Sylhet View 24 PRINT

রত্নগর্ভা এক কিংবদন্তির চিরপ্রস্থান

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৯-০৮-০৭ ১৩:০২:০৭

:: আব্দুল হাই আল-হাদী ::

‘সে খেলা ফুরালো, সে সুর মিলালো,
নিভিলো কনক আলো ;
দিয়ে গেছ মোরে শত পরাজয়
ফিরে এসো জয়রথে।’

শতবর্ষী বটবৃক্ষটি আর নেই। শ্রাবণের শান্ত-সৌম-মৌন সন্ধ্যায়, চিরসত্যের হাত ধরে না ফেরার দেশে চলে গেছেন তিনি! চলে গেছেন বকুল-বিছানো পথে, না ফেরার দেশে। যে বটবৃক্ষের সুশীতল ছায়াতলে বিকশিত হয়েছে ক্ষণজন্মা এক মহাপুরুষের, যার ঔরষে জন্মেছে আরও অনেক রত্নের। শতবর্ষী সে বটবৃক্ষের চলে যাওয়াতে যে ক্ষতি হলো তা এককথায় অপুরণীয়।

বটবৃক্ষের নাম-সামিরুন্নেছা। সবার কাছে যিনি পরিচিত ‘হাকিম সাবের’ স্ত্রী হিসেবে। বাপের বাড়ি কানাইঘাটের দুর্গাপুর গ্রামে। কিন্তু সে হাকিমসাব-টা যে কে- তা অনেকের কাছেই অজানা। হাকিম সাবের নাম ‘মোহাম্মদ মনসুর’। ব্রিটিশ ভারতে গোয়াইনঘাটের এক অজোপাড়া গায়ে তার জন্ম। কিন্তু প্রবল ইচ্ছাশক্তি আর মেধার জোরে অনেক কষ্টে তিনি গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করতে পেরেছিলেন। এরপর ১৯২৭ সালে তিনি ম্যজিস্ট্রেট হিসেবে যোগদান করেন। সর্বভারতীয়দের মধ্যে অজোপাড়া গায়ের এক ছেলে প্রতিযোগিতা করে ম্যজিস্ট্রেট হিসেবে নিয়োগ পাওয়া কত কষ্টকর ছিল, তা সহজেই অনুনেয়। অত্যন্ত সততা, আন্তরিকতা, দক্ষতা ও ন্যায়পরায়তার সাথে দায়িত্ব পালন করে ১৯৬৩ সালে তিনি অবসর গ্রহণ করেন। পেনসনের সে টাকা দিয়ে তিনি সহজেই ঢাকা কিংবা সিলেট শহরে বিলাসী বাড়ি করতে পারতেন। কিন্তু না, তিনি তা করেননি। সাধারণ মানুষের উন্নয়ন আর শিক্ষার প্রসারের জন্য তিনি বাড়ি করলেন দরবস্তে। জায়গা-জমি কিনলেন। তার প্রদত্ত জায়গার উপরই সেন্ট্রাল জৈন্তা উচ্চ বিদ্যালয়ের স্থায়ী ক্যাম্পাস গড়ে উঠে। যদিও পরে আরও অনেকেই জমি দান করেছেন। পাকড়ী সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, বিদ্যালয়ের মসজিদ সব তার দানকৃত জায়গার উপরই গড়ে উঠে। এরপর তার উইল মতো সন্তানরা মাদরাসার জন্য জায়গা দান করেন যেটি এখন বিখ্যাত ‘দরবস্ত আল-মনসুর মাদরাসা’। অবসর জীবনে তিনি সেন্ট্রেল জৈন্তা উচ্চ বিদ্যালয়ে অবৈতনিক শিক্ষক হিসেবে ক্লাস নিয়েছেন। সমাজসেবার পাশাপাশি তিনি নিজের সন্তানদের লেখাপড়ার প্রতি ছিলেন খুবই যত্নবান। যার ফলশ্রুতিতে তার দু’ছেলে চিকিৎসক, একজন প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব, একজন শিক্ষক ও জনপ্রতিনিধি হতে পেরেছিলেন। এমনকি যখন নারীর উচ্চশিক্ষা প্রায় চিন্তাই করা যেতনা, সে সময় তিনি নিজের একমাত্র মেয়েকে উচ্চশিক্ষিত করতে পেরেছিলেন। শিক্ষক বানিয়েছিলেন। স্বামীর মৃত্যুর পর সে দায়িত্ব তুলে নেন মহিয়সী এ রমণী। তিনি সেন্ট্রাল জৈন্তা উচ্চ বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য ছিলেন। তারই অনুপ্রেরণা ও নিবিড় পরিচর্যা নাতি-নাতনিরাও স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। একজন নির্বাহী ম্যজিস্ট্রেট, একজন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক, একজন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, আরেকজন কলেজের শিক্ষকতার সাথে জড়িত। বর্তমানে অন্যরাও উচ্চশিক্ষায় অধ্যয়নরত মেয়ের পক্ষের নাতি-নাতনীরাও স্ব স্ব ক্ষেত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত।

একজন জীবন সঙ্গীর অনুপ্রেরণা ও সহযোগিতা ছাড়া ‘হাকিম সাহেবের’ এককভাবে এসব সমাজকর্ম ও সন্তানদের মানুষ করা সম্ভব হতো না। স্বামীর ছায়াসঙ্গী ও অনুপ্রেরণার উৎস মহিলাটি ছিলেন একজন আদর্শ স্ত্রী, সন্তানদের কাছে একজন আদর্শ ও সফল মা। নাতি-নাতনীদের কাছে আলোর বাতিঘর একজন আদর্শ দাদি/নানী।

‘রত্নগর্ভা’ সে মানুষটির জানাজার পর দাফন-কাফন শেষ হয়েছে। সমাজের সকল শ্রেনী-পেশার মানুষ এতে অংশগ্রহণ করেন।কেউ বাড়িতে যাচ্ছেন সমবেদনা প্রকাশ করতে, কেউবা যাচ্ছেন কবর জিয়ারতে। প্রয়াত সে রত্নগর্ভাকে নিয়ে আফসোস করছেন অনেকেই। কিন্তু সরকার এসব ‘রত্নগর্ভা’ মাদের সম্মানিত করতে অনেক আগেই ‘জয়িতা’ পদক প্রবর্তন করেছেন। যারা আজকে আফসোস করতে শুনলাম, তাদের কাছে জানতে ইচ্ছে হচ্ছিল- ‘জয়িতা’ নির্বাচন প্রক্রিয়ার সাথে তো সর্বদাই আপনারা জড়িত ছিলেন। এরকম একজন মানুষ, সামিরুন্নেছা, যদি ‘জয়িতা’ না হন, তবে কে আর হবে ‘জয়িতা’ পদক পাওয়ার যোগ্য? অন্তত: কেউ তো কোনদিন সরকারের কাছে তার ব্যাপারে প্রস্তাবও করেননি। উপজেলার কিংবা ইউনিয়নের তথ্যবাতায়নে ম্যজিস্ট্রেট মোহাম্মদ মনসুর ওরফে হাকিম সাহেবের নাম উঠাতে আপত্তি কোথায়? তিনি কী এতই অধম যে তাঁর নামটি বিখ্যাতদের তালিকা উঠানো যায়না। এটা কী উদাসীনতা না ইতিহাসের সত্য লুকানোর কোন প্রচেষ্টা?? আসলে যে দেশে গুণীর কদর নেই সেখানে কিন্তু গুণীর জন্ম হয়না। মানুষের মৃত্যুর পর হৈ চৈ দেখে, মানুষের বিচিত্র কাজকারবার দেখে সে গানের কথাটিই বারবার বেজে উঠে--

‘জীবনে যারে তুমি দাওনি মালা
মরণে কেন তারে দিতে এলে ফুল।
মুখপানে যার কভু চাওনি ফিরে
কেন তারই লাগিয়া অশ্রু -আকুল।।
মরণে কেন তারে দিতে এলে ফুল’

সম্পাদক : মো. শাহ্ দিদার আলম চৌধুরী
উপ-সম্পাদক : মশিউর রহমান চৌধুরী
✉ sylhetview24@gmail.com ☎ ০১৬১৬-৪৪০ ০৯৫ (বিজ্ঞাপন), ০১৭৯১-৫৬৭ ৩৮৭ (নিউজ)
নেহার মার্কেট, লেভেল-৪, পূর্ব জিন্দাবাজার, সিলেট
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.