Sylhet View 24 PRINT

নরবলি/কল্লাকাটা: মিথ না বাস্তবতা (পর্ব-২)

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৯-০৭-২৩ ১৩:৩০:০৩

আব্দুল হাই আল-হাদী :: হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস অনুসারে, সত্য যুগের কোনো এক সময়ে মহাদেবের উপর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য দক্ষ রাজা বৃহস্পতি নামে এক যজ্ঞের আয়োজন করেছিলেন। কন্যা সতী দেবী তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে ‘যোগী’ মহাদেবকে বিয়ে করার কারণে দক্ষ ক্ষুব্ধ ছিলেন। দক্ষ মহাদেবকে অপমান করেন। সতী দেবী তাঁর স্বামীর প্রতি এ অপমান সহ্য করতে না পেরে যোগবলে আত্মাহুতি দেন। শোকাহত মহাদেব রাগান্বিত হয়ে দক্ষের যজ্ঞ ভ-ুল করেন এবং সতী দেবীর মৃতদেহ কাঁধে নিয়ে বিশ্বব্যাপী প্রলয় নৃত্য শুরু করেন। অন্যান্য দেবতা অনুরোধ করে এই নৃত্য থামান এবং বিষ্ণুদেব তাঁর সুদর্শন চক্র দ্বারা সতী দেবীর মৃতদেহ ছেদন করেন।

এতে সতীর দেহখন্ড সমূহ ভারতীয় উপমহাদেশের ৫১ টি জায়গায় পতিত হয় এবং পবিত্র পীঠস্থান (শক্তিপীঠ) হিসেবে পরিচিতি ও মর্যাদা পায়। শক্তিপীঠ নামাঙ্কিত তীর্থগুলিতে দেবী সতীর দেহের নানান অঙ্গ প্রস্তরীভূত অবস্থায় রক্ষিত আছে। বাংলাদেশে শক্তিপীঠের সংখ্যা ৬টি তার মধ্যে দু’টি সিলেটে অবস্থিত। এদের একটি সিলেট সদরের ’কালাগুলের গ্রীবাপীঠ’ এবং অপরটি হচ্ছে কানাইঘাট উপজেলার ’বামজঙ্ঘাপীঠ’।

মোহাম্মদ আব্দুল হাই তাঁর ’সিলেটের প্রতœসম্পদ’ বইতে এ ’বামজঙ্ঘাপীঠ’ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনার প্রয়াস পেয়েছেন। প্রতœতাত্ত্বিক বর্ণনার পাশাপাশি তিনি এটির অবস্থান, গুরুত্ব, অতীত ও বর্তমান সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। ’দেবতার উদ্দেশে মানব বলি’ দেওয়ার ঘটনার সূত্রপাত কিভাবে এখানে চালু হলো-তার বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে ’সিলেটের প্রতœসম্পদ’ বইতে। স্যার এডওয়ার্ড গেইটের মতে, ফালজুরের বামজঙ্ঘাপীঠেও প্রচুর নরবলি দেওয়া হত। তিনি ঔপনিবেশিক প্রশাসক ও গবেষক ছিলেন। সেজন্য তাঁর এ দাবির ব্যাপারটি প্রথম পর্বে আলোচিত হলে অনেকেই তা গ্রহণ করতে দ্বিধাগ্রস্থ ছিলেন। কিন্তু বিশিষ্ট গবেষক অচ্যূতচরণ চৌধুরী তত্ত্বনিধি তো বাংলার ভুমি সন্তান এবং তাঁর দেশপ্রেম ও স্বজাতির প্রতি মমত্ববোধ নিয়ে প্রশ্ন উঠানোর কোন সুযোগ নেই। তিনি স্পষ্ট ভাষায় দ্বিধাহীনভাবে এখানে নরবলি সংঘটনের ব্যাপারটি স্বীকার করেছেন। তাঁর মতে, ‘এই মহাপীঠ শ্রীহট্ট নগরী হইতে ৩৮ মাইল উত্তর-পূর্বে পর্ব্বত পাদদেশে একখ- সমতল ভূমে, ইষ্টক নির্মিত প্রকা- এক ভিত্তির মধ্যস্থিত চতুষ্কোণ অগভীর গর্ত্ত মধ্যে ও একখানি চতুষ্কোণ প্রস্তরোপরি অবস্থিত। ভৈরবও প্রস্তরুপী হইয়া দেবীর সহিত একত্র অবস্থান করিতেছেন। ১৮৩৭ খৃস্টাব্দ পর্য্যন্ত এই স্থানে বহুতর নরবলি হইয়া গিয়াছে। ইংরেজ রাজ এই নৃশংস প্রথা রহিত করিবার জন্য জয়ন্তীয়া দখল করে লন। তদবধি নরবলি বন্ধ হইয়াছে।’ (অচ্যূৎচরণ চৌধুরী তত্ত্বনিধি ২০০২ : ৬৭-৬৮)। অর্থাৎ প্রাচীন জৈন্তারাজ্যের যে দু’টি স্থানে ’নরবলি’/কল্লাকাটা হত, তার মধ্যে ’বামজঙ্ঘাপীঠ’ অন্যতম।

এ মহাপীঠ প্রকাশের কথা এখনও স্থানীয় লোকমুখে শুনা যায়। অচ্যতচরণ চৌধুরী তত্বনিধি এ মহাপীঠ প্রকাশের কাহিনী এবং একই সাথে নরবলি প্রথা কিভাবে এখানে শুরু তাঁরও আলোচনা করেছেন। তাঁর মতে, ’জয়ন্তিয়ার বড় গোসাঞ্জির রাজত্বকালে (১৫৪৮-১৫৬৪ খৃস্টাব্দ পর্য্যন্ত) একদা কতিপয় রাখাল বালক একখ- প্রস্তরের সন্নিকটে নানারুপ খেলা করিতেছিল। ক্রীড়াচ্ছলে তাহাদের মধ্যে একজন রাখাল পূজক সাজিলে, অপর বালক ছাগশিশুরুপে তদ্বৎ শব্দ করিতে লাগিল। অন্য বালকেরা পুষ্পাদি আনিয়া দিলে ব্রাক্ষণরূপী বালক পূজায় বসিল। দৈবক্রমে তাহারা সেই প্রস্তরকেই পূজা করিল। পূজা সমাধা হইলে বলির জন্য ছাগরুপী বালক আনীত হইল এবং বিন্না তৃণের দীর্ঘ-পত্ররুপ খড়্গে ছাগরুপী বালকের গলদেশে আঘাত করা হইলো। কিন্তু ইহাতে এক অলৌকিক সাঙ্ঘাতিক ব্যাপার সংঘটিত হইল, বিন্নাতৃণপত্রের আঘাতে সেই বালক দেহ দ্বিখ-িত হইয়া গেল!! ভয়ত্রস্ত বালকদল যার যার গৃহে দৌড়িয়া গেল, মুহূর্ত্তে সেই স্থান জনতা পূর্ণ হইল। এই অদ্ভূত হত্যা বিবরণ রাজপুরুষগণ কর্তৃক রাজার শ্রুতি গোচর হইল; রাজা বড় গোসাঞ্জি (প্রথম) এই আশ্চর্য ঘটনা শ্রবণে কৌতুহলাবিষ্ট হইয়া, স্বীয় গুরুদেবকে সঙ্গ করতঃ স্বয়ং ফালজোরে গমণ করেন। জয়ন্তীরাজের গুরু একজন প্রসিদ্ধ তান্ত্রিক ও সিদ্ধপুরুষ ছিলেন। তিনি বালকদের খেলা স্থলে উপস্থিত হইয়া, সে প্রস্তরখ- দর্শনে বিস্মিত হইলেন ও আধ্যাত্বিক প্রমাণ প্রাপ্তে তাহাকেই বামজঙ্ঘা পীঠের ভৈরবী জয়ন্তীদেবী বলিয়া প্রকাশ করিলেন। মহারাজ, নিজ রাজ্যের জয়ন্তীয়া নাম হওয়ার মূল কারণ এই দেবীর পরিচয় প্রাপ্তে অত্যন্ত প্রফুল্ল হইলেন। ঢাক ঢোল বাজাইয়া আনন্দ প্রকাশ করিলেন এবং দেবীকে নিজপাটে (রাজধানীতে) লইয়া যাবার জন্য খনক নিয়োজিত করিলেন। কিন্তু খনন কারীরা ক্রমাগত খনন করিয়াও প্রস্তর খ-ের নি¤œপ্রান্ত বাহির করিতে সমর্থ হইলনা; কারণ-কিছুটা খনন করিলেই পার্শ্বোত্থিত ভূরি পরিমাণ বালুকায় গর্ত্তটি পুরিয়া যাইতে লাগিল। পুনঃ পুনঃ চেষ্টা করিয়া অকৃতকার্য্য হইলে, তাহা দৈব অভিপ্রায়ে সংঘটিত হইতেছে ভাবিয়া, রাজা সেই যাত্রায় ক্ষান্ত হইলেন ও সেই স্থান সুচারুরুপে বাঁধাইয়া দিলেন। অনতিবিলম্বে চতুর্দ্দিক প্রাচীরবেষ্টিত হইলো এবং প্রাচীরের গায় সহ¯্র প্রদীপ প্রজ্বালনের ও নিয়মিত পূজা পরিচালনের সুব্যবস্থা হইল।

সেই যে রাখাল বালক অলৌকিকভাবে নিহত হয়, তাহাতেই দেবীর নিকটে নরবলি দেওয়ার প্রথা জয়ন্তিয়ায় প্রবর্তিত হইয়াছিল। বড়ই আশ্চর্যের বিষয় যে, প্রায় একই সময়ে কোঁচরাজ বিশ্বসিংহ কর্তৃক কামাখ্যা মহাপীঠ আবিস্কৃত হয়।’ (অচ্যূৎচরণ চৌধুরী তত্ত্বনিধি ২০০২ : ৬৮-৬৯)।

দেবীর উদ্দেশে মানুষকে বলি দেওয়ার এ দাবির প্রায় শতাধিক বছর পেরিয়ে গেছে। সে দাবিকে চ্যালেঞ্জ করেছেন কিংবা কেউ খারিজ করতে পেরেছেন বলে জানা নেই। মানুষকে বলি দেওয়ার পীঠস্থানটি আজও কালের সাক্ষী হিসেবে টিকে আছে। তবে কী নরবলি মিথ, না এক কঠিন বাস্তবতা?

লেখক : প্রধান নির্বাহী, সেভ দ্য হেরিটেজ এন্ড এনভায়রনমেন্ট

সম্পাদক : মো. শাহ্ দিদার আলম চৌধুরী
উপ-সম্পাদক : মশিউর রহমান চৌধুরী
✉ sylhetview24@gmail.com ☎ ০১৬১৬-৪৪০ ০৯৫ (বিজ্ঞাপন), ০১৭৯১-৫৬৭ ৩৮৭ (নিউজ)
নেহার মার্কেট, লেভেল-৪, পূর্ব জিন্দাবাজার, সিলেট
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.