আজ শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ইং

ডাক্তার নাকি কসাই?

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৯-০৫-১৩ ০৪:০১:০২

লেখক

অরুণ কুমার দাশ :: ২০১৫ সালের জুলাই মাস তারিখটা ঠিক মনে নেই, মা সদ্য হার্ট অ্যাটাকের ধকল শেষ করে এসেছেন। তখন আমি মায়ের পাশে ঘুমাতাম, সেদিন রাতে আমি যখন গভীর ঘুমে হঠাৎ মাঝরাতে দেখি মা জোরে জোরে আমাকে ধাক্কা দিচ্ছেন। উঠে যা দেখলাম আমি হতভম্ব।  মায়ের শ্বাসকষ্ট হচ্ছে আর নাক দিয়ে গোঙানির শব্দ বের হচ্ছে। (পরে জেনেছি মায়ের হার্ট ফেইলর ছিলো)আমি দ্রুত লাইট জ্বালিয়ে দৌড়ে মেঝো ভাইয়ের রুমে চিৎকার করে ডাক দেই, আরেক দৌড়ে মিষ্টিভাইয়ের রুমে ধাক্কা দেই। ২০ থেকে ৩০ সেকেন্ডের ভিতর আমি মাকে হুইল চেয়ারে বসিয়ে দিলাম, চিৎকার করে বললাম মা'র অক্সিজেন লাগবে। ততক্ষণে সবাই উঠে গেছে।

(আমরা তখন মুসলিম কোয়ার্টারে ছিলাম, বাসাটার ৪ তলায় আমরা থাকতাম।  আর আমাদের সৌভাগ্য ছিল যে সেটা পলি ক্লিনিকের প্রায় ২০০ গজ দূরত্বেই অবস্থান ছিলো।)

ভাতিজা উৎসকে চিৎকার দিয়ে বললাম তুই দৌড়ে যা গিয়ে ক্লিনিকের অক্সিজেন বের করে সেট দিতে বল, আমরা তিনভাই এবং বৌদিরা মিলে হুইল চেয়ার ধরে যত দ্রুত সম্ভব হুইল চেয়ার নিয়ে নামতে লাগলাম। কিভাবে যে ক্লিনিকে গিয়েছিলাম ঈশ্বরেই জানেন। ক্লিনিকে ঢুকার সাথে সাথেই দেখি মা'র গোঙানি বন্ধ! ডাক্তার নার্স সবাইকে আগেই জাগিয়েছে উৎস,  মাকে ইমার্জেন্সি রুমে নেওয়ার ৫ সেকেন্ডের ভিতরই ওরা অক্সিজেন দিলো মাকে।
আমি ভাবছি মা'এর খারাপ কিছু হয়ে গেছে, আমি ক্লিনিকের মেঝেতেই মাথা ঘুরে পড়ে গেছি। সবার ভিতর আতংক, ডিউটি ডাক্তার মায়ের প্রেসার, ব্লাড সুগার চেক করে দ্রুতই লেসিক্স ইঞ্জেকশন দিলেন। অন্য কোন ড্রাগ দিয়েছিলেন কি-না মনে নেই? বললেন উনার আইসিইউ সাপোর্ট লাগবে যত দ্রুত সম্ভব সিলেট নিয়ে যেতে হবে। দেরি করিনি আমরা যার যা পড়নে ছিলো সে অবস্থায়ই আমরা এম্বুলেন্সে উঠেছিলাম। এম্বুলেন্সে বসে বারবার প্রার্থনা করেছি ঈশ্বর হাসপাতাল পর্যন্ত যাওয়ার সুযোগ দাও।
এরপর ইবনে সিনা হাসপাতালের আইসিইউ এর বাইরে সারারাত কিভাবে কেটেছিলো ঈশ্বরই জানেন!

জানেন আমাদের মা'কে কেন ফিরে পেয়েছিলাম? ঈশ্বর পৃথিবীতে এই ডাক্তার নামের কসাইদের পাঠিয়েছেন বলেই। কেউ কেউ কেন ডাক্তারদের দ্বিতীয় গড বলে সেটাও মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছিলাম আমি সেদিন।

এই ফেসবুকের যুগে ডাক্তারদের সাথে ঘনিষ্ঠতা বা সখ্যতা নেই এমন একটি লোক ও পাওয়া যাবে না। আমরা কী করি, জ্বর সর্দি থেকে শুরু করে সিরিয়াস কিছু হলেই তাদের শরণাপন্ন হই। হয় ওষুধ লিখিয়ে নেই নয়তো কোন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের কাছে গেলে ভাল হবে সে নির্দেশনা নেই আবার কখনো  কখনো বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের প্রেসক্রিপশন ক্রস চেক করিয়ে নেই। আর এসব কাজগুলোই আমরা করি বিনা ভিজিটেই। জানেন এতসব কাজ ডাক্তারদের দিয়ে করিয়েও আমরা বলি ডাক্তার কসাই!

সিলেটে একজন অর্থোপেডিক বিশেষজ্ঞ ডাক্তার আছেন। উনি রাত ১০/১১ টায় চেম্বারে আসেন রোগী দেখতে,উনার রোগী দেখতে দেখতে কোনদিন ভোর ও হয়ে যায়। কত্তবড় কসাই ডাক্তার চিন্তা করেন? টাকার জন্য সারারাত না ঘুমিয়ে রোগী দেখছে! কিন্তু আমরা চিন্তা করিনা নিজের জব ডিউটি, ক্লিনিক ডিউটি শেষ করেও চেম্বারে এসে রোগী দেখছেন কি শুধুই টাকার জন্য? চিন্তা করিনা কতশত রোগীর জীবনের সংকটাপন্ন  মূহুর্ত থেকে বের হয়ে আসতে এই ডাক্তারের অবদান কতটুকু?

এখন নতুন ট্রেন্ড শুরু হয়েছে ডাক্তার আর প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষকদের উপস্থিতি নিয়ে। এক্ষেত্রে শিক্ষকদের অবস্থা খুবই শোচনীয়,১০ টায় স্কুল তো পরিদর্শক ৯.৫৫ তে গিয়ে উপস্থিত। একজন শিক্ষক ১০.০২ এ স্কুলে ঢুকলেও ১০.০০ টায় হাজিরা খাতায় অনুপস্থিত বা শোকজের ব্যবস্থা হয়ে যায়। আপনারা বলবেন ঠিকই তো আছে সময়ের আগে না আসলে তো শাস্তি হওয়াই উচিত। এটা করছে কারা দুদক! তাও যথাযথ কর্তৃপক্ষ করলেও নাহয় কথা ছিলো করছে এটা দুদক। তো আপনারা কি এটা ভেবেছেন দুদক কেন সচিবালয়ে যায় না? ৩৫০ সংসদ সদস্যের আসনে সংসদ চলাকালীন অর্ধেকের বেশি আসন শূণ্য কেন থাকে সে বিষয় নিয়ে কেন কোন কথা বলে না? যাক এসব নিয়ে লিখাটা আমার উদ্দেশ্য না, আজ আমি ডাক্তারদের নিয়েই লিখবো।

তো ডাক্তার উপস্থিত নাই এ নিয়ে আপনার মাথাব্যথা বুঝলাম, আপনি শাস্তি দিচ্ছেন, ডাক্তারদের নিয়ে ফেসবুকে নোংরা নোংরা স্ট্যাটাস দিচ্ছেন, ফেসবুক লাইভে এসে ডাক্তারদের হেয় করছেন, রোগী মারা গেলো তো ডাক্তারকে পিঠুনি দিচ্ছেন। ভালো, সেটা আপনি করতেই পারেন অনুপস্থিতি যেহেতু অপরাধ সেটার বিচার আপনার ক্ষমতায় যেভাবে করার ইচ্ছা সেভাবেই করবেন, যেহেতু অযাচিত এসবের বিচার-টিচারও হয় না।

কিন্তু জনাব, ক্ষমতা যেহেতু আছে যান না  মন্ত্রণালয়ে গিয়ে দেখেন ডাক্তারদের কতটা পোস্ট খালি আছে কিন্তু আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় নিয়োগ দেওয়া হয়না? ডাক্তার এবং রোগীর অনুপাত কত জানেন?
ডাক্তার প্রতি রোগী ৬৫৭৯ জন। তো মিনিমাম চিকিৎসা দিতে গেলেও আরো কয় হাজার ডাক্তার নিয়োগ দেওয়া জরুরী?
পোস্ট গ্রাজুয়েশনে পদ সংখ্যা এত নগণ্য কেন সেটার উত্তর জানা আছে?
সরকারি সূত্রে বর্তমানে ১০০টি মেডিকেল কলেজ রয়েছে। সরকারি বেসরকারি এসব কলেজে মোট ৯৫২৫ টি আসন। এরমধ্যে বছরে গড়ে ৬ হাজার ডাক্তার বের হচ্ছে।

তার মানে প্রতি বছর এমবিবিএস পাস করা ডাক্তার বের হয় কমবেশি ৬ হাজার, সে তুলনায় পোস্ট গ্রাজুয়েশনের সুযোগ খুবই নগণ্য। যারাও বা চান্স পায় তাদের কেন বছরের পর বছর ফেল করিয়ে রাখা হয়? জনাব দেখবেন কি কেন ডাক্তারদের পোস্ট গ্রাজুয়েশন করতে এত কড়াকড়ি? তাহলেই বুঝবেন একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের উপর কেন এত চাপ, রোগীরা কেন রাত জেগে সেই একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের কাছেই যায়?

কতটা হাসপাতালে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম নাই এটা আপনার ধারণা আছে? অথবা কতটা হাসপাতালে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম আছে কিন্তু কোন লোকবল নাই সেটার ধারণা আছে?

স্কুল কলেজের সবচেয়ে মেধাবীরা ডাক্তারী পড়তে যায় কিন্তু এমবিবিএস পাস করার পর তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা নাই, নামমাত্র বেতনে ক্লিনিকে ডিউটি করে অনেক ডাক্তাররা। ক্লিনিকের ম্যানেজার ডাক্তারদের সাথে কিরকম ব্যবহার করে দেখেছেন? আমি একটা ঘটনা জানি চুক্তি অনুযায়ী বেতন না দিয়ে ক্লিনিকের মালিক কিভাবে একজন আবাসিক ডাক্তারকে অপদস্ত করে বিদায় দিয়েছিলো!!

আমাদের সদর হাসপাতালে জ্বর, মাথা ব্যাথা কিংবা গাইনী রোগ ছাড়া সিরিয়াস কিছু হলেই ওসমানীতে রেফার করে দেয়? কেন এটা হবে? সিসিইউ নাই, আইসিইউ নাই, এসবের নামে জায়গা বরাদ্দ আছে কিন্তু কোন কার্যক্রম নাই। জেলা শহরের হাসপাতালে কেন সব ধরণের চিকিৎসা ব্যবস্থা থাকবে না?
এটা কি ডাক্তারের দোষ? না আমাদের সিস্টেমের দোষ?

গতকাল ফেসবুকে দেখলাম চুনারুঘাটের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নতুন ভবনের উদ্বোধন হয়নি ১৪ বছরে যার ভিতর চিকিৎসার প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম আছে, এসি আছে, আছে উন্নত সুযোগ সুবিধা।  এই ভবন অব্যবহৃত থাকায় সবকিছু নষ্ট হয়ে যাচ্ছে এখন নাকি দেয়ালেও ফাটল দিয়েছে তাই আর এই ভবন উন্মুক্ত করা হবে না, এটা ভেঙে নতুন ভবন তৈরি করা হবে। এই যখন চিকিৎসা খাতের বাস্তব চিত্র তখন আমরা আছি অল্পসংখ্যক অসাধু ডাক্তারদের অনুপস্থিতি নিয়ে।
সিস্টেমের ইতিবাচক পরিবর্তনের ইচ্ছা থাকলে বটম থেকে নয় টপ থেকেই পরিবর্তন করতে হবে।

এবার আসি মূল কথায়,  যেকারণে আমার এই লেখা....

কালকের ঘটনার ভিডিও দেখে আমি মনোঃকষ্টে ভুগছি, যেহেতু অনেকেই ডাক্তারদের অপমান করছে,  এদের ভুলের শাস্তি দিচ্ছে, যেহেতু এদের মারধর করলে বিচার হয়না সেহেতু একটা মহিলা ডাক্তারকে রেপ করার হুমকি দিতেই পারে এবং রেপ করতেও পারে।  রেপ করা তো সহজ আর এর বিচার ও হয় না। তাই না? আজকের প্রথম আলো পত্রিকার নিউজে দেখলাম মাসের প্রথম ৮ দিনে প্রায় অর্ধশত ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে? এই দেশে এত সহজ সবকিছু আর এসব কাজ আরো সহজ হয় যদি কেউ ক্ষমতাসীন দলের কোন একটা পদে আসীন থাকে!!

ভাই আমি আপনাকেই প্রশ্ন করছি যদি আপনার মা, আপনার বাবা কিংবা আপনার প্রিয়তমা স্ত্রী অসুস্থ হন তাহলে কার কাছে যাবেন? এই ডাক্তারদের কাছেই তো, এই ডাক্তাররা যদি ভুল করে (তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম সেই ডাক্তার বোনটি জেনেভা কনভেনশন এর রুলস "ডাক্তারের কাছে সব রোগীই সমান সে হোক দেশের প্রধানমন্ত্রী কিংবা একজন খেটে খাওয়া মানুষ" বলে ভুল করেছে) তখন কি ডাক্তারকে ধর্ষণ করতে চাইবেন??
প্রধানমন্ত্রী এবং সাধারণ মানুষের যদি চিকিৎসা পাওয়ার সমান অধিকার না হয় তাহলে প্রধানমন্ত্রী কেন ১০ টাকা টিকেটে সরকারি হাসপাতালে ডাক্তার দেখাবেন? কেনইবা তখন প্রধানমনন্ত্রীর সে নিউজ ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছিলো??

যে যাই বলুক, যাই ভাবুক, গালাগালি করুক কিংবা অসম্মান করুক আমি আপনাদের দ্বিতীয় ঈশ্বরই বলবো। কারণ আমি দেখেছি কিভাবে একজন রোগীর সংকট মূহুর্তে আপনারা উদ্বিগ্ন হন, অজানা ভয় কিংবা রোগীকে ভালো করার যে আকুতি সেটা আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি। রোগী ভালো হয়ে যাবার পর আপনাদের যে আত্মতৃপ্তি সেটার স্বর্গসুখ শুধু আপনারাই উপলব্দি করতে পারেন। রোগীর আপনজন যখন আপনাদের ধন্যবাদ জানায় আমি নিজে দেখেছি আপনারা কিভাবে আনন্দাশ্রু সংবরণ করেন।
আপনারা না থাকলে এই যে আমি আমার মায়ের শরীরের গন্ধ নিচ্ছি, মাকে জড়িয়ে ধরছি সেটা সম্ভব হতো না।

ডাঃ অঞ্জন কুমার দাশ, ডাঃ নাহিয়ান এ চৌধুরী, ডাঃ অজয় কুমার দত্ত, ডাঃ মমিনুজ্জামান আপনাদের ঋণ কোনদিনই শোধ হবার না।

আজ "মা" দিবসে আমার "মা" এবং আমাদের পরিবারের পক্ষ থেকে আপনাদের এবং নাম না জানা সকল ডাক্তারদের  প্রতি রইলো অতল শ্রদ্ধা এবং ভালবাসা।

আপনাদের এইসব অপমানে আমি লজ্জিত, স্তম্ভিত।
লেখক : ব্যাংক কর্মকর্তা, মৌলভীবাজার।

@

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন