আজ শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ইং

পাকিস্তানে যা হচ্ছে তা যেন বাংলাদেশে না হয়

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৮-১১-০৮ ০০:৫০:৪৭

তসলিমা নাসরিন :: পাকিস্তানের দরিদ্র এবং দুর্ভাগা মানুষটির নাম আসিয়া নুরিন। আসিয়াকে আমি দুর্ভাগা বলছি কারণ কী অপরাধ তিনি করেছেন, তা বোঝার আগেই তাঁকে মৃত্যুদন্ড দিয়েছে আদালত। লাহোর হাই কোর্ট সেই মৃত্যুদন্ডাদেশ যদিও স্থগিত করেছিল, চার বছর জেলের ভিতর বন্দীজীবন কাটিয়েছেন আসিয়া। চার বছর পর সুপ্রিম কোর্ট তাঁর মৃত্যুদন্ড বাতিল করেছে। তাঁকে মুক্তি দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট, কিন্তু জেলের বাইরে বেরোনোর সব পথ তাঁর বন্ধ। পাকিস্তানের বাইরে বেরোনোর দরজাও বন্ধ করে দিয়েছে সরকার। বন্ধ করেছে, কট্টরপন্থিরা চেয়েছে বলে। আসিয়ার মুক্তির দাবিতে সরব সারা পৃথিবীর অসংখ্য মানবাধিকার সংগঠন। পোপ ষোড়শ বেনেডিক্ট এবং পোপ ফ্রান্সিস, পরপর দুই খ্রিস্টান ধর্মগুরু আসিয়ার মুক্তির জন্য পাকিস্তান সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছিলেন। তাতে কোনও লাভ হয়নি। কারণ পাকিস্তানের ধর্মান্ধ জনগণ এবং জঙ্গি সংগঠনগুলো মৃত্যুদন্ড চায় আসিয়ার। পাকিস্তানের কোনও সরকারেরই এদের উপেক্ষা করার শক্তি নেই।

ঘটনার শুরু ২০০৯ সালে। পাঞ্জাবের শিকরপুরা গ্রামে ফল তুলতে গিয়ে দুই প্রতিবেশী মহিলার সঙ্গে ঝগড়া বাধে আসিয়ার। ঝগড়াটা এক বালতি পানি নিয়ে। আসিয়া ওই বালতি থেকে এক কাপ পানি নিয়ে পান করেছিলেন। আসিয়া পান করেছেন বলে প্রতিবেশী মহিলারা পানি পান করবেন না। কারণ আসিয়া মুসলমান নয়, আসিয়া খ্রিস্টান। খ্রিস্টান যে পাত্র থেকে পানি পান করে, সেই পাত্র নোংরা হয়ে গেছে, সেই পানিও দূষিত হয়ে গেছে। সুতরাং সেই পাত্র থেকে সেই পানি আর যার পক্ষেই পান করা সম্ভব, মুসলমানের পক্ষে সম্ভব নয়। মুসলমান প্রতিবেশীরা এ কথা সাফ সাফ জানিয়ে দিলেন। আসিয়াকে তাঁরা ধর্মান্তরিত হতে বলেন। খ্রিস্টান থেকে মুসলমান হওয়ার জন্য রীতিমতো চাপ দেন। কিন্তু মুসলমান তো আসিয়া হনইনি, বরং ইসলামের নবী সম্পর্কে অবমাননাকর মন্তব্য করেন। আসিয়া বলেননি এ কথা, বলেছেন প্রতিবেশী মুসলমান মহিলারা। আসিয়া স্বীকার করেননি যে তিনি নবী সম্পর্কে আদৌ কিছু বলেছেন। বাদী দাবি করেছেন প্রতিবেশী মহিলারা আসিয়ার বাড়ি গিয়ে আসিয়াকে প্রচুর মারধর করার পর নাকি আসিয়া স্বীকার করেছেন তিনি নবীকে নিয়ে বলেছেন। গ্রামের একটি অশিক্ষিত মহিলা আসিয়া। খ্রিস্টান এই মহিলা নবী সম্পর্কে জানেনই বা কী, বলবেনই বা কী। অনুমান করা সহজ যে আহমদিয়া আর খ্রিস্টানদের যেমন আহমদিয়া আর খ্রিস্টান হওয়ার শাস্তি দেওয়া হয়, তেমনই আসিয়াকে দেওয়া হয়েছে। মূলত সুন্নি মুসলমান না হওয়ার শাস্তি। পাকিস্তানের শিয়াদের ওপরও সুন্নিদের নির্যাতনের কোনও শেষ নেই। ইসলাম অবমাননা করেছে এই দাবি করে বিধর্মীদের ফাঁসানো পাকিস্তানে নতুন ঘটনা নয়। কেউ কেউ এ কারণে পাকিস্তানে জীবন দিয়েছেন, কেউ কেউ জীবন বাঁচাতে দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন।

আসিয়াকে বাঁচাতে চেয়েছিলেন বলে বা ব্লাসফেমি আইনের বিরুদ্ধে কিছু বলেছিলেন বলে খুন করা হয়েছিল সংখ্যালঘু মন্ত্রী শাহবাজ ভাট্টিকে। পাঞ্জাবের গভর্নর সালমান তাসিরকেও একই কারণে খুন করেছিলেন তাঁরই দেহরক্ষী মুমতাজ কাদরি। মুমতাজ কাদরির পক্ষে ছিল লক্ষ লক্ষ পাকিস্তানি। এমনকী হাই কোর্টের উকিলরাও গোলাপের পাপড়ি ছিটিয়ে মুমতাজ কাদরির প্রতি তাঁদের সমর্থন জানিয়েছিলেন। কাদরির পরে ফাঁসি হয়ে যায়। কিন্তু পাকিস্তানের ধর্মান্ধরা ফাঁসিকে ভয় পায় না। আসিয়াকে নাগালে পেলে তারা খুন করতে দ্বিধা করবে না। খুন করে ফাঁসিতে ঝুলতেও তাদের আপত্তি নেই। অল্প বয়স থেকেই ধর্মগুরুরা তাদের মগজে ঢুকিয়ে দিয়েছে যে ধর্মের সমালোচনা যে করবে, তাকে মেরে ফেলাই সাচ্চা মুসলমানের কাজ। শুধু তাই নয় মুসলমানের দেশে অমুসলিমদের কোনও ঠাঁই নেই, হয় তারা কলেমা পড়ে মুসলমান হবে, নয় তারা মরবে।

আসিয়ার সে কারণে মুক্তি হলেও সত্যিকারের মুক্তি হয় না। সর্বোচ্চ আদালতের যে বিচারপতিরা আসিয়ার মৃত্যুদন্ড বাতিল করেছিলেন, তাঁদের জীবনের ওপর হুমকি এসেছে। আসিয়ার আইনজীবীও প্রাণ বাঁচানোর জন্য পাকিস্তান থেকে পালিয়েছেন। আসিয়াকে আশ্রয় দেওয়ার জন্য ইউরোপের দেশগুলো চাইছে, কিন্তু আসিয়া কী করে পাকিস্তান ছাড়বেন! ছুরিতে শান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ফ্রাঙ্কেন্সটাইনের মন্সটার। ফ্রাঙ্কেন্সটাইনের মতো মন্সটার তৈরি করেছিল পাকিস্তান। মন্সটার এখন পাকিস্তানকে ছাড়ছে না। আসিয়ার মৃত্যুদ- বাতিল হয়ে যাওয়ার পর সারা পাকিস্তানকে অচল করে দিয়েছিল সেইসব মন্সটার। সে কারণে পাকিস্তান-সরকার ৫ দফা চুক্তি করেছে মন্সটার কট্টরপন্থিদের সঙ্গে। এই চুক্তিই পাকিস্তানকে আরও শত বছর পিছিয়ে দিল। আসিয়ার মৃত্যুদন্ড বাতিল হওয়ার পর পাকিস্তানের পাশে ছিল সভ্য দেশগুলো, ছিল মানবাধিকারে বিশ্বাস করা সভ্য মানুষ। অপশক্তির সঙ্গে আপসের কোনও প্রয়োজন পাকিস্তান সরকারের ছিল না। সর্বনাশকে সম্ভবত এভাবেই ডেকে নিয়ে আসা হয়।

একাত্তরে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে বাঙালি স্বাধীনতাসংগ্রামীরা বাংলাদেশ নামে নতুন একটি দেশ জম্ম  দিয়েছেন বটে, কিন্তু বাংলাদেশ নামে কোনও দেশ যারা চাননি, তাঁরা যেভাবে শুরু থেকে কট্টরপন্থিদের প্রশ্রয় দিয়েছেন, এক সময় স্বাধীনতাসংগ্রামীরাও সেভাবে প্রশ্রয় দিয়েছেন কট্টরপন্থিদের। পাকিস্তানের অনুকরণ করতে গিয়ে দেশের সংবিধান বদলে দিয়েছেন এক দল, রাষ্ট্রধর্ম নামে কোনও কিছুর অস্তিত্ব ছিল না, সেটিকে, বলা নেই কওয়া নেই, কোত্থেকে এনে, একেবারে ঢুকিয়ে দিয়েছেন সংবিধানে। আরেক দল সেই সংবিধান বদলাবেন প্রতিশ্রুতি দিয়েও বদলাননি। সেক্যুলার বাংলাদেশ তাই দেখতে শুনতে অনেকটা এখন পাকিস্তানের মতোই। পাকিস্তানে আছে ব্লাসফেমির জন্য মৃত্যুদন্ডের আইন, বাংলাদেশে সেটি আমদানির জন্য মৌলবাদীরা প্রায়ই রাস্তায় নেমে উম্মাাদের মতো আচরণ করে। কে জানে কখন আবার মৌলবাদীদের ভোট পাওয়ার আশায় কোন সরকার ব্লাসফেমির জন্য মৃত্যুদন্ড বৈধ করে দেয়।

কে ভেবেছিল শেখ হাসিনার মতো প্রগতিশীল প্রধানমন্ত্রী একদিন হেফাজতে ইসলামের মতো ধর্মীয় কট্টরপন্থিদের ‘কওমি মাতা’ হয়ে যাবেন! হেফাজতে ইসলামের লোকেরা নারী নেতৃত্বের বিরুদ্ধে। আজ নিজেদের স্বার্থে তারা শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে পথে নামছে না বটে, কিন্তু এক তুড়িতে সক্কলে নারী নেতৃত্বের পক্ষে চলে গেছে, এ ভাবাটা হাস্যকর। ভোটের জন্য এমন বিশাল এক জনসংখ্যাকে বাগে আনা চমৎকার এক রাজনৈতিক কৌশল হতে পারে, কিন্তু আল্টিমেটলি এটি পাকিস্তানের পদাঙ্কই অনুসরণ করা। পাকিস্তানে যুগের পর যুগ সরকার আপস করেছে কট্টরপন্থি দলের সঙ্গে, রাজনৈতিক দলগুলোও জোট বেঁধেছে ওদের সঙ্গে। এই করে করে কট্টরপন্থিরা ফুলে ফেঁপে বড় হয়েছে, কট্টরপন্থিদের জঠর থেকে জম্ম  নিয়েছে সন্ত্রাসী। ধর্মের নামে সন্ত্রাস করার লোক, মানুষ কোপানোর লোক পাকিস্তানে যেমন আছে, বাংলাদেশেও আছে। এভাবে চললে পাকিস্তানের চেয়ে মোটেও পিছিয়ে থাকবে না বাংলাদেশ। এভাবে আপস করে চললে একাত্তরে পাকিস্তানের সঙ্গে এক দেশ হয়ে না থাকার যে প্রখর যুক্তি ছিল, সেগুলো ক্রমেই হাস্যকর মনে হবে।

পাকিস্তান পারতো কট্টরপন্থিদের সঙ্গে ৫ দফা আপসে না গিয়ে আসিয়াকে জেল থেকে বের করা, কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে রাখা, রাখা সম্ভব না হলে দেশের বাইরে যেতে দেওয়া। মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে সেটা হতে পারত বড় একটা চ্যালেঞ্জ। কিন্তু ইমরান খান সেটা করলেন না। না করে যে ভুলটা করেছেন, সেই ভুল কওমি ডিগ্রিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্স ডিগ্রির সমতুল্য করে দিয়ে বাংলাদেশের শেখ হাসিনা করেছেন। কট্টরপন্থি দলের সংবর্ধনা গ্রহণ করে একই ভুল করেছেন। দেশের ভালো চাইলে কট্টরপন্থা নির্মূল করতে হয়, কট্টরপন্থার সঙ্গে হাত মেলাতে হয় না।

আশা করি ইমরান খান এবং শেখ হাসিনা দুজনই নিজেদের ভুলত্রুটি শোধরাবেন, যেন সেই অপশক্তি যারা গণতন্ত্রে, নারী স্বাধীনতায়, মানবাধিকারে, মতপ্রকাশের অধিকারে বিশ্বাস করে না, তাদের হাতে দেশ চলে না যায়।

লেখক : নির্বাসিত লেখিকা

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন