Sylhet View 24 PRINT

নাগরী লিপির দেশ সিলেট

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৯-০৬-২১ ২১:২৩:৫৬

মো. তোফায়েল হোসেন :: বত্রিশটি ধ্বনির বর্ণমালা নাগরী লিপি। অসমিয়া ভাষার সাথে আরবি-ফার্সির মিশ্রনে ব্রাহ্মণ্য লিপির বিপরীতে জন্ম নিয়েছিলো নাগরী লিপি। ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ যুগান্তরের স্মৃতিচিহ্ন হয়ে নাগরী লিপিতে লেখা বেশ কিছু বই আজো টিকে আছে। আজকের সিলেট জেলা নাগরী লিপির জন্মভূমি। সহজে এই লিপির ভাষাকে বুঝাতে আমরা বলি ‘সিলেটি ভাষা’। হ্যাঁ, মহাপ্রাণ ধ্বনির আধিক্য আর ব্যতিক্রমি সুরের ঝংকার তোলা সিলেটি ভাষা উজ্জ্বল স্বাতন্ত্র দিয়ে নজর কাড়ে সবার।

প্রতিটি জেলারই আঞ্চলিক ভাষা রয়েছে। এই আঞ্চলিকতার স্বাতন্ত্র ভৌগলিক। বাংলায় প্রতি পাঁচ কিলোমিটার পরপর ভাষা পাল্টে যায়। নদীমাতৃক এই ভূখন্ডে প্রতি বছর ভূগোলও পাল্টায়। ইবনে বতুতার ভ্রমণকাহিনীতে উল্লেখ আছে, এখানে সামান্য নৌকাডুবি থেকে নদীর গতিপথ পাল্টে যায়।

নোয়াখালি, চট্টগ্রাম, বরিশাল জেলার আঞ্চলিক ভাষার মত সিলেটি ভাষারও উৎপত্তি হয়েছে। কিন্তু সিলেটের আঞ্চলিক ভাষার উপর অলংকার ঢেলে পরিশুদ্ধ করে দাপ্তরিক কাজে ব্যবহারের যোগ্যতা দেয়া হয়েছিলো। শিক্ষিত মানুষ নাগরী লিপিতে সিলেটি ভাষা লিখতে গিয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণ ভাষার মত জাতে ওঠা ভাষায় পরিণত হয় এখানকার আঞ্চলিক ভাষা। আজ নাগরী লিপির ব্যবহার নেই, কিন্তু পরিশুদ্ধ ভাষার প্রভাব সিলেটের মানুষের উপর আজও রয়ে গেছে।

নাগরী লিপির উদ্ভব সম্পর্কে অনেকগুলো মত চালু থাকলেও সবচেয়ে শক্তিশালী মত হলো, সুফি সাধক হযরত শাহজালালের হাত ধরে এই অঞ্চলে এই লিপির উদ্ভব ও প্রসার। এর প্রসারে আফগান শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতাও উল্লিখিত হতে দেখা যায়। তবে যৌক্তিকতা কিংবা উৎস নির্দেশ না করেই বলা হয়, কোনো এক সুচতুর মুসলমান মুসলিম জনগণের মধ্যে সাধারণ লেখাপড়া চালু করার নিমিত্তে বাংলা লিপি থেকেই এই নাগরী লিপি তৈরি করে নেন। এটা মূলত লৌকিক বিশ্বাস।

ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল সীমানার আজকের স্বাধীন বাংলাদেশে সিলেট জেলার রয়েছে স্বতন্ত্র এক ইতিহাস। হিমালয়ের পাদদেশে সাগরের দিকে ভূমি প্রসারিত হবার সেই প্রাগৈতিহাসিককালে সিলেট ভূখন্ডের সৃষ্টি হয়েছিলো সবার আগে। এ অঞ্চলের নৃতাত্ত্বিক-প্রত্নতাত্ত্বিক ইতিহাস তাই অপেক্ষাকৃত সুপ্রাচীন। এখানে প্রাচীন কামরুপ রাজ্যের দ্বিতীয় রাজধানীর প্রতিষ্ঠা হয়েছিলো। অবিভক্ত বাংলার অংশ ছিলো না সিলেট। ছিলো আসামের অংশ। দক্ষিণে কুশিয়ারা নদী ছিলো শেষ সীমানা। সিলেট ভারতের অংশ হলে কুশিয়ারা নদীই হতো দুই দেশের সীমানা।

ভারত ভাগের সময় মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল সিলেটকে কোন দেশের অন্তর্ভুক্ত করা হবে তাই নিয়ে জটিলতার সৃষ্টি হয়। তখন বৃটিশ সরকার গণভোটের সিদ্ধান্ত নেয়। তৎকালীন মুসলিগ লীগ নেতৃবৃন্দ সিলেটকে পাকিস্তানের অংশ করতে এ অঞ্চলে এসে ব্যাপক গণসংযোগ চালায়। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সাথে সেদিন তরুণ উদীয়মান নেতা শেখ মুজিবুর রহমানও এসেছিলেন। গণভোটে জনগণ পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হবার ইচ্ছা প্রকাশ করে। সেই থেকে সিলেট হয়ে গেলো পাকিস্তানের অংশ। যদিও এখানে কিঞ্চিত প্রতারণার ইতিহাসও উল্লিখিত আছে। বর্তমান ভারতের সীমানায় পড়া করিমগঞ্জ ছিলো সিলেটের অংশ। কিন্তু বৃটিশ কর্তারা কোনো এক রহস্যময় কারনে গণভোটের রায়কে অশ্রদ্ধা দেখিয়ে করিমগঞ্জকে কেটে ভারতের সাথে জুড়ে দেয়।

এই কাটাকাটির আরো কিছু বিষয় বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে রয়েছে। বাংলা ভূখন্ডের সাথে দার্জিলিঙ, আসাম, মালদহ, মুর্শিদাবাদেরও যুক্ত হবার যৌক্তিকতা ছিলো। কিন্তু তখনকার মুসলিগ লীগ নেতাদের দুর্বলতায় সেসব বেহাত হয়ে যায়। বঙ্গবন্ধুর ভাষ্য ছিলো, নেতারা যেন এইসব এলাকাকে নিজে থেকেই ছেড়ে দিলেন।

সিলেটবাসীর গর্ব, তারা স্বাধীন ইচ্ছায় দেশ বেছে নিয়েছিলেন। মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তানের সাথে যুক্ত হবার এই ইচ্ছা পরবর্তীতে সুখকর হয় নি। ধর্মীয় পরিচয়ে নির্মিত রাষ্ট্র পাকিস্তান জাহান্নাম হয়ে ওঠে। নিজ দেশের ভেতর ঔপনিবেশিক আচরণ পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের মোহ ঘুচিয়ে দেয়। পশ্চিম পাকিস্তান প্রভু আর পূর্ব পাকিস্তান দৃশ্যত এক উপনিবেশের মর্যাদা পায়। হাজার বছরের ইতিহাসে বাঙালি জাতির বহু লড়াই-সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় স্বাধীন হবার ইচ্ছাটি এই পর্বে এসে তীব্র হয়ে ওঠে। ধীরে ধীরে জনমত স্বাধীনতার দিকে ধাবিত হয়।

‘‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’’


বঙ্গবন্ধুর এই ঐতিহাসিক ঘোষণার মধ্য দিয়ে সমগ্র জনতা এক সর্বাত্মক লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিতে থাকে। সেই চেতনা, বাসনা এবং আকুলতার তালে তাল মিলিয়ে সিলেটবাসীও উদ্বেলিত হয়েছিলো সেদিন। মহান মুক্তিযুদ্ধের রণ-সংগ্রামে সিলেটের রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল অবদান। এম আতাউল গণি উসমানীসহ মুক্তিযুদ্ধের বেশ কিছু দিকপাল ছিলেন সিলেটের মানুষ। মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে সিলেটবাসী ইতিহাসে আরো একবার স্বাধীন ইচ্ছার প্রকাশ ঘটালেন। এই গৌরব সিলেটের একান্তই নিজস্ব।

লেখক: সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসার
বালাগঞ্জ, সিলেট।

সিলেটভিউ২৪ডটকম/২১ জুন ২০১৯/আরআই-কে

সম্পাদক : মো. শাহ্ দিদার আলম চৌধুরী
উপ-সম্পাদক : মশিউর রহমান চৌধুরী
✉ sylhetview24@gmail.com ☎ ০১৬১৬-৪৪০ ০৯৫ (বিজ্ঞাপন), ০১৭৯১-৫৬৭ ৩৮৭ (নিউজ)
নেহার মার্কেট, লেভেল-৪, পূর্ব জিন্দাবাজার, সিলেট
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.