আজ শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ইং

উন্মাদনা সৃষ্টিকারী কয়েকটি বাংলা গান

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৯-০৩-১৯ ১৫:২৯:৩৭

                                                                     (০১)
উত্তবঙ্গের ছেলে ফিরোজ থাকতেন আমাদের এলাকায়। পরিচয় ৮/১০ বছর আগে। বন্ধুত্বটা এমন একটা পর্যায়ে পৌঁছালো যে প্রায়ই দুজনের আড্ডা সন্ধ্যায় শুরু হয়ে রাত ৯/১০টাও হয়েযেতো। ব্যক্তিগত পারিবারিক আলাপ-আলোচনার পাশপাশি রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতি গল্পগুজবও হতো।

একদিন সন্ধ্যার আগে তিনি অপেক্ষায় আছিরগঞ্জ (বিয়ানীবাজার) বাজার সংলগ্ন মাঠে। হাঁটতে হাঁটতে বাউল শাহ্ আব্দুল করিমের একটি গান গাইছিলাম মনে মনে। ‘ঝিলমিল ঝিলমিল করেরে ময়ুর পঙ্খী নাও’ গাইছিলাম আর ভাবছিলাম এ নাও, কোন নাও। তারপর হঠাৎ মনে হলো, এ নৌকাতো সেই নৌকা আমরা যাকে আত্মা বলি। ‘কোথা থেকে আসে নৌকা কোথায় চলে যায়’-আত্মার আসা-যাওয়া নিয়েতো অনেক গবেষণা হয়েছে বা হচ্ছে। কেউ তার হদিস পাচ্ছেনা। আধুনিক বিজ্ঞানও ব্যর্থ। হঠাৎ হাঁটতে হাঁটতে চোখে জল এসে গেলো। ফিরোজের সাথে হলো বিস্তারিত আলোচনা। এরপর সুযোগ পেলেই গানটি শোনা হতো।
                                        
                                                                       (০২)
এই শতকের গোড়ার দিকের কথা। তখন আমি আছিরগঞ্জ দিশারী প্রি-ক্যাডেট স্কুলে (গোলাপগঞ্জ) কাজ করছিলাম। সহকারী শিক্ষক। বাচ্চাদের গান শেখাতেন আমার বন্ধু মোস্তফা সুহেল পার্থ। ছিলেন পার্থ সারথী সিংহ। তারপর ঢাক-ঢোল পিটিয়ে ধর্মান্তির হয়ে এই নামধারণ করেছিলেন। বহু বছর পর তিনি এলাকাটি ছেড়ে গেছেন এবং যতদুর জানি আবার লোকটা সনাতন ধর্মে ফিরে গেছেন। ধর্ম নিয়ে এমন বিচিত্র খেলা কিভাবে সম্ভব, আল্লা মালুম! যাক, তিনি শেখাতেন আর আমি টুকটাক সহায়তা করতাম। আর গান নিয়ে সুযোগ পেলেই আলোচনা করতাম। তখন একটা টেপরেকর্ডারে কার একটি ক্যাসেটে প্রথম শুনলাম নজরুলের গান ‘রুমুঝুম রুমুঝুম, নূপুর বাজে, আসিলরে প্রিয় আসিলরে’। অনুপজালোটার দরাজ কন্ঠ আর গায়কীর সাথে বাঁশি ও অন্যান্য যন্ত্রের সুরঝংকারে আমার মাতাল হওয়ার জোগাড়! গানের কথাগুলো অন্তরে রীতিমতো তোলপাড় সৃষ্টি করেছিলো। শুনতে শুনতে বারবার মনে হচ্ছিল, কবি আমার মনের অবস্থাটা এত আগে লিখে গেলেন কিভাবে? কালোত্তীর্ণ শিল্পকর্ম বলে যে কথাটি বিশেষজ্ঞরা বলেন, এতো তাই!

'কদম্ব কলি শিহরে আবেশে, বেণীরো তৃষ্ঞা জাগে....রোধনো ভূলে রাধা গাহিয়া উঠে... সুন্দরো মোর ভালোবাসিলোরে...’  উন্মাদের মতো তখন কতদিন, কতরাত কেবল এই একটিমাত্র গান শুনতে শুনতে কাটিয়ে দিয়েছি! নজরুলের আরো কিছু গান উন্মাদনা ছড়িয়ে দেয় যখন-তখন। যেমন ‘আল্গা করো গো খোঁপার বাঁধন’ ‘আজো মধুর বাঁশরি বাজে’ ‘এই কিগো শেষ দান’ ‘পাষাণের ভাঙালে ঘুম।’ গানগুলো কেবল উন্মাদনাই ছড়িয়েছে তাই নয়, রীতিমতো ভাবিয়ে তুলেছে এবং ভালোবাসতেও শিখিয়েছে। কতবড় প্রেমিক হলে যে লেখা যায়, ‘কানের দুলে প্রাণ রাখিলে বিঁধিয়া’ বা ‘দেহেরও দেউড়িতে বেড়াতে আসিয়া, আউর নেহী ও ওয়াপসগায়ি’। আর সুরের কি আজব খেলা! ‘পাষাণের ভাঙালে ঘুম’ গানের ‘কত জনমের কাঁদন, ওপায়ে লুটাতে চায়!’ একজন প্রেমক কবি হিসাবে যে নজরুল বিশ্বের যেকোন মানুষের জন্য আদর্শ উদাহরণ, আমার ধারণা সবসময়ই তার গান আর সুর মানুষেকে তা মনে করিয়ে দিবে আর ভালোবাসতে শেখাবে।
                                                                           (৩)
ভুপেন হাজারিকার গান মানেইতো সাধারণ মানুষের সুখদুঃখ আর আনন্দ বেদনার প্রতিচ্ছবি। তার গান শুনি। উন্মাদের মতো শুনেছি বা এখনো শুনি ‘আজ জীবন খুঁজে পাবি ছুটে ছুটে আয়’। গানটি হতশাগ্রস্ত মানুষের জন্য মুক্তির প্রেরণা । সেই ৭৮ সাল থেকে শুরু করে আজো তুমুল জনপ্রিয়। এমনকি ভারতীয় উপমহাদেশের বাইরেও। উন্মাদনা সৃষ্টি করেছিল ‘আমি এক যাযাবর’, ‘মানুষ মানুষের জন্য’, ‘দাঁতে কাইটোনা ঠোঁট’ ‘সবার হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথ চেতনাতে নজরুল ইত্যাদি। এছাড়াও ভুপেনের প্রতিটি গানেই আছে মানুষ আর মানবপ্রেমের কথা। যেমন ‘দোলা’ ‘রতনপুর বাগিচা’ ‘বিস্তির্ণ দুপারে’ ‘একখানা মেঘ ভেসে', কোনটা ছেড়ে কোনটার কথা যে বলি!
                                                                             (৪)

গুরুজীর গানেও উন্মাদ হয়েছি বা এখনো বারবার হচ্ছি। তবে প্রথম যখন ‘ভালোবাসি ভালোবাসি’ গানটি শুনি, তার অনুভূতিটুকু প্রকাশের মতো ভাষা পাচ্ছিইনা। বিশেষ করে ইন্দ্রানীর (সেন) মুখে গানটি এত জীবন্ত যে পাগলের মতোই শুনি। এর আগে অবশ্য ‘সহেনা যাতনা’ ‘জেনে শুনে বিষ করেছি পান’ ‘সখি বহে গেল বেলা’ আর ইদানিং ‘রোধনো ভরা এ বসন্ত’ ‘যে ছিল আমার স্বপনোচারিনী’ ইত্যাদি গান শুনছি যখন তখন।
                                                                              (৫)

বাংলা গানের আরেক দিকপাল ফকির লালন সাঁই। তার গান আগে খুব বেশী শোনা না হলেও ইদানিং শুনছি। উন্মাদনা ছড়ানোর মতো লালনের গানের কথা বললে বলতে হয় অনেকগুলো গানের কথা। যেমন ‘জাত গেল জাত গেল’ ‘মাগি মাগি বলছ যারে’ ‘বলাই দাদা’ ইত্যাদি। সাঁইজির গানের বিশাল ভান্ডারের অল্পই শোনা হয়েছে। আরো প্রচুর শুনতে চাই, বুঝতে চাই অন্তত নিজেকে চিনতে। এই ছেচল্লিশেও মনে হয়, নিজেকে চেনার বা জানার এখনো অনেক বাকী!

হিন্দি বা বাংলা মশল্লা জাতীয় গানের এই জোয়ারের সময়েও আপন বৈশিষ্ট্যে বহাল তবিয়তে টিকে আছেন নজরুল-রবীন্দ্রনাথ-লালন-হাসন-ভুপেন বা শাহ আব্দুল করিম-রাধারমনরা। এটা আমাদের জন্য খুব আশা জাগানিয়া হলেও নতুন প্রজন্মের আগ্রহ কিন্তু দিনদিন বিজাতীয় সংস্কৃতির দিকে। তাদের আপন সংস্কৃতি চেনাতে-জানাতে পারিবারিক উদ্যোগই বেশী কার্যকর। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও এব্যাপারে ভালো ভূমিকা রাখতে পারতেন। কিন্তু যতদুর জানছি বা দেখছি, মনে হচ্ছে এসব জায়গা থেকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বিজাতীয় সংস্কৃতি চর্চা নিরুৎসাহের বদলে উৎসহা দেওয়া হচ্ছে।

কিভাবে-তা নিয়ে আরেকদিন।

সিলেটভিউ২৪ডটকম/ ১৯ মার্চ ২০১৯/এক

@

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন