Sylhet View 24 PRINT

বিনম্র শ্রদ্ধা ইফতেখার হোসেন শামীম

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৯-০৫-১১ ১১:৫১:১২

ফয়েজ আহমদ বাবর :: তাঁর যে বয়স তাতে চলে যাওয়ার কথা ছিল না। কিন্তু প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে স্রষ্টা তাঁর আয়ুস্কালের সমাপ্তি টেনেছিল, তাই অকালে চলে যেতে হলো স্রষ্টার সান্নিধ্যে। বলছি বীর মুক্তিযোদ্ধা বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ শ্রদ্ধাস্পদ ইফতেখার হোসেন শামীম-এর কথা। যিনি এক নামে সবার কাছে যেমন পরিচিত তেমনি প্রিয় ব্যক্তিত্ব। নিষ্ঠুর সড়ক দুর্ঘটনা তাঁকে বাঁচতে দেয়নি। বাস দুর্ঘটনায় মুখে পড়ার একটু আগেও বাসায় ফোন করেছিলেন ইফতেখার শামীম।

চা-নাস্তা তৈরি করে রাখতে বলেছিলেন। সেই চা-নাস্তা খাওয়া হলো না আর। ফিরে এলেন নিথর দেহে। সিলেটের রাজনীতির শীর্ষে থাকা এই ব্যক্তির মৃত্যুতে তখন শোকের আবহ বয়ে গিয়েছিল রাজনীতিতে। দেখতে দেখতে তাঁর চলে যাওয়ার ৭বছর পেরিয়ে গেলেও তাঁর শোক কেটে ওঠতে পারিনি আজও।

মুক্তিযোদ্ধা রাজনীতিবিদ ইফতেখার শামীম মন ও মননে ছিলেন একজন শুদ্ধ ও আলোকিত মানুষ। রাজনৈতিক পরিমন্ডলে যার পথ চলা, তাঁর ব্যক্তিত্ব তো শুদ্ধতায় উচ্চকিত হবেই। তার স্নিগ্ধময় হাসি কেউই ভুলতে পারবে না। ছাত্র থাকার সময়েই রাজনৈতিক জীবনের সূচনা ঘটে ইফতেখার শামীমের। ৬৬ এর ৬ দফা দাবি, ৬৯ এর গণঅভ্যুথান, ৭১ এর সমকালীন রাজনীতিতে তার যুগপৎ আন্দোলন জাতীয় রাজনীতির সাথে সিলেটের আওয়ামী রাজনীতিকে চাঙ্গা করে তোলে। তার রাজনৈতিক জীবনের সহকর্মীরা জানান, ৬০-এ দশকে ছাত্ররাজনীতির মাধ্যমে রাজনীতিতে পা বাড়ান এই নেতা।

তখন তিনি ছিলেন ছাত্রলীগের নেতা। এরপর থেকে আর থেমে থাকেন নি। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলদেশ সৃষ্টির পেছনের সব ঘটনায় তার সক্রিয়তার চিত্র বাসায় দেয়ালে দেয়ালে। রাজনীতির মাঠে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে, স্পিকার হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর সাথে, মরহুম পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুস সামাদ আজাদ ও বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর দেওয়ান ফরিদ গাজীর সাথে তার রাজনৈতিক কর্মকান্ডের ছবিগুলো ড্রয়িং রুম থেকে করিডোর হয়ে ডায়নিং রুমের দেয়াল পর্যন্ত ছুঁয়ে আছে।

বাংলাদেশের বিবাদপূর্ণ রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে তিনি ছিলেন নির্বিবাদ নেতা। তিনি ছিলেন অজাতশত্রু, বন্ধুবৎসল, সদালাপী, শান্তিপ্রিয়, পরমত শ্রদ্ধাশীল, দেশপ্রেমিক নিবেদিতপ্রাণ, ধীরস্থির, পরিশুদ্ধ রাজনীতির উজ্জ্বল প্রতীক। অনেক গুণে গুণান্বিত একজন সফল রাজনীতিবিদ। তার মধ্যে এমন কিছু গুণাবলি ছিল, যা সাধারণত অন্য রাজনীতিকদের মধ্যে সচরাচর দেখা যায় না। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক নেতার সঙ্গে অন্য নেতার, এক দলের সঙ্গে অন্য দলের সুসম্পর্ক নেই বললেই চলে। দুই বড় নেত্রীর যখন কালেভদ্রে আকস্মিকভাবে দেখা হয়, তখন সেটা ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’তে পরিণত হয়। দেশের প্রধানমন্ত্রী যখন বিরোধী দলের নেত্রীর পুত্রের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করতে যান, তখন বাড়ির গেট বন্ধ করে রাখা হয়। একটি রাজনৈতিক দলের সব শীর্ষ নেতাকে একযোগে হত্যা করার জন্য প্রকাশ্য দিবালোকে জনসভায় গ্রেনেড হামলা পর্যন্ত করা হয়েছে। সেদিক দিয়ে ইফতেখার হোসেন শামীম ছিলেন ব্যতিক্রম। আওয়ামী লীগের একজন শীর্ষ নেতা হওয়া সত্ত্বেও তিনি সব দলের, সব মতের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি ছিলেন।

ইফতেখার শামীম ৭১-এর মুক্তিসংগ্রামে যোগ দেন। স্বাধীনতা যুদ্ধে ২ নং সেক্টরের অধীনে মুক্তিযুদ্ধ করেন তিনি। ছিলেন কোম্পানি কমান্ডার। ৮০ দশকে জেলা যুবলীগের সভাপতি ছিলেন। এরপর ১১ বছর জেলা আওয়ামী লীগের জয়েন্ট সেক্রেটারি ছিলেন। সিলেটে আওয়ামী লীগের রাজনীতির দিকপাল হিসেবে তখন থেকে তার ভূমিকা সবার দৃষ্টি কাড়ে। ২০০৩ সালে দলীয় কাউন্সিলের মাধ্যমে সিলেট আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হন ইফতেখার শামীম।

বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী ইফতেখার শামীমের বাড়ি সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলার দেওকলস ইউনিয়নের উল্লাপাড়া গ্রামে। তার পিতা অ্যাডভোকেট এরশাদ হোসেন এবং মাতা সিলেট গার্লস স্কুলের শিক্ষক শরীফাতুননেসা। সিলেট সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মেট্রিক পাশ করেন ইফতেখার শামীম। এরপর সিলেট এমসি কলেজ থেকে অর্থনীতিতে অনার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। ৯১ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও অংশ নেন তিনি। রাজনীতির পাশাপাশি তিনি সিলেট আবাহনী ক্রীড়া চক্রের সভাপতি এবং সিলেট ডায়বেটিক সমিতির সেক্রেটারি ছাড়াও অনেক সামাজিক সংগঠনের সাথে জড়িত ছিলেন। ব্যাক্তিগত জীবনে ইফতেখার শামীম ২ ছেলে ১ মেয়ের জনক ছিলেন।

অনেক গুণে গুণান্বিত অনেকটা পরিপূর্ণ মানুষ ছিলেন ইফতেখার শামীম। তার রাজনৈতিক জীবনে তিনি সব সময়ই কোন্দল ও উপদলীয় দলাদলির বাইরে থেকেছেন। তার মতো ভদ্র, বিনয়ী, মিতভাষী, শান্তিপ্রিয়, সৎ, সহজ-সরল, প্রচারবিমুখ, পরমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, চরিত্রবান, আদর্শবান, নীতিবান, নিরহংকার, নির্লোভ, দৃঢ়চেতা, দেশপ্রেমিক ও অজাতশত্রু রাজনীতিবিদ সচরাচর খুঁজে পাওয়া কঠিন বৈ কী? দলের আদর্শ ও নেতৃত্বের প্রতি প্রশ্নাতীতভাবে অনুগত এমন নেতা এ দেশের ইতিহাসে খুব কমই জন্মান।

এই মহান ব্যক্তি আজ আমাদের মাঝে নাই। কিন্তু তাঁর কর্মের মহিমাকে সবার মাঝে ছড়িয়ে দিয়েছেন। তাইতো বৃষ্টিস্নাত শ্রাবণের মেঘের বৃষ্টির ছোঁয়ায় তার রাজনীতির স্পর্শে ও সৃষ্টিশীল মনন ও কর্মকান্ডের মাধ্যমে সকল মানুষের মধ্যে সমাদৃত হয়েছেন অসামান্য সৃষ্টিতে। একাত্তরের রণাঙ্গণের এই বীর মুক্তিযোদ্ধা স্বতন্ত্র মহিমায় প্রজন্মের পর প্রজন্ম বেঁচে থাকবেন এ বাংলায়।

লেখক : অধ্যাপক-কলামিস্ট।

সম্পাদক : মো. শাহ্ দিদার আলম চৌধুরী
উপ-সম্পাদক : মশিউর রহমান চৌধুরী
✉ sylhetview24@gmail.com ☎ ০১৬১৬-৪৪০ ০৯৫ (বিজ্ঞাপন), ০১৭৯১-৫৬৭ ৩৮৭ (নিউজ)
নেহার মার্কেট, লেভেল-৪, পূর্ব জিন্দাবাজার, সিলেট
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.