকসু নির্বাচন নিয়ে উচ্চ আদালতের রায়ের দীর্ঘ সময় পার করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সব ছাত্র সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। অন্যদিকে মার্চের আগে নির্বাচন নয়, এমন সিদ্ধান্তে উচ্চ আদালতের রায় স্থগিত করতে লিভ টু-আপিল করেছেন। জাতীয় নির্বাচনের আগে ডাকসু নির্বাচন সম্ভব নয়। কিন্তু দেশের মানুষ যেমন চায় সব দলের অংশগ্রহণে উৎসবমুখর জাতীয় নির্বাচন, তেমনি জাতীয় নির্বাচনের পর ডাকসুসহ সব নির্বাচন ও কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচন সময়ের দাবি হয়ে উঠেছে। না হয়, কোটা সংস্কার আন্দোলন ও সড়ক দুর্ঘটনা ঘিরে নিরাপদ সড়কের দাবিতে ন্যায় বিচার, রাষ্ট্রীয় সংস্কারের আকুতি জানিয়ে বালক-বালিকারা যে মহাপ্রলয় ঘটিয়েছে, সেখান থেকে শিক্ষা নিয়ে বলা যায়, ছাত্রসমাজের অধিকার আর হরণ করা যাবে না।

২৮ বছর ডাকসুসহ সব কলেজ ছাত্রসংসদ নির্বাচন বন্ধ রেখে এ দেশের ছাত্রসমাজের গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক থেকে কর্মচারীরা, সিনেট প্রতিনিধিরা তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার ভোগ করলেও ছাত্রছাত্রীদের সব অধিকার হরণ করে আসছেন। ২৮ বছর ধরে সব বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ ছাত্রসংসদ নির্বাচন বন্ধ রাখার মাধ্যমে শিক্ষাঙ্গনের পরিবেশই ভূলুণ্ঠিতই করা হয়নি, শিক্ষাঙ্গনে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির জন্মই দেওয়া হয়নি, তারুণ্যের নেতৃত্ব, মেধা ও মননশীলতা বিকাশের পথ রুদ্ধ করে ছাত্ররাজনীতিকে অসুস্থ ধারায় নেওয়া হয়েছে।

জাতীয় রাজনীতিতে এসব নির্বাচন না হওয়ায় নেতৃত্বের শূন্যতা কতটা বিরাজ করছে মহামান্য রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ আবদুল হামিদ তা অকপটে বলেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর হিসেবে রাষ্ট্রপতি যখন ডাকসু নির্বাচনের তাগিদ দিয়েছেন মেরুদ-হীন রাজনৈতিক তল্পিবাহক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন সে নির্দেশ উপেক্ষা করেছে। হাই কোর্টের আদেশ তাদের ঘুম ভাঙাতে পারেনি। ২৮ বছর ডাকসু ও সব কলেজ ছাত্রসংসদ নির্বাচন বন্ধ করার মাধ্যমে রাজনীতিকে রাজনীতিবিদদের হাতছাড়া করা হয়েছে। সারা দেশে ছাত্রসংসদ নির্বাচন তিন দশক না হওয়ার জন্য সরকার, বিরোধী দলসহ সব বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ প্রশাসন কার্যত অন্যায় করেছেন। তারা সবাই আজ জবাবদিহিতার কাঠগড়ায়।

দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ ছাত্রসংসদ নির্বাচন এখন সময়ের দাবি। ইতিহাসের অমোঘ বিচারে এ দাবি মানতে হবে। জাতীয় নির্বাচনের পর পরই ছাত্রসংসদ নির্বাচনের দুয়ার খুলে দিতে হবে। শিক্ষাঙ্গনে সব ছাত্র সংগঠনের অবাধ বিচরণের পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। জাতীয় নির্বাচন থেকে ছাত্রসংসদ নির্বাচনে জয়-পরাজয়ের মানসিকতা নিয়ে সবাইকে সেটি গ্রহণ করতে হবে। আর যে কোনো সমস্যার সমাধানে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের দুয়ার খুলে দিতে হবে।

লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন