Sylhet View 24 PRINT

বঙ্গবন্ধু ও তাঁর কূটনৈতিক দর্শন

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৯-০৮-১৫ ০০:৩১:০৬

ড. এ কে আব্দুল মোমেন :: স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ এ বাঙালি শুধু একজন মানুষই নন, একটি চেতনা, একটি অধ্যায়। তিনি এ দেশের গণমানুষের মুক্তির উপলক্ষ, এ জনপদের বহুদিনের লালিত স্বপ্ন স্বাধীনতার রূপকার। তাঁর হাত ধরেই লাল-সবুজের একটি স্বাধীন পতাকার অধিকার পায় এ বঙ্গভূমি। পাকিস্তানি শাসক-শোষকদের কূটকৌশল ছিন্ন করে তাঁর দূরদর্শী রাজনীতি ও প্রাজ্ঞ নেতৃত্বের বলেই ১৯৭১ সালে বিশ্বের মানচিত্রে অংকিত হয় আমাদের এই প্রাণের বাংলাদেশ। স্বাধীনতা অর্জনের পর পরই তিনি এ দেশের মাটি ও মানুষকে পুঁজি করে সবার জন্য শান্তির দেশ গড়ার অঙ্গীকার করেন। সেই অঙ্গীকারের প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই ২৬ মার্চ, ১৯৭২ স্বাধীনতার প্রথম বর্ষে জাতির উদ্দেশে দেয়া তাঁর ভাষণে। বরাবরের সেই তেজোদীপ্ত বলিষ্ঠ কণ্ঠে তিনি উচ্চারণ করেন, ‘আমি ভবিষ্যৎ বংশধরদের সুখী ও উন্নত জীবন প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি।’ সেই প্রতিশ্রুতি তিনি অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন তাঁর জীবদ্দশার প্রতিটি মুহূর্তে। সুখী-সমৃদ্ধ যে বাংলাদেশ আজকে গোটা বিশ্বের কাছে উন্নয়নের বিস্ময়, এর মূল ভিত্তি রচনা করে গেছেন স্বয়ং বঙ্গবন্ধু।

স্বাধীনতার পর মাত্র সাড়ে তিন বছরের মধ্যে তিনি ধ্বংসপ্রাপ্ত একটি দেশের অবকাঠামো পুনর্নির্মাণ, একটি আদর্শ সংবিধান রচনা, প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা প্রণয়ন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক, ইউজিসিসহ নানা প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামো গড়ে তুলেছেন নিখুঁত দক্ষতায়। দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের ফলে ভেঙে পড়া অর্থনীতির চাকাকে ফের চালু করা, খাদ্য সাহায্য ও উৎপাদন নিশ্চিত করাসহ নানামুখী কর্মতত্পরতায় নিজেকে সর্বক্ষণ নিয়োজিত রেখেছিলেন বঙ্গবন্ধু। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার পাশাপাশি মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে এবং অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ একটি জাতি গঠনে তিনি একের পর এক গ্রহণ করেছেন নানা কর্মপরিকল্পনা। সংবিধানের প্রস্তাবনায় একটি শোষণমুক্ত, সমাজতান্ত্রিক সমাজ গঠনের অঙ্গীকার করেন তিনি। যেখানে বলা হয়েছে, এ দেশের নাগরিকদের মানবাধিকার, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য এবং সুবিচার নিশ্চিত করাই হবে রাষ্ট্রের প্রধান দায়িত্ব।

দেশের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেয়ার স্বল্প সময়ের মধ্যে বিশ্বের প্রায় সব রাষ্ট্রের স্বীকৃতি আদায় এবং জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্যপদ লাভ ছিল বঙ্গবন্ধু সরকারের উল্লেখযোগ্য কূটনৈতিক সাফল্য। স্বাধীনতা লাভের অল্প দিনের মধ্যেই দেশ পুনর্গঠনে বহুমুখী কর্মসূচি গ্রহণ, পুরো দেশবাসীকে এ কাজে উজ্জীবিতকরণ এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে দেশের ভাবমূর্তি উন্নয়নে বঙ্গবন্ধুর নেয়া পদক্ষেপগুলো আশাতীত সাফল্য অর্জন করে।

পাকিস্তানের কারাগার থেকে ১৯৭২ সালের ৭ জানুয়ারি রাতে মুক্ত হয়ে বিশেষ বিমানে পরের দিন ভোরে লন্ডন পৌঁছেন বঙ্গবন্ধু। ৮ তারিখ সন্ধ্যায় তিনি বৈঠক করলেন তত্কালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথের সঙ্গে। লন্ডন থেকে দেশে ফিরলেন দিল্লি হয়ে ১০ জানুয়ারি। দিল্লিতে স্বল্পকালীন যাত্রাবিরতির সময় বঙ্গবন্ধুকে উষ্ণ সংবর্ধনা দেয় ভারত সরকার। সেদিনের সেই ঐতিহাসিক সংবর্ধনায় উপস্থিত ছিলেন ভারতের রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি, প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীসহ মন্ত্রিপরিষদের অনেক সদস্য ও লাখো ভারতবাসী। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়েই তিনি ঘোষণা করেন, ‘আমরা একটি ছোট রাষ্ট্র, আমাদের সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব হবে এবং কারো সঙ্গে শত্রুতা নয়।’ এ ঘোষণাতেই বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শী কূটনৈতিক বিচক্ষণতার পরিচয় মেলে। তিনি খুব ভালো করেই বুঝেছিলেন যে ভঙ্গুর অর্থনীতির এ দেশটি নিয়ে সবার সহযোগিতা ছাড়া সামনে অগ্রসর হওয়া সম্ভব নয়। সেজন্যই তিনি সবার সঙ্গে বন্ধুত্বের ওপর জোর দিয়েছিলেন।

একটি দেশের পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়ন ও তার বাস্তবায়ন নির্ভর করে দেশটির নেতৃত্বের রাজনৈতিক দর্শন ও বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে ওই দেশের সম্পর্কের সমীকরণের ওপর। পররাষ্ট্রনীতির সফলতার জন্য শুধু শক্তিশালী পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়ন করলেই চলবে না, এর সফল বাস্তবায়নের জন্য শক্তিশালী নেতৃত্ব থাকতে হবে। বঙ্গবন্ধু ছিলেন একজন শক্তিশালী ও বিচক্ষণ নেতৃত্বের পুরোধা ব্যক্তিত্ব। তাঁর দেয়া পররাষ্ট্রনীতির মূল দর্শনই হলো ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়’, ‘বন্ধুত্বপূর্ণ সহাবস্থান’ এবং জোটনিরপেক্ষ অবস্থান। এ কূটনৈতিক দর্শনের ওপর ভিত্তি করেই আজকের বাংলাদেশ বিশ্বসমাজের সঙ্গে দৃঢ়তর সম্পর্ক গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে। বিশ্বের প্রায় সব রাষ্ট্রের সঙ্গেই রয়েছে বাংলাদেশের অত্যন্ত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। এর ভিত্তিও রচনা করে গেছেন সহস্র বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্য ‘জাতির পিতা’ হিসেবে যা যা করার, তিনি তা-ই করে গেছেন। মাত্র দুই মাসের মাথায় বিদেশী সৈন্য ফেরত যাওয়া তাঁর কারণেই সম্ভব হয়। দেশের জন্য মাত্র ১০ মাসের মধ্যে তিনি একটি অপূর্ব শাসনতন্ত্র দিয়ে যান।

তাঁর কূটনৈতিক দর্শন ছিল অত্যন্ত তীক্ষ ও প্রখর। ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই বঙ্গবন্ধু ভারতের সঙ্গে গঙ্গার পানি বণ্টনের ফর্মুলা নির্ধারণে জোরদার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ভাটির দেশ হিসেবে গঙ্গার পানির ৪৪ হাজার কিউসেক হিস্যা পাওয়ার সম্মতি তিনি আদায় করেন বাংলাদেশের পক্ষে। পানি বণ্টনের এ উদ্যোগের ফলে ১৯৬৮-৬৯ সালের ১১ হাজার শক্তিচালিত পাম্পের স্থলে ১৯৭৪-৭৫ সালে পাম্পের সংখ্যা দাঁড়ায় ৩৬ হাজার। এতে সেচের আওতাধীন জমির পরিমাণ এক-তৃতীয়াংশ বৃদ্ধি পেয়ে ৩৬ লাখ একরে উন্নীত হয়। গঙ্গা নদীর প্রবাহ থেকে অধিক পানি প্রাপ্তি, সেচ ব্যবস্থার প্রসার, ভর্তুকি দিয়ে অধিক হারে উন্নত বীজ, সার ও কীটনাশকের ব্যবহার, অতিরিক্ত খাসজমি প্রাপ্তি ২৫ বিঘা জমির ওপর দেয় কর মাফ এবং মূল্য সমর্থনমূলক সচেতন ও কৃষকবান্ধব নীতির ফলে কৃষি ক্ষেত্রে অগ্রগতির যে ধারা সূচিত হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর সময়ে, তার ফলস্বরূপ আজো এ দেশের কৃষি ক্ষেত্রে শক্তিশালী ধারা বজায় রয়েছে। তাঁর সুযোগ্য কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেই ধারাকে আরো বেগবান করেছেন।

বঙ্গবন্ধু সরকারের সফল কূটনৈতিক পদচারণা ও বিচক্ষণ নেতৃত্বের ক্যারিশমায় স্বাধীনতার মাত্র এক বছরের মধ্যেই বাংলাদেশ ১৯৭২ সালে আইএমএফ, আইএলও, আন্তঃসংসদীয় ইউনিয়ন, ইউনেস্কো, কলম্বো প্ল্যান ও গ্যাটের সদস্যপদ লাভ করতে সক্ষম হয়। একই বছরের ৮ আগস্ট বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্যপদের জন্য জাতিসংঘ মহাসচিবের কাছে আবেদন পাঠায়। দুদিন পর বঙ্গবন্ধু নিরাপত্তা পরিষদের সব সদস্যকে বাংলাদেশকে সমর্থনের জন্য অনুরোধ করে বিশেষ পত্র লেখেন। ২৩ আগস্ট যুক্তরাজ্য, ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুগোস্লাভিয়া এক মিলিত প্রস্তাবে বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্তির জন্য নিরাপত্তা পরিষদকে জোরালো সুপারিশ করে। ওই প্রস্তাবে চীনের ভেটো প্রদান সত্ত্বেও ৩০ নভেম্বর ১৯৭২ সাধারণ পরিষদ প্রস্তাবটি সুপারিশ করে। ১৯৭৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ জাতিসংঘের ১৩৬তম স্বাধীন দেশ হিসেবে সদস্যপদ পেয়ে বিশ্বজুড়ে পরিচিতি লাভ করে।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শুধু নিজের দেশের মানুষের কল্যাণের কথাই ভাবেননি, তিনি হূদয় দিয়ে অনুভব করতেন সারা বিশ্বের নিঃস্ব মানুষের দুঃখ-দুর্দশা। তিনি প্রায়ই বলতেন, ‘বিশ্বটা দুই ভাগে বিভক্ত। একদিকে রয়েছে শোষক, অন্যভাগে শোষিত। আমি শোষিতদের দলে।’ বিশ্বের যেকোনো প্রান্তের যেকোনো ধর্ম বা বর্ণের মানুষের ওপর শোষণ বা অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে তিনি কখনো দ্বিধা করেননি। মূলত বঙ্গবন্ধু ছিলেন এমন একজন বিশ্বনেতা, যিনি সবসময়ই শোষিতদের পক্ষে কথা বলতেন। তাঁকে তুলনা করা হতো হিমালয়ের সঙ্গে। তিনি আফ্রিকায় বর্ণবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন; অবসান চেয়েছেন এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকায় বিদেশী শাসনের। বঙ্গবন্ধু যেমন ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছেন, তেমনি গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সাইপ্রাস সরকারকে উত্খাতের নিন্দাও করেছেন। ভিয়েতনামে আমেরিকার বোমাবাজি বন্ধের দাবিও জানায় বাংলাদেশ তাঁর আমলেই।

’৭৫-এর ১৫ আগস্ট সপরিবারে মর্মান্তিকভাবে নিহত হওয়ার আগের পুরোটা সময় তিনি দাপিয়ে বেড়িয়েছেন বিশ্বজুড়ে। নিজে যেমন বাংলাদেশের উন্নয়নের মিশন নিয়ে ভ্রমণ করেছেন বিভিন্ন দেশ, তেমনি বাংলাদেশেও এসেছেন বিভিন্ন দেশের প্রেসিডেন্ট, সরকারপ্রধানরা। ১৯৭৩ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি জাতিসংঘের মহাসচিব ড. কুর্ট ওয়ার্ল্ডহেইম গণভবনে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। যুগোস্লাভিয়ার প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ সফরে আসেন ২৫ মার্চ। বঙ্গবন্ধু ২৬-৩১ জুলাই প্রেসিডেন্ট জোসিপ ব্রোজ টিটোর আমন্ত্রণে যুগোস্লাভিয়া সফর করেন। সফরকালে প্রেসিডেন্ট টিটো ন্যাম ও জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্যপদ লাভের ব্যাপারে পূর্ণ সমর্থন জানান। বঙ্গবন্ধু অটোয়ায় ২-১০ আগস্ট অনুষ্ঠিত কমনওয়েলথ সরকারপ্রধানদের সম্মেলনে যোগদান উপলক্ষে কানাডা সফর করেন। তিনি ৫-৯ সেপ্টেম্বর আলজেরিয়ার রাজধানী আলজিয়ার্সে অনুষ্ঠিত চতুর্থ ন্যাম শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেন। ওই সময় তিনি বাদশাহ ফয়সাল, প্রেসিডেন্ট টিটো, প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত, প্রেসিডেন্ট ইদি আমিন, প্রেসিডেন্ট মুয়াম্মার গাদ্দাফি, প্রধানমন্ত্রী স্লথ প্রমুখ ব্যক্তির সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে মিলিত হন। ১৮ অক্টোবর সাতদিনের এক সফরে টোকিও গমন করেন বঙ্গবন্ধু। ওই বছর তিনি স্বল্প সময়ের জন্য মালয়েশিয়া সফরেও গিয়েছিলেন। মালয়েশিয়ার রাষ্ট্রনায়ক তুন আব্দুর রহমান তাঁকে অকুণ্ঠ সমর্থন দেন।

১৯৭৪ সালের মার্চে বাংলাদেশে এক সংক্ষিপ্ত যাত্রা বিরতিকালে আলজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট হুয়ারি বুমেদিন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে বাংলাদেশ সফরে আসেন মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট ইউ নে উইন। ১২ মে পাঁচদিনের সফরে বঙ্গবন্ধু ভারত যান। ওই সময় দুই দেশের মধ্যে সীমানা চিহ্নিতকরণ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। সেনেগালের প্রেসিডেন্ট লিওপোল্ড সেংঘর ২৬-২৯ মে বাংলাদেশ সফর করেন। ১ জুন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ভুটানের রাজা জিগমে সিংগে ওয়াংচুকের অভিষেক অনুষ্ঠানে যোগ দেন। ভারতের রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি পাঁচদিনের সফরে ঢাকা আসেন ১৫ জুন। ওই মাসেই বাংলাদেশ সফর করেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। সেপ্টেম্বরে দক্ষিণ ভিয়েতনামের প্রেসিডেন্ট নগুয়েন হু থু ঢাকায় এক সংক্ষিপ্ত যাত্রাবিরতি করেন। এর সবই ছিল বঙ্গবন্ধু সরকারের কূটনৈতিক মিশনের ফল। এমনকি কাজী নজরুল ইসলামকে ‘জাতীয় কবি’ হিসেবে স্বীকৃতি এবং বাংলাদেশে স্থায়ীভাবে বসবাসের ব্যবস্থা তাঁর কারণেই সম্ভব হয়।

জানুয়ারি ১৯৭২ থেকে জুলাই ১৯৭৫, মাত্র সাড়ে তিন বছরে যুদ্ধবিধ্বস্ত সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে ৫০টির মতো রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধানের সফরসহ বিভিন্ন পর্যায়ে শতাধিক সফর অনুষ্ঠিত হয় বঙ্গবন্ধু সরকারের সফল কূটনৈতিক তত্পরতায়। ওই স্বল্প সময়ে বাংলাদেশ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সহযোগিতার নানা বিষয়ে ৭০টির বেশি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে। অনেক দেশ ও সংস্থা যেমন সোভিয়েত ইউনিয়ন, সুইডেন, জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, পোল্যান্ড, যুক্তরাজ্য, কানাডা, ডেনমার্ক, অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, বুলগেরিয়া, বেলজিয়াম, আলজেরিয়া, নেদারল্যান্ডস, জাতিসংঘ, ইউনিসেফ, ডব্লিউএফপি, আইডিএ, ইউএনএইচসিআর প্রভৃতি বাংলাদেশকে কোটি কোটি ডলারের বিভিন্ন ধরনের ঋণ, সাহায্য ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা প্রদান করে এবং স্বীকৃতি প্রদান করে আরো বিভিন্নমুখী সহযোগিতার। এ সময় বাংলাদেশ এডিবি, আইসিএও, ইকাফ ও এফএওর সদস্যপদ লাভ করে।

১৯৭৪ সালের মে মাসে ঢাকায় অনুষ্ঠিত বিশ্ব শান্তি পরিষদের তিনদিনের এশিয়া কনফারেন্সে বঙ্গবন্ধুকে শান্তির জন্য ‘জুলিও কুরি’ স্বর্ণপদকে ভূষিত করা হয়। সদ্য স্বাধীনতা অর্জন করা একটি দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের এ পুরস্কার অর্জন নিঃসন্দেহে বিরাট ব্যাপার। বঙ্গবন্ধুর সময়েই ১০ জুলাই পাকিস্তানের জাতীয় সংসদ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য একটি প্রস্তাব পাস করে। এই সেই পাকিস্তান, যারা এ দেশের ৩০ লাখ মানুষকে হত্যা করে রক্তের হোলি খেলায় মত্ত হয়েছিল ’৭১-এ; তারাই বৈশ্বিক চাপে পড়ে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করার জন্য প্রস্তাব উত্থাপন করে সে দেশের সংসদে। এসবই সম্ভব করেছিলেন বঙ্গবন্ধু তাঁর জীবদ্দশায়। তিনি জীবিত থাকতেই সৌদি আরব, সুদান, ওমান ও চীন ছাড়া বিশ্বের সব রাষ্ট্রই বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব, দূরদর্শিতা ও বিশ্বনেতাদের সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত সম্পর্ক উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছিল এসব অর্জনে।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন এ দেশের মানুষের সব আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক। তাঁর মাত্র সাড়ে তিন বছরের শাসনামলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যে অর্জন, যে পদচারণা, যে দীপ্ত পদভার তিনি রেখে গেছেন, তা সবই সোনার আখরে লিখিত রয়েছে বাঙালি জাতির ইতিহাসে। তাঁর প্রণীত পররাষ্ট্রনীতি আজো এ দেশের বৈদেশিক সম্পর্ক নিরূপণের আলোকবর্তিকা। জাতিসংঘে তিনিই ‘বাংলা ভাষায়’ বক্তৃতা শুরু করেন এবং তাঁর বক্তৃতায় যে ২৫টি বিষয় তিনি তুলে ধরেন, সেগুলো আজো বিশ্বের বিবেচ্য বিষয়। তাঁর দেখানো মতবাদের ওপর ভিত্তি করেই উন্নয়নের পথে এ দেশকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাঁরই সুযোগ্য আত্মজা, বিশ্বদরবারে বাংলাদেশের নাম রোশনাইকারী এ দেশের সফল রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা। পিতার পদাঙ্কই অনুসরণ করে তাঁর জয়যাত্রা, তাঁর সফলতা।

লেখক: মন্ত্রী, পররাষ্ট্রবিষয়ক মন্ত্রণালয়

সম্পাদক : মো. শাহ্ দিদার আলম চৌধুরী
উপ-সম্পাদক : মশিউর রহমান চৌধুরী
✉ sylhetview24@gmail.com ☎ ০১৬১৬-৪৪০ ০৯৫ (বিজ্ঞাপন), ০১৭৯১-৫৬৭ ৩৮৭ (নিউজ)
নেহার মার্কেট, লেভেল-৪, পূর্ব জিন্দাবাজার, সিলেট
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.