আজ মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ইং

ছেলেহারা শত মায়ের অশ্রু গড়ায়ে ফেব্রুয়ারি

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৯-০২-২১ ১২:৩৪:০৩

আল-আমিন

আল-আমিন
"আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি"। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর লেখা আর আলতাফ মাহমুদের সুর করা এ গানটি শুনলেই চোখের সামনে ভেসে উঠে ভাইয়ের রক্তে রাঙা রাজপথ আর ছেলেহারা মায়ের অশ্রুভেজা নয়ন। যুগ যুগ ধরে বাঙালির হৃদয়ে ভাষা আন্দোলন আর একুশের চেতনাকে জাগ্রত করে রেখেছে একুশের সংগ্রাম।
একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের জীবনে একটি চেতনার অনির্বাণ ঘটে। একুশ বাঙালির জাতিসত্তার জাগরণের প্রথম আন্দোলন। এই চেতনায় ১৯৭১ পরিণত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ। আমাদের গৌরবময় স্বাধীনতা। আমাদের ঐতিহাসিক অর্জন বিজয় বাংলাদেশ।
"রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই, তোমার ভাষা আমার ভাষা, বাংলা ভাষা বাংলা ভাষা।" ভাষা আন্দোলনের জন্য সালাম, রফিক, জব্বার, বরকত, শফিউলরা বাঙালির চেতনার উন্মেষ ঘটিয়েছিলেন। এই ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধু "এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমদের স্বাধীনতার সংগ্রাম" অমর বাণী দিয়ে বাংলার অন্তিম সূর্য অর্জন করার ইতিহাস তৈরি করেছিলেন। ভাষা আন্দোলনের সূত্রে স্বাধীনতার যুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের বিজয় এবং অর্থনৈতিক সাফল্যের প্রেরণা আজকের একুশে ফেব্রয়ারি। অমর একুশে ফেব্রয়ারি আমাদের জীবনের চেতনার দিন। এই চেতনায় আমাদের পথচলা উন্নয়নের, উন্নত জাতিসত্তার।

বায়ান্নের একুশে ফেব্রয়ারি বাঙালির জাতিসত্তার জাগরণের চেতনা সৃষ্টি করেছে। একুশের পথ ধরে বাঙালি জাতি বিপ্লবী চেতনায় উন্মুখ হয়ে একাত্তরে শুরু করেছে মুক্তিযুদ্ধ। অর্জিত হয়েছে আমাদের গৌরবময় স্বাধীনতা, আমরা পেয়েছি বিজয়। এই ঐতিহাসিক অর্জন আমাদের বাংলাদেশকে দুনিয়ার কাছে বিকশিত করেছে। এখন বাংলাদেশ বিশ্বের কাছে উন্নয়নের মডেল,শান্তির দেশ হিসেবে পরিচিত। একুশে ফেব্রয়ারির জন্য অর্জিত বাংলা ভাষাকে ইউনেস্কো আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করেছেন। একুশের প্রেরণায় বাঙালি জাতির পিতা স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণকে ইউনেস্কো "মেমরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড" ঘোষণা করে বাংলাদেশকে গৌরবান্বিত করেছেন। বাংলাদেশ এখন উন্নয়নে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে। নিজেদের অর্থায়নে পদ্মা সেতু হতে চলেছে। বছরের পহেলা দিন শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই তুলে দেওয়া হচ্ছে, আমরা ইন্টারনেট ছাড়া একদিনও চলতে পারি না। মাশরাফি, সাকিব, তামিম, মুশফিকদের ক্রিকেট খেলায় বাংলাদেশের নাম বিশ্বের কাছে ছড়িয়ে পড়ছে। প্রতিবেশি দেশ মিয়ানমারের আরাকান রাজ্য থেকে রাখাইন মুসলিম রোহিঙ্গা গোষ্টী যখন নিজ দেশের সরকার কর্তৃক নিপীড়ন হয়ে বিতাড়িত হচ্ছে তখন খাদ্যে স্বয়ংস্বম্পূর্ণ বাংলাদেশ তাদেরকে আশ্রয় দিয়েছে এবং তাদের ভরণ-পোষন ও চিকিৎসা দিয়ে আসছে।

একুশ কেবল আমাদের মুখের ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠা করেনি, দিয়েছে দেশপ্রেমের মহান আবেগ, অসাম্প্রদায়িক, জাতীয়তাবাদী, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার জীবনবোধ, দৃঢ় প্রতিজ্ঞা নিয়ে এগিয়ে চলার প্রাণশক্তি। আমাদের সাহিত্য-সাংস্কৃতিক চেতনার বিকাশে একুশে ফেব্রয়ারি শত বছরের, শত সংগ্রামের। এক সময়ের শোক ও বেদনার একুশ এখন আমাদের জীবনে জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়েছে। সৃজনশীলতায় পরিণত হয়ে একুশে ফেব্রয়ারি বাঙালি জাতীয় জীবনে অসামান্য অবদান রেখে আমাদের সাহিত্যাঙ্গনে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলেছে। একুশে ফেব্রয়ারিকে কেন্দ্র করে মাসব্যাপী অমর একুশে বইমেলা হয়, লেখক সাহিত্যিকগণ কাব্য রচনা করেন, কবি তার কবিতায় তুলে ধরেন একুশকে। বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় পুরস্কার একুশে পদক দেওয়া হয় এই একুশকে ঘিরে। একুশ আমাদের রক্তে রন্দ্রে মিশে যাওয়া প্রাণের স্পন্দন। "আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি?" এগান আমাদের সাংস্কৃতিক চেতনার বিকাশে উজ্জীবনীমন্ত্রের মতো প্রেরণাময়। এগান আজ আমাদের কাছে এক প্রতিকী তাৎপর্যে উজ্জ্বল। লাল কৃঞ্চচুড়ার ফাল্গুনের দিনে একুশ পালন করার জন্য শহিদ স্মরণে খালি পায়ে প্রভাতফেরি শহিদ মিনারে শ্রদ্ধাঞ্জলি আমাদের চেতনার এক দীপ্ত মশাল। এই মশালের আলোতেই আমরা পেয়েছি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ। দেশাত্মবোধক গান, অসংখ্য গণসংগীত, কবিতা একুশকে ঘিরেই রচিত হয়। সৌন্দর্য কবিকণ্ঠে প্রভাব পড়ে বেদনা, ক্ষোভ ও যন্ত্রণার ইতিহাস। এই প্রজন্ম ভুলেনি একুশের চেতনা। বাংলা কবিতার অঙ্গনে জন্ম দিয়েছে নিজেকে দায়বদ্ধ রেখে সমাজ সচেতনতায়। বাংলা সাহিত্যে বছরের পর বছর প্রকাশিত হয় ফেব্রয়ারি ফাল্গুন কৃঞ্চচুড়া আর একুশের কথায়। ফুটিয়ে তুলেন বায়ান্নোর শোষণ ও বঞ্চনার কথা। ভাবিয়ে তুলেন সমাজ ও মানুষকে, স্বদেশ ও বিশ্বকে নিয়ে স্বপ্ন দেখান মানব-মুক্তির। কবিতায় ফুটে উঠে স্বদেশের রক্তাক্ত ছবি। এখন আমাদের বাংলা সংস্কৃতিতে কবিতা হয়ে উঠেছে সংগ্রামের অন্যতম হাতিয়ার। ভাষার জন্যে আত্মদানের ভেতর দিয়ে সালাম, বরকত, রফিক, জববার দেশের মানুষের ভিতরে সজীব হয়ে উঠেছে। হিমালয়ের মতো বিশাল ইতিহাস পরিক্রমায় যেসব অবিনশ্বর স্মৃতিস্তম্ভ দেখতে পাওয়া যায় এর ধারাবাহিকতায় অমর স্মৃতিস্তম্ভ হিসেবে দেখেছে তরুণ প্রজন্ম।
ভাষা-আন্দোলনের রক্তঝরা সংগ্রামী ইতিহাস একাত্তরের সংগ্রামী ইতিহাসের সঙ্গে একাত্ম হয়ে কবিদের সত্ত্বায় প্রবহমান একুশের চেতনার প্রতিফলন ঘটে। একুশে ফেব্রয়ারি চেতনায় উদ্বুদ্ধ নতুন প্রজন্মের একুশের পটভূমিতে "আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি" এই একুশের চেতনা অসামান্য প্রভাব ফেলে এই প্রজন্মের তরুণের হৃদয়ে। একুশের অনির্বাণ চেতনা ও অপরিমেয় আত্মত্যাগের কাহিনী আমাদেরকে শিখিয়েছে- "ও মা তোর বদনখানি মলিন হলে আমি নয়ন জলে ভাসি।"

একুশ কেবল আমাদের মুখের ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠা করেনি, প্রতিষ্টিত করেছে দেশপ্রেমের মহান আবেগ, অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদী জীবনবোধ, দৃঢ় প্রতিজ্ঞা নিয়ে এগিয়ে চলার প্রাণশক্তি। সাহিত্য-সাংস্কৃতিক চেতনার বিকাশে সৃষ্টি হয়েছে অনেক সুর, একু ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতির বিচিত্র সুর। একুশে ফেব্রম্নয়ারি নিয়ে "ভুলব না ভুলব না এই একুশে ফেব্রম্নয়ারি।" রচনা করেছিলেন ভাষাসংগ্রামী গাজীউল হক। একুশে ফেব্রয়ারী আমাদের সাংস্কৃতিক চেতনার বিকাশে উজ্জীবনীমন্ত্রের মতো প্রেরণাময়। একুশ আমাদের কাছে এক প্রতীকী তাৎপর্যে উজ্জ্বল।
একুশের চেতনা বাংলা কবিতার অঙ্গনে জন্ম দিয়েছে সমাজ-সচেতনতা। কথা, শোষণ ও বঞ্চনার কথা। সমাজ ও মানুষ, স্বদেশ ও বিশ্বকে নিয়ে, মানব-মুক্তির স্বপ্ন এই একুশকে ঘিরে।

সকল ভাষা শহীদদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা ।
লেখকঃ
কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক।

@

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন