আজ বুধবার, ১৭ এপ্রিল ২০২৪ ইং

নববর্ষ ও ভালবাসা

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৯-০৪-১৪ ০১:১৬:২৩

অমিত দাশ :: উমানের আকাশে আজ বিকেলে হঠাৎ করেই ধূলিঝড় বয়ে গেল। ডিউটি শেষ করে ঝড়ের দাপটে কোনমতে শরির ভরা ধূলো নিয়ে মেসকক্ষে ঢুকলো রায়হান। বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে আজ প্রায় ছয় বছর উমান আছে রায়হান। পরিবারের ছোট ভাই বোন সহ সবার দায়িত্ব তার। মোবাইলটা হাতে নিতেই দেখতে পেল আর মাত্র কিছুক্ষন পরই বাংলাদেশে ১৪ই এপ্রিল। পহেলা বৈশাখ, বাঙালীর প্রাণের উৎসব বাংলা নববর্ষ।

গতবছর এই দিনটির কিছু কথা কিছু স্মৃতি তার চোখে ভেসে উঠলো। ভাবলো আগামিকাল ছুটি নিবে সারাদিন বাড়ির সবার সাথে কথা বলবে সে। ভেবে ভেবে রাতের খাবার শেষে ক্লান্ত শরির এলিয়ে দিল বিছানায়। ভেবেছিলো হয়তো কেউ একজনের ফোনকলে ঘুম ভাঙবে তার কিন্তু রায়হানের ঘুম ভাঙলো একটি দুঃস্বপ্নে। ঘুম ভাঙ্গা চোখে মোবাইলের স্কিনটাতে সময় দেখে বুঝতে পারলো আজ অনেক দেরি হয়ে গেছে ঘুম থেকে উঠতে। ডিউটি থেকে ছুটি নিয়েছে তাই হয়তো আলস্য কাটিয়ে উঠেনি সে। কিছুক্ষন বিছানায় গড়াগড়ি করে উঠে ফ্রেস হয়ে নিল রায়হান। নাস্তা সেরে মা কে ফোন করলো সে দু-তিনবার ফোন করার পর ফোন রিসিভ না করায় টিভিতে নববর্ষের প্রভাতফেরি দেখতে লাগলো রায়হান। ঘন্টা কেটে গেল এর পরও অপাশ থেলে কোন ফোন এলনা। নানান আজেবাজে চিন্তার ঘোর কাটিয়ে আবার মাকে ফোন করলো রায়হান। এবার ফোন রিসিভ হলো।

হ্যালো মা?
মাঃ হ্যালো রায়হান
রায়হানঃ শুভ নববর্ষ মা। কেমন আছো তোমরা সবাই।
মাঃ ভালো বাবা তুই কেমন আছিস।
রায়হানঃভালো মা তোমাদেরকে খুব মিস করছি।  তাই আজ কাজের ছুটি নিয়েছি। আজ সারাদিন তোমার সাথে কথা বলব।
মাঃ ঠিক আছে বাবা কিন্তু তোর বোন দুলাভাই এসেছে আমার তো এখন হাতে অনেক কাজ। তোর সাথে আমি পরে কথা বলি?
রায়হানঃ আচ্ছা ঠিক আছে।
ফোনটা কেটে গেল বিষন মন খারাপ নিয়ে বসে রইলো রায়হান।

রায়হানের ছোট ভাই রুহান। এবার অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে পড়ছে একটা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে। রুহানের থেকে মাত্র দুই বছরের বড় রায়হান। অথচ রুহান ছোট হওয়ায় কত আরামেই না আছে। গত সপ্তাহে রুহানকে নতুন বাইক কিনে দিয়েছে রায়হান। রুহান ও অনেক খুশি হয়েছে। যতই হোক সে বড় পরিবারের সব দায়িত্ব তার। এসব নিয়ে মন খারাপ করে না সে। রুহানের কথা মনে পরতেই রুহানকে একটা ফোন দিল রায়হান। প্রথমবার ফোন রিসিভ না হওয়াতে আরেকবার ফোন দিল সে। এবার রিসিভ হলো ফোন।
রায়হানঃ কিরে কেমন আছিস?
রুহানঃ এইতো ভাইয়া ভালো। তুমি?

রায়হানঃ ভালো। কি করিস?
রুহানঃ এইতো ভাইয়া বাইক নিয়ে বের হয়েছি, বন্ধুদের সাথে একটু আড্ডা দিব তারপর মেলায় যাব।
রায়হানঃ হুম হেলমেট নিয়েছিস তো?
রুহানঃ হুম ভাইয়া নিছি। আচ্ছা ভাইয়া আমি তোমার সাথে পরে কথা বলি আমার বন্ধুরা এসে গেছে।
রায়হানঃ আচ্ছা ঠিক আছে সাবধানে গাড়ি চালাবি কিন্তু।
এবারও ফোনটা কেটে গেল। কিছুটা নিরবতা কিছুটা অব্যক্ত কথা আর কিছুটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে চুপচাপ বসে রইলো রায়হান।
ভাবতে লাগলো রুহানের সঙ্গে তার ছোটবেলায় কাটানো মূহুর্তগুলো। সেই ছোট্ট রুহান আজ কত বড় হয়ে গেছে রায়হানের জন্য তার কোন সময় নেই। ফোন দিলেই বন্ধু, আড্ডা, ব্যস্ততা।
মন খারাপ না করে আবারও টিভি দেখতে বসে গেল রায়হান।

কিছুক্ষন পর তার একমাত্র বড় বোন রোদেলা আপুকে ফোন করলো সে। দু-এক মিনিট কথা বলেই আপু বল্লেন তোর দুলাভাইকে খাবার দিব এখন। তোর দুলাভাইয়ের তো খাবার সময়ের এদিক দেসিক হলে তিনি আর খাবেন না। তোর সাথে পরে কথা বলি। বলেই কেটে দিলেন আপু।
রোদেলা আপুর বিরক্ত মাখা মুখটা ভেসে উঠলো রায়হানের সামনে।
এবার রায়হান ভাবতে লাগলো আজকে ডিউটি থেকে ছুটি না নিলেই হত সারাদিন একা একা বাসায় থেকে কি করবে সে।
দুপুর হয়ে আসছে কিছুক্ষন পরে দ্বিতীয় শিফটের ডিউটি শুরু হবে। নিশ্চুপ মন নিয়ে সব সংকোচ কাটিয়ে সাইট ম্যনেজারকে ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করলো সুমন ভাই আমার ছুটিটা কি কাটানো যাবে? আমার বাসায় একা একা ভালো লাগছেনা।
অপাশ থেকে উত্তর এলো আচ্ছা ঠিক আছে ভালো না লাগলে দ্বিতীয় শিফটে জয়েন করতে পারিস। আমি বসকে বলে ছুটি কাটিয়ে দিব। রায়হান ধন্যবাদ দিয়ে রেখে দিল।

রায়হানের সব ছোট বোন ঋতি এবার কলেজে উঠেছে। আজ সকাল থেকে একবারও কথা হয়নি ঋতির সাথে। ভাবলো ঋতিকে একটা ফোন দিবে আবার ভাবলো সেও হয়তো আজ ব্যস্ত। তবুও ব্যস্ত থাকলেও একবার অন্তত কথা তো বলতে পারবে অন্তত ঋতির কন্ঠটা তো শুনতে পারবে। এই প্রিয় মানুষগুলো যতই ব্যস্ত হোক এরাইতো তার সব। এবার ঋতিকে ফোন দিল রায়হান।
রায়হানঃ কিরে কেমন আছিস?
ঋতিঃ ভালো ভাইয়া তুমি কেমন আছো।
রায়হানঃ ভালো রে তোদের খুব মিস করছি।
ঋতিঃ তোমাকেও মিস করছি ভাইয়া। তুমি আজকে ডিউটি যাওনি?
রায়হানঃ নারে ছুটি নিয়েছি।
ঋতিঃ অহ, তুমি যে ম্যাকাপ বক্সটা দিয়েছো সেটা খুব সুন্দর হয়েছে ভাইয়া। সবাই খুব প্রসংশা করেছে।

রায়হানঃ তোর পছন্দ হয়েছে তো?
ঋতিঃ হ্যা ভাইয়া খুব। আচ্ছা ভাইয়া আমি এখন শাড়ি পরব আমার বান্ধবীরা আসবে,তোমার সাথে পরে কথা বলি।
রায়হানঃ আচ্ছা ঠিক আছে সাবধানে থাকিস।
ফোনটা কেটে দিয়ে কিছুক্ষন কেঁদে নিলো রায়হান। প্রবাসিদের জীবন আসলে এরখমই। একটু কথা বলার মানুষ পাওয়া ও কঠিন। প্রবাসীদের উৎসব মানে কেবল প্রিয়জন দের ভালো থাকা। আর এই প্রিয়জনের ভালো থাকাই তাদের কাছে শ্রেষ্ঠ ভালবাসা। তাদের বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা।
কান্নাভেজা চোখে কিছুক্ষণ সাওয়ার ছেরে গোসল করে নিলো রায়হান। তারপর ডিউটির উদেশ্য নিয়ে বের হয়ে গেলো আমাদের নববর্ষে।

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন