Sylhet View 24 PRINT

এক মণ ধান= এক কেজি পুঁটি মাছ কিংবা এক কেজি গরুর মাংস

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৯-০৫-২২ ০০:৩৭:১৭

ফাহাদ মোহাম্মদ :: প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর সিন্ডিকেটের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এই দেশে প্রকৃত কৃষক সম্পূর্ণ রূপে অসহায়। ধান উৎপাদন থেকে শুরু করে বিক্রি পর্যন্ত কৃষকদের প্রকৃতি আর সিন্ডিকেটের দিকে থাকিয়ে থাকতে হয়। বীজ তলা তৈরি করে চারাগাছ রোপন থেকে ধান কেটে বিক্রি পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ করে হয় প্রকৃতি না হয় সিন্ডিকেট। যে বছর প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে হাওরের ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয় বা অকাল বন্যায় কৃষকের স্বপ্ন পানিতে তলিয়ে যায় তখন হয়তো সর্বস্ব হারানো কৃষক সৃষ্টিকর্তাকে দোষারোপ করতে পারে। কিন্তু যে বছর বাম্পার ফলন হয়, কৃষক বুকে আশা নিয়ে স্বপ্ন দেখে এ বছরের ফসল দিয়ে গত বছরের ক্ষতি পুষিয়ে নিবে ঠিক তখনই সিন্ডিকেটের ষড়যন্ত্রে অসহায় হয়ে উৎপাদন খরচের থেকেও সর্বনিম্ন দামে স্বপ্নের ফসল বিক্রি করতে হয়। এতে শুধু ধান চাষের উপর নির্ভরশীল শ্রেণীর কৃষকেরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন। কারণ তাদের বৈশাখ মাসেই ধান বিক্রি করে ঋণ শোধ করতে হয়, সংসার খরচ চালাতে হয়, বাচ্চার আবদার মেটাতে হয়।

কৃষি সমৃদ্ধ এই দেশের হাওরাঞ্চলের কৃষকেরা ছিলেন অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে অনেক সমৃদ্ধশালী। বিত্তবান কৃষকেরা ধান বিক্রি করে অট্টালিকা বানিয়েছেন আবার ধান দিয়েই মিটিয়েছেন সকল প্রকার চাহিদা। একসময় ধানই ছিল হাওর পারের মানুষের একমাত্র ধ্যানধারণা ও অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি। কৃষি সমৃদ্ধ হাওরাঞ্চলে বৈশাখ মাস এলেই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ আসতো ধান কাটতে। যাদেরকে ডাকা হতো, ব্যাপারী বা দাওয়াল হিসেবে। ফাল্গুন মাস এলে এসব ব্যাপারী বা দাওয়ালদের সর্দারেরা এসে গৃহস্তদের লুঙ্গি গামছা দিয়ে বুকিং দিয়ে যেতেন। এবং বৈশাখে তারা দলবেঁধে চলে আসতেন ধান কাটার উৎসবে মেতে উঠতে।

গত দুই দশকে হাওরাঞ্চলের বুনিয়াদী বিত্তবান ধান উৎপাদনকারী কৃষকের সংখ্যা চোখে পরার মত কমেছে যাদের আয়ের প্রধান এবং একমাত্র উৎস ছিল ধান উৎপাদন। এখন যারা কৃষি কাজ বিশেষ করে ধান চাষ করেন তাদের বেশিরভাগ নব্য কৃষক। সময়ের সাথে সাথে জমির হাত বদল হয়েছে। এটাই হয়তো প্রকৃতির নিয়ম। দশ বছর আগেও যাদের গোলা ভরা ধান আর গোয়াল ভরা গরু ছিল তাদের অনেকই আজ অন্যের জমিতে কাজ করছেন বা প্রবাস জীবন বেঁচে নিয়েছেন। আবার দশ বছর আগে যারা অন্যের বাড়িতে কাজ করেছিলেন আজ তাদের অনেকেই বিশাল সম্পত্তির মালিক। তারা জমিজমা ক্রয় করে কৃষিকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। আমাদের এলাকার আদি কৃষক যাদের প্রধান পেশা ছিল ধান উৎপাদন তাদের অধিকাংশ এই পেশা ছেড়ে ভিন্ন পেশায় চলে গেছেন।

কৃষকের এই পেশা ছাড়া প্রবণতা দিন দিন বেড়েই চলেছে। বিশেষ করে সুনামগঞ্জের বিভিন্ন হাওর পারের বিত্তবান কৃষকরা বেশিরভাগ কৃষি কাজ ছেড়ে শহরে এসে বিভিন্ন ব্যবসা বানিজ্য করে ছেলে মেয়েদেরকে চাকরি বা বিদেশে পাঠিয়ে দিচ্ছেন। তাই কৃষকের সন্তান আবার কৃষক হচ্ছে না। কৃষি সমৃদ্ধ এই এলাকায় কৃষির প্রতি কৃষকের বিমূখ হওয়ার নানারকম কারণ রয়েছে। কারণ খুঁজে বের করতে গবেষণা বা অনুসন্ধানের প্রয়োজন। কিন্তু সাধারণভাবে আমরা যে কারণগুলো খুঁজে পাই সেটাই আমি উল্লেখ্য করতেছি।

১। প্রাকৃতিক দুর্যোগঃ প্রায় প্রতি বছর অকাল বন্যা, অতি বৃষ্টি, খরা, জলোচ্ছ্বাস, শিলাবৃষ্টি সহ সকল প্রকার প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে এদেশের কৃষি মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে। প্রকৃতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেই এই দেশের কৃষি ঠিকে আছে। সরকার থেকে পর্যাপ্ত সাহায্য সহযোগিতা না পাওয়ায় বড় গৃহস্থ/বিত্তবান কৃষকেরা ধান চাষ ছেড়ে দিয়েছেন। তাদের অনেকেই এখন মাছ, সবজি বা কম ঝুঁকিপূর্ণ ব্যবসায় বিনিয়োগ করেছেন। আবার যারা শুধু ধান উৎপাদনের উপর নির্ভরশীল সেসব কৃষকরা জমি বিক্রি করে পরিবারের যুবকদের বিদেশ পাঠিয়ে আর্থিক সচ্ছলতা ফিরিয়ে আনছেন। এভাবেই ধান উৎপাদন থেকে মূল ধারার কৃষকেরা সরে আসছেন।

২। ধান উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধিঃ গার্মেন্টস ও অন্যান্য শিল্প কারখানার প্রসারের ফলে কৃষির উপর নির্ভরশীল শ্রমিকের সংখ্যা একেবারেই কমে গেছে। আগে যারা শুধু কৃষি জমিতে কাজ করে জীবিকা উপার্জন করতো তাদের বেশিরভাগ এখন শহর মুখী। জীবন মান বৃদ্ধির ফলে এখন একজন দিন মজুরের রোজ বেতন ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা। এই টাকা দিয়েও সময় মতো কাজের লোক পাওয়া যায় না। এতে ধান উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পায়।

৩। ধানের দাম ও সিন্ডিকেটঃ কৃষক যখন ধান বিক্রি করে তখন ধানের দাম থাকে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা। আবার সেই কৃষক যখন ধান কিনতে যায় তখন সেটা কিনতে হয় ১০০০ টাকায়৷ তার মানে হলো বৈশাখ মাসে কৃষক ঘরে ধান তুলে যখন বিক্রি করতে চায় তখন সর্বনিম্ন দামে বিক্রি করতে হয়। সরকারি দাম ৮০০-৯০০ টাকা থাকলেও সিন্ডিকেটের কারণে প্রকৃত কৃষক সেই দাম পায় না। এতে এক মণ ধান উৎপাদন করতে যে টাকা খরচ হয় বৈশাখ মাসে সেই ধান ৪০০টাকা থেকে ৫০০টাকায় উৎপাদন খরচ থেকে কমে বিক্রি করতে হয়। এতে যে কৃষক কেবল ধান উৎপাদনের উপর নির্ভরশীল সে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

৪। চারা রোপণ ও ধান কাটার অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিঃ বোরো জমির চারা রোপণ ও ধান কাটার ক্ষেত্রে চাষীদের এখনো শ্রমিকের উপর নির্ভর করতে হয়৷ বোরো ধান রোপণ ও কাটার জন্য আগের মতো এখন আর শ্রমিক পাওয়া যায় না। শ্রমিকের স্বল্পতা আর ধান কাটার ধীরগতির কারণে কৃষকের যেমন উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পায় তেমনি সবসময় প্রাকৃতিক দুর্যোগের ভয়ে থাকতে হয়।

হাওরাঞ্চলের মানুষের আয়ের কোনো পথ নাই বা কৃষি কাজ করা তাদের নেশা নয়তো এই দেশে কেউ কৃষি কাজ করতো না। কৃষি বাঁচাতে হলে সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নেওয়া জরুরি। কৃষকের সমস্যা খুঁজে বের করে তা সমাধান করতে হবে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে। সমবায় ভিত্তিক কৃষি হতে পারে অন্যতম সমাধান। ধান উৎপাদন এবং কৃষক রক্ষা করতে না পারলে আমাদের হয়তো অদূর ভবিষ্যতে খাদ্য সংকটে পরতে হবে। তাই কৃষক এবং কৃষি জমি রক্ষা করা আমাদের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিৎ। যেই হারে কৃষি জমি হ্রাস পাচ্ছে তাতে করে বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশ থেকে খাদ্য সংকটের দেশে পরিণত হবে। প্রকৃত কৃষক যাতে সরকারি গুদামঘরে ধান দিতে পারে তা নিশ্চিত করতে হবে। কারণ কৃষক বাঁচলে বাঁচবে দেশ।

লেখক: ট্রাফিক সার্জেন্ট, সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশ।

সম্পাদক : মো. শাহ্ দিদার আলম চৌধুরী
উপ-সম্পাদক : মশিউর রহমান চৌধুরী
✉ sylhetview24@gmail.com ☎ ০১৬১৬-৪৪০ ০৯৫ (বিজ্ঞাপন), ০১৭৯১-৫৬৭ ৩৮৭ (নিউজ)
নেহার মার্কেট, লেভেল-৪, পূর্ব জিন্দাবাজার, সিলেট
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.