আজ শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ ইং

চা শ্রমিকদের 'মুল্লুক চল' আন্দোলনের ইতিহাস

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৯-০৫-২০ ১৩:৫৬:০৬

ফাইল ছবি

প্রনব জ্যোতি পাল :: ব্রিটিশ শাসিত ভারতে মালিক শ্রেণীর মুনাফার লোভে চায়ের বাজার দখলের অভিপ্রায় থেকে আসাম বেঙ্গলে চা বাগান শিল্প প্রতিষ্ঠার অংশ হিসেবে আসামের গহিন জঙ্গল পরিষ্কার করে বাগান শিল্প নির্মাণ করতে শ্রমিক যখন দুষ্প্রাপ্য তখন দক্ষিণ ভারতের মঙ্গা পীরিত দরিদ্র মানুষদের মিথ্যা আশ্বাস (আসামে টাকার গাছ আছে) দিয়ে দালালদের মাধ্যমে অনেকটা বিদেশে শ্রমিক পাচারের মত করে গিরমিট প্রথায়( বন্ধকী চুক্তি) এই অঞ্চলে নিয়ে আসা হয়।

আসামের দূর্গম অঞ্চলে বিষাক্ত সাপ, হিংস্র জন্তু জানোয়ার, প্রাকৃতিক প্রতিকূলতা আর মালিক শ্রেণির নির্যাতন হয়ে উঠে এই সহজ সরল হতদরিদ্র নিরন্ন মানুষগুলোর প্রতিদিনের যাপিত জীবন। নামমাত্র মজুরিতে সারাদিনের খাটুনিতে একবেলা খাবার জুটতো না, অখাদ্য- কুখাদ্য, অসুখ- বিসুখ আর বন্দীদশায় যখন জীবন বিদ্রোহের ঘূর্ণিতে ঘুরপাক খাচ্ছিল তখন ১৯২১ সালের ২০ মে, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ লালিত মালিক শ্রেণির নির্যাতন আর মিথ্যা আশ্বাসের ফলে সৃষ্ট দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র থেকে বেরিয়ে আসার প্রত্যয় নিয়ে চা শ্রমিকরা "নিজ মুল্লুকে" নিজ জন্মভূমির দিকে রওনা হয়ে চাঁদপুর মেঘনার তীরে গিয়ে জড়ো হয়।

জন্মভূমি যাবার পথ তাদের জানা ছিল না। শুধু এটুকু ধারনা ছিল চাঁদপুর থেকে স্টিমারে করে যাওয়া যায় কলকাতা। এ সময় কাছাড় ও সিলেটের প্রায় ৩০ হাজার চা শ্রমিক রেল লাইন ধরে দিনের পর দিন হাঁটতে হাঁটতে নদী বন্দর চাঁদপুরে পৌঁছে। পথিমধ্যে খাদ্যের অভাব ও অসুখে মারা যার অনেক শিশু ও নারী। এ আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন চা শ্রমিক নেতা পন্ডিত দেওশরণ ও পন্ডিত গঙ্গা দীক্ষিত।

এদিকে বাগান মালিকরা সরকারের সহযোগিতায় শ্রমিকদের পথরোধ করতে চাঁদপুরে মোতায়েন করে আসাম রাইফলেস এর গুর্খা সৈন্য। শ্রমিকরাও প্রতিজ্ঞাবদ্ধ তারা দাসত্বের এ শৃঙ্খল ছিন্ন করে নিজ মুল্লুকে পৌঁছুবেই। আজীবন এই গিরমিট প্রথায় আবদ্ধ থাকতে চায় না। শ্রমিকরা স্টিমারে উঠতে চাইলে গুর্খা সৈন্যের বাধার সম্মুখীন হয়। শ্রমিকদের এ বিদ্রোহ দমন করতে গুর্খা সৈন্যরা নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে। যারা রেল স্টেশনে অপেক্ষা করছিল গুর্খা সৈন্যরা সেখানে গিয়েও চালায় নির্মম হত্যাযজ্ঞ। এ অবস্থায় শ্রমিকরা পরস্পরের সাথে যোগাযোগ করে ১৯২১ সালে দিনক্ষণ ঠিক করে নিজ মল্লুকে যাবার বাসনায়। আর এ ২০ মে তেই ইতিহাসে যুক্ত হয় শাসক শ্রেণি কর্তৃক শ্রমজীবী মানুষকে পৈশাচিক ভাবে হত্যার একটি ঘৃণ্যতম ঘটনার। শত শত চা শ্রমিককে হত্যা করে লাশ মেঘনায় ভাসিয়ে দেয়া হল। শ্রমিকদের রক্তে লাল হয়ে উঠে মেঘনার জল। এ যেন ১লা মে ১৮৮৬ সালে আমেরিকার শিকাগো শহরের হে মার্কেটের ঘটনাকেও হার মানায়।

এই ২০ মে আজও চা শ্রমিকদের কাছে শ্রদ্ধা, ভালবাসা আর সংগ্রামের চেতনায় ভাস্কর হয়ে আছে। শ্রমিকদের এই বিদ্রোহ দমন করতে সেদিন সরকারের পক্ষে কমিশনার কিরণ চন্দ্র দেব, ম্যাজিস্ট্রেট সুশীল সিং, ইংরেজ মালিকদের প্রতিনিধি ফার্গুসন নেতৃত্ব দেয়। ব্রিটিশ শাসনামলের অবসান ঘটল, পাকিস্তানি প্রায় ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতির রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের অংশীদার চা শ্রমিকরাও। মহান মুক্তিযুদ্ধে বীরদর্পে যুদ্ধ করে শহীদী মৃত্যুবরণ করেছেন শত শত চা শ্রমিক সন্তান। তাদের প্রত্যাশা ছিল হয়তো দেশ স্বাধীন হলে চা শ্রমিকরা এই দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্তি পাবে।

কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার ৪৮ বছর পরও চা শ্রমিকরা যে তিমিরে ছিল সে তিমিরেই রয়ে গেছে। স্বাধীন দেশের নাগরিক হয়েও শিক্ষা চিকিৎসারর নূন্যতম অধিকারটুকু নেই। যুগের পর যুগ ধরে বাগানে বসবাস করলেও নেই ভূমির অধিকার। এখানে আধুনিক জীবনের ছোঁয়া লাগতে দেয়নি শাসকগোষ্ঠী। রোগে- শোকে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর ঘটনা এখানে নিত্য নৈমত্তিক বিষয়।

শ্রম আইন অনুযায়ী শ্রমিকদের চিকিৎসা সুবিদাসহ স্বাস্থ্য সেবার দায়িত্ব বাগান কতৃপক্ষের। নিরাপদ পানীয় জলের সরবরাহ, মানসম্মত রেশন সরবরাহ, উন্নত পয়ঃপ্রণালী ও ড্রেনেজ সিস্টেম এবং মানুষের বাস উপযোগী আবাসিক সুবিদা দেয়ার কথা। কিন্তু বাগানে যেন শ্রম আইনের কোন কার্যকারিতা নেই। এমনকি রক্তাক্ত এই ২০ মে কে কোন রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেয়নি কোন সরকার আজও।

@

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন