Sylhet View 24 PRINT

পান্তা ভাতে ইলিশ: গ্রামবাংলার কৃষককূলকে অবজ্ঞা করার শামিল

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৯-০৪-১৪ ০২:০২:৩০

মুকিত রহমানী :: গ্রাম বাংলায় এক সময়ে পান্তা ভাতের ব্যাপক প্রচলন ছিল। পান্তা ভাতের সাথে মরিচ ও পিয়াজ ছিল প্রধান অনুসঙ্গ। ধীরে ধীরে গ্রাম বাংলার ঘর থেকে ভান্তা ভাত খাওয়ার প্রচলন উঠে যাচ্ছে। এখনো প্রত্যন্ত অঞ্চল কিংবা দরিদ্র পরিবারে যে পান্তা ভাত চলে না সেকথা হলফ করে বলা যায় না। পান্তা ভাত ছিল, এখনো আছে। হয়তো ভবিষ্যতেও থাকবে। কারণ আমরা ভাতে-মাছে বাঙালি।

তাই বলে পান্তা ভাতের সাথে ইলিশ? তাও আবার বাংলা নববর্ষের প্রথমদিন। নববর্ষে ইলিশ মাছ খাওয়া কতটা জরুরি, বাংলার ঐতিহহ্যের সাথে তার সম্পর্কই বা কতটা? এমন প্রশ্ন চলে আসছে বেশ কয়েক বছর ধরে। পক্ষে বিপক্ষে হচ্ছে নানা কথাও। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়-এক সময় গ্রাম বাংলার মানুষ তথা কৃষককূল অভাবে জর্জরিত ছিল। তারা অভাবের কারণে পান্তা ভাত খেতেন। বিশেষ করে বৈশাখে খরার মাসে যখন কোনো ফসল হতো না, কৃষকদের হাতে পয়সাও থাকতো না। তখন তারা পান্তা ভাত খেতেন। যেসময় বেঁচে থাকার সংগ্রাম ছিল সেখানে ইলিশ কিনে খাওয়ার প্রশ্নই আসে কোত্থেকে। সুতরাং সত্যি নয় যে, কৃষকরা নববর্ষ উদযাপনে পান্তা ইলিশ খেয়ে বছর শুরু করতেন।

আমাদের বাঙালি সংস্কৃতিতে পান্তা-ইলিশের প্রচলন কিভাবে এলো প্রশ্নটা বার বার আসে। আমাদের বাংলা ভাষা ও সাহিত্য কিংবা বাঙালি সংস্কৃতিতে পান্তার সাথে ইলিশের কোনো যোগসূত্র আছে বলে প্রমাণ মিলে না। পান্তা খাওয়ার যথেষ্ট প্রমাণ মিলে। যদ্দুর ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, নবাব সিরাজ উদ দৌলার আমলে ওয়ারেন হেস্টিংসও বিপদে পড়ে একদিন পান্তা খেয়েছিলেন। কিন্তু পান্তার সাথে ইলিশ খেয়েছেন শতবর্ষ আগে বা পরে এমন প্রমান মিলেনি।

সম্ভবত ১৯৮২-৮৩ সালের দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিন্নভাবে পান্তা ও ইলিশ খাওয়ার ইতিহাস আমাদের সংস্কৃতিতে লক্ষ্য করা গেছে। সেই থেকে একটি শ্রেণি পান্তা ভাতের সাথে ইলিশ জোড়া দিয়ে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য বলে চালিয়ে যাচ্ছেন। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝিতে রাজধানীর সংস্কৃতি কর্মীরা পান্তা ভাতের সাথে ইলিশ খাওয়ার বিপক্ষে মাঠেও নামেন। কিন্তু তারা তা রুখতে পারেননি।

কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার সাহিত্যে পান্তা ভাতের বিষয় টেনে এনেছেন। ‘রামকানাইয়ের নির্বুদ্ধিতা’ গল্পে পান্তাভাত খাওয়ার বর্ণনা মিলে। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কিংবা পল্লী কবি জসীমউদ্দীন ছাত্রাবস্থায় তাদের পান্তা খেতে হয়েছে অভাব-অনটনের কারণে। কবি জসীমউদ্দীন ফরিদপুর থেকে পালিয়ে কলকাতায় যথন যান তখন সেখানে পান্তা ভাত খেয়েছেন। তাকে আশ্রয়দাতা এক বোন অভাবের কারণে ভালো করে খাওয়াতে পারেননি।

মানিক বন্দ্যোপাধায়ের ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ উপন্যাসেও পান্তার সাথে ইলিশের কোনো যোগসুত্র নেই। উপন্যাসে ইলিশ ধরা জেলেদের জীবন নিয়ে কথা আছে। কিন্তু পুরো উপন্যাসের কোথাও বৈশাখ মাসে নববর্ষ পালনের জন্য ইলিশের যোগান দেয়ার কথা লেখা হয়নি। এমনকি সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রনালয়, বাংলা একাডেমি, শিল্পকলা একাডেমি, সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো কোনোদিনও বলেনি পান্তার সাথে ইলিশ বাঙালীর নববর্ষ উদযাপনের চিরায়ত সংস্কৃতির সাথে সম্পর্ক আছে। তা হলে সহসাই প্রশ্ন আসে- বৈশাখ এলে পান্তার সাথে ইলিশের এতো আয়োজন কেন। সহজভাবে উত্তরটা দেওয়া যায়- কর্পোরেট সংস্কৃতি সব কিছুকেই পণ্য বানাতে চায়। সেজন্য তারা উপকরণ খোঁজে। পান্তা ইলিশ হয়ে যায় সেই উপকরণ। বৈশাখী খাবারের ব্রাান্ডে পরিণত হয় পান্তা ইলিশ। উৎসাহ-উদ্দীপনায় বাজারে তোলা হয়, আদায় হয় দ্বিগুন, তিনগুন দাম। অথচ পান্তা খেতে বৈশাখ লাগে না। লাগে না ইলিশ খেতেও। পহেলা বৈশাখে পান্তার সাথে যেমন আমরা ইলিশ (কেউ কেউ) খাই তেমনি ডিমও খেয়ে ফেলি। ভবিষ্যতে ইলিশের প্রজনন কমবে না বাড়বে তা কর্পোটে সংস্কৃতিওয়ালারাই ভালো সম্যক।

হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতিকে কর্পোরেট সংস্কৃতি বানিয়ে গ্রাম-বাংলার মানুষ তথা কৃষককূলকেই অবজ্ঞা করা হচ্ছে। আমাদের যতো তাড়াতাড়ি সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে পারবো ততোই মঙ্গল। মনে পড়া একটি শিশু ছড়ার কথা দিয়েই শেষ করি- ‘পান্তা খেয়ে শান্ত হয়ে কাপড় দিয়ে গায়/গরু চড়াতে পাঁচন হাতে রাখাল ছেলে যায়’।

মুকিত রহমানী : কবি, লেখক ও সাংবাদিক

সম্পাদক : মো. শাহ্ দিদার আলম চৌধুরী
উপ-সম্পাদক : মশিউর রহমান চৌধুরী
✉ sylhetview24@gmail.com ☎ ০১৬১৬-৪৪০ ০৯৫ (বিজ্ঞাপন), ০১৭৯১-৫৬৭ ৩৮৭ (নিউজ)
নেহার মার্কেট, লেভেল-৪, পূর্ব জিন্দাবাজার, সিলেট
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.