আজ বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ইং

মার্চ ২৫, গনহত্যা দিবস

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৯-০৩-২৫ ১৭:০১:৩২

আজিজুস সামাদ ডন :: সাল ১৯৭১। মুক্তিযুদ্ধকে,  ৭১' কে খুব কাছ থেকে দেখা দশ বছর বয়সের এক শিশু আমি। ৭১'এর এই রাত্রের কথা আমার চোখের সামনে এখনো জ্বল জ্বল করে ভাসে। আমরা তখন এলিফ্যান্ট রোডের পাশেই থাকি। চারিদিকের স্বাধীনতাকামী মানুষের উত্তেজনাটুকু অনুভূতির রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে বসে আছে। প্রতিটি বাড়িতে লাল সবুজের মাঝে হলুদ বাংলাদেশের ম্যাপ সহ পতাকা উড়ে জানান দিচ্ছে বাংলার মানুষের মনের আকাঙ্ক্ষার। বাবা সারাদিন বাসায় ছিলেন না। এলেন রাত প্রায় দশটার দিকে। এসেই তাড়াতাড়ি খেতে বসে মাকে জানালেন দেশের এবং ঢাকা শহরের পরিস্থিতি।

ঢাকা শহরের বাতাসে তখনও বারুদের গন্ধ না থাকলেও, দেশের অন্যান্য অঞ্চলে বারুদের গন্ধ আছে। আর ঢাকা শহরে পাক সেনাদের ক্র‍্যাকডাউনের সম্ভাবনার খবর তখন বাতাসে উড়ছে। বাবা সহ আওয়ামিলীগের সব বড় নেতৃবৃন্দ সারাদিন ৩২নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাসায়। পরামর্শ চলছে পরবর্তী করণীয় নিয়ে। বঙ্গবন্ধু সকলকে নির্দেশনা দিয়ে চলেছেন। সকলকে বুঝিয়ে দিচ্ছেন বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে কি কি করতে হবে। বঙ্গবন্ধু নির্দেশ দিলেন সকল নেতৃবৃন্দকে নিরাপদ স্থানে সরে যাবার জন্য। সকল নেতৃবৃন্দ একমত যে বঙ্গবন্ধুর ওপর, বঙ্গবন্ধুর পরিবারের ওপর হামলা হবে, ওনাকে মেরে ফেলতে পাক আর্মির কোন দ্বিধা থাকবার কোন কারণ নেই, সুতরাং, বঙ্গবন্ধুরও উচিৎ এই মুহুর্তে নিরাপদ অবস্থানে চলে যাওয়া। কিন্ত বঙ্গবন্ধুর একটাই কথা, তোমরা মুক্তির জন্য লড়াইয়ে ঝাপিয়ে পর, সাড়ে সাতকোটি বাঙ্গালির ভাগ্যে যা লেখা আছে আমি নিজে সেই ভাগ্যকে বরন করে নিতে চাই। কিছুতেই তাঁকে রাজি করাতে পারলেন না নেতৃবৃন্দ। অবশেষে, রাত সাড়ে আটটা নয়টার দিকে সকলে ৩২ নাম্বার ত্যাগ করলেন।

৩২ নাম্বার থেকে এলিফ্যান্ট রোড, পাঁচ মিনিটের রাস্তা। বাবা জানালেন,  চারিদিকে ব্যারিকেড তৈরী করেছে মুক্তিকামী জনতা। কিভাবে যেন সকলেই জেনে গিয়েছে পাক আর্মি ট্যাংক সহ রাস্তায় নামবে। পাটের সাথে আলকাতরা লাগিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ফেলে রাখার ব্যবস্থা করছে সকলে মিলে। প্রতিটি গাড়ি থামাচ্ছে, পরিচয় জিজ্ঞাসা করছে, পরিচয় পাবার পর জানতে চাইছে পরিস্থিতি সম্পর্কে, জানতে চাইছে তাদের করণীয় সম্পর্কে। এই পাঁচ মিনিটের এইটুকু রাস্তা পারি দিতেই বাবার সময় লেগেছে একঘন্টার বেশী।

মায়ের কাছে বলা এসব গল্প শুনতে শুনতে কখন ঘুমিয়ে পরেছি জানি না। সকালে ঘুম থেকে উঠেই শুনছি গুলির শব্দ আর মাইকের ঘোষনা, কারফিউয়ের ঘোষণা। বাবা বাড়িতে নেই। মায়ের কাছে জানলাম, রাত্রের খাওয়া শেষ করেই বাবা চলে গিয়েছেন এলিফ্যান্ট রোডের উল্টো দিকে দেলোয়ার মামার বাসায়। সারারাত ভয়াবহ গোলা গুলির শব্দে মা ঘুমাতে পারেননি। এভাবেই চলে গেল ২৬ মার্চ।

২৭ মার্চ রেডিওতে কেবল ঘোষণা এলো সকাল নয়টা থেকে সকাল ১১ টা (অথবা দুপুর বারোটা ঠিক মনে নেই) পর্যন্ত কারফিউ শিথিল করার। আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলাম, ঠিক তার পরমুহূর্তে দেখি লুঙ্গি-গেঞ্জি পরিহিত বাবা আমার সামনে। বাবা শুধু একটা মুচকি হাসি দিয়ে ভেতরে চলে গেলেন, আমিও চললাম তার পেছনে। শুনলাম তার মুখে সব ভয়াবয় বর্ণনা। মামার বাসায় বহু মানুষ আশ্রয় নেয়ায় ২৬ তারিখ ভোরে ইকবাল হলের পাশে,আরেক আত্নীয়ের বাসায় গিয়ে আত্নগোপন করেছিলেন। নিজের চোখে দেখেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গনহত্যা, শুনেছেন রাজারবাগ পুলিশ লাইনের গনহত্যার কথা। রাস্তায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা লাশ সরাতে ২৭ তারিখ সকালেও আর্মি ট্রাক গুলো ব্যাস্ত। বঙ্গবন্ধুকে মেরে ফেলেছে কিনা নিশ্চিত নন তিনি। আমাদের একটা নিরাপদ অবস্থানে রেখে উনি চলে যাবেন বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করার জন্য।

এই কথা গুলো এবং এর পরে আমার দেখা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বহুবার বলেছি। আজ এটুকুই বললাম। মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্ম তাদের দায়িত্ব পালন করে গিয়েছেন, নিজেদের জীবন উৎসর্গ করে গিয়েছেন দেশের জন্য, দিয়ে গিয়েছেন আমাদের স্বাধীনতা, দিয়ে গিয়েছেন আমাদের আমাদের নিজস্ব পতাকা, জাতীয় সঙ্গীত আর সার্বভৌম ভৌগোলিক দেশ।

আজ সকালে খবরের কাগজে একটি সংবাদ পড়ে মনটা খুব বিষিয়ে আছে। কোন একজন গুণী শিল্পীর মৃত্যু কে মহিমান্বিত করতে গিয়ে কেউ একজন দেখি বলেছেন, তার গান মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করতো।  যে কোন মানুষের মৃত্যুর পর তাকে নিয়ে কোন বাজে কথা বলাটাকে আমার কাছে কুরুচিপূর্ণ মনে হয়। যাকে নিয়ে কথা হচ্ছে, তাকে নিয়ে অনেক ভাল কথাই বলা যেতে পারে কিন্ত মুক্তিযুদ্ধের সময় তার পাক হানাদার বাহিনীর সাথে সখ্যতা, পাকিস্তান রেডিও থেকে মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ব্যাঙ্গাত্মক  গান সহ তার সকল ইতিহাস জানা আছে এরকম বহু মানুষ এখনও জীবিত আছেন। তাহলে কেন তাকে এই অবস্থানে ঠেলে দেবার প্রচেষ্টা। গুণীর গুণ নিয়ে আলাপ সীমাবদ্ধ রাখলে অসুবিধা কি। একজন মুক্তিযুদ্ধের চরম বিরোধিতাকারীকে কেন মুক্তিযুদ্ধের অংশ করে নিতে হবে।

কিছুদিন আগে এরকমই আরেকটি সংবাদ দেখেছিলাম। কোন একজন গুণী মানুষের জীবন বৃত্তান্ত ছাপা হয়েছে পত্রিকায়। অবাক বিস্ময়ে লক্ষ করলাম, এই ভদ্রলোক ৭০ সালে পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে যোগদান করলেও জীবন বৃত্তান্তে লেখা রয়েছে, তিনি ৭৪ সালে সিভিল সার্ভিসে যোগদান করেছেন। আমরা সকলেই জানি যে, তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের সমর্থক হিসেবে পাক সরকারে কাজ করেছিলেন এবং মুক্তিযুদ্ধের পর পাকিস্তানিরা প্রথম যে ৭০জন অফিসার ফেরত পাঠিয়েছিল পাকিস্তানি চর হিসেবে, তাদের মাঝে তিনিও একজন। যে কারনে তার চাকরি চলে গিয়েছিল। তেলবাজ হিসেবে সুপরিচিত করিৎকর্মা এই ব্যক্তি, যেভাবেই হোক ৭৪ সালের মে' মাসে দুই বছরের জুনিয়ারিটী মেনে নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের আমলা হিসেবে চাকরি ফিরে পেয়েছিলেন এবং সকল সরকারের আমলে তার ভাল ভাল অবস্থান মনে স্থির বিশ্বাস জাগ্রত করে ওনার তেলবাজির ইতিহাস।

আজকাল সকলেই আওয়ামিলীগার হয়ে যাচ্ছে। আজও সংবাদপত্রে দেখেছি বিভিন্ন জেলা উপজেলার বিভিন্ন দলের নেতৃবৃন্দ আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছেন।  আপত্তি নেই। কারণ, তারা বুঝতে পেরেছেন, বর্তমান সময়ে জনগণের কথা বলছে আওয়ামমী লীগ। কিন্ত যারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী হয়েও মুক্তিযোদ্ধা সাজতে চাইছেন, তাদের বলবো, সাবধান, ঐ কাজটি করতে যাবেন না। কারণ, আপনারা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দোসর, আপনারা গনহত্যার সহযোগী হিসেবে কাজ করেছেন ৭১ সালে। বিশ্বে যত গুলো গণহত্যা হয়েছে তার মাঝে ২৫ মার্চ ১৯৭১ রাত্রে বাংলাদেশে পাক আর্মি কর্তৃক সংঘটিত গণহত্যা অবশ্যই অন্যতম। এই গণহত্যাকে যারা অস্বীকার করে, যারা ইতিহাস নিয়ে খেলতে চায়, যারা যুক্তির ইতিহাস তৈরী করতে চায়, যারা ইতিহাসকে বিকৃত করে উপস্থাপন করতে চায়, সেইসব মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারীদের ধিকৃত কর্মকান্ডে বাধা দেবার জন্য সকলের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার এখনই সময়। এই মুহুর্তে যদি তাদের তাদের এই ইচ্ছাকে সমূলে উৎপাটিত না করা হয় তবে আমাদের প্রজন্মকে ইতিহাস ক্ষমা করবে না।


@

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন