Sylhet View 24 PRINT

নিদ্রাহীন রাতের ভাবনা

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৯-০৮-০৬ ১৫:০৮:৪৭

নিরঞ্জন দে যাদু :: আমাদের ছাত্রজীবনে একটি কলম দিয়ে সারাজীবন লেখা যেতো। ভেঙে না গেলে বা হারিয়ে না গেলে একটি কলমেই চলতো সারা জীবনের লেখা। স্কুলের খাতা, পরীক্ষার খাতা, বাসায় পড়ালেখা, উদ্ভিন্ন যৌবনের প্রথম প্রেমপত্র, বাজারের ফর্দ, চাকুরীর লিখিত ইন্টারভিউ, পেশাজীবনের হিসেবনিকেষ, চিঠিপত্র, মহামূল্য স্বাক্ষর সবই ঐ এক কলমে। একসময় ব্যক্তির সাথে কলমটির পরিচয় অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে যেতো। তখন বলা হতো এটা 'বাবার কলম', ওটা 'মায়ের কলম', ওটা 'দিদির কলম'।

একসময় এই কলম শ্রদ্ধার সাথে হস্থান্তর হতো। বাবার কলম যেতো সন্তানের হাতে। আমিও পেয়েছিলাম। সে কী আনন্দ - বলে বুঝানো যাবেনা। কতো রকম উল্টেপাল্টে দেখতাম, কী মসৃণ লেখা। লিখেও আনন্দ পেতাম, মনেহতো বাবা আছেন সাথে।

কলমের নাম উয়িংসঙ, মেইড ইন চায়না। সাথে উয়িংসঙ কালির দোয়াত। কলমের পেছন দিকটা খুলে পাম্প করে দোয়ত থেকে কালি ভরতে হতো। বেশি ভরলে তিনি আবার বমি করতেন। হাতের আঙুল কালিতে ভরে যেতো। তখন সেই হাত মাথার চুলে মুছতাম। আরেকটি কালি ছিলো নাম 'সুলেখা'। সুলেখা কলম ছিল নীব বের করা।

পরীক্ষার হলে দুটো কলম ও সাথে কালির দোয়াত, বাকসের ভিতরে কাপড়ের টুকরো নেয়া হতো। কারন কালি ভরতে যদি হাতে লাগে বা বমি হয় তখন মুছতে হবে, পরীক্ষা বলে কথা।

এইচ এস সি'র প্রথমবর্ষ পর্যন্ত মুরারিচাঁদ কলেজে এই কলম দিয়ে লিখেছি। তারপর আসলো বলপেনের যুগ। তখনো বলপেনের ভেতরে কালির টিউব ঢুকানো যেতো। তাই কলমটি ফেলে না দিয়ে কালি শেষ হলে টিউব ঢুকিয়ে নিয়ে লেখা চলতো।

এবার এলো ওয়ান টাইম বলপেন। লেখো আর কালি শেষ হলে ছুড়ে ফেলো। এখন আর 'বাবার কলম' সে শ্রদ্ধাটি নেই। কারো কলম নয় সে। যখন যার হাতে তার। অনেকে লিখে পকেটে ঢুকিয়ে নিয়েও যায় অবলীলায়। দোকানে বা অফিসে কলমকে তাই শক্ত সূতা দিয়ে ডিগরা দিয়ে রাখতে হয়, পাছে কেউ নিয়ে যায়।

আমরা কলমকে শ্রদ্ধা করতাম, পায়ে লাগাতামনা, ভুলক্রমে লেগেগেলে সাথে সাথে মাথায় লাগাতাম। কলম গুলো যত্নে আলমারি বা ড্রয়ারে রাখা হতো। দাদুর কলম, বাবার কলম-এ যেনো একটি পরিবারের শিক্ষা-সংস্কৃতি-মূল্যবোধ এগুলোর পরিচায়ক হয়ে উঠতো।

এমন অনেক ঐতিহাসিক ব্যক্তির ব্যবহৃত কলম অনেক পরিবারে বা মিউজিয়ামে রক্ষিত ও প্রদর্শিত হতো।
আজ ওয়ানটাইমের যুগ। কলম একটি পণ্য। লেখো আর ছুড়ে ফেলো।

ময়লার ঝুড়িতে, রাস্তাঘাটে, নালানর্দমায়, পায়ের নিচে। ওয়ানটাইম বলে কথা। খাবার ডিস, গ্লাস, কাপ, চামচ সবইতো ওয়ানটাইম। যতক্ষণ কাজে লাগবে রাখো, যখন কাজ হবেনা ছুড়ে ফেলো।

বিদ্যাটাও ওয়ানটাইম হয়েগেছে কিনা ভাবছি! ভালোবাসাটা? সম্পর্ক গুলো? ভাইয়ে ভাইয়ে, ভাই বোনে, বোনে বোনে। বন্ধুত্ব গুলোর কি অবস্থা? ওয়ানটাইম?

মূল্যবোধ গুলোকি ওয়ানটাইম? বিশ্বাস? শ্রদ্ধা?
বিদ্যাটাই তো স্বার্থপরতা শিখায়, শিখায় অশ্রদ্ধা। আত্মকেন্দ্রিকতা।
শিখায় কুপমন্ডুকতা, শিখায় হিংসা বিদ্বেষ।

বই ঊঠে যাবে আসবে ই-বুক। নতুন বইয়ের গন্ধ কোথায় পাবো।
ওয়ানটাইম কলমের শিক্ষায় শ্রদ্ধাটা পথেই হারিয়ে ফেলেছি আমরা।

আমার সন্তানকে কি একটি কলম দিয়ে যেতে পারবো, যা দিয়ে আমি সারা জীবন আমর লব্ধ জ্ঞান প্রকাশ করেছি। যে আমাকে নির্মাণ করেছে?

এখন তাই মানুষ গুলোও ওয়ানটাইম। যে যাকে প্রয়োজনে ব্যবহার করে তারপর ছুড়ে ফেলে।

খুব মিস করি 'বাবার কলম'
আমার সন্তান যার স্বাদ-ই পেলনা।

লেখক: নাট্য সংগঠক ও নির্মাতা।

সম্পাদক : মো. শাহ্ দিদার আলম চৌধুরী
উপ-সম্পাদক : মশিউর রহমান চৌধুরী
✉ sylhetview24@gmail.com ☎ ০১৬১৬-৪৪০ ০৯৫ (বিজ্ঞাপন), ০১৭৯১-৫৬৭ ৩৮৭ (নিউজ)
নেহার মার্কেট, লেভেল-৪, পূর্ব জিন্দাবাজার, সিলেট
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.