Sylhet View 24 PRINT

খোকা থেকে রাজনীতির কবি

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৯-০৮-১৬ ০১:০১:৪০

আলী ফজল মোহাম্মদ কাওছার :: বাংলাদেশ বিশ্বের মানচিত্রে এক স্বাধীন দেশের নাম। কিন্তু এই স্বাধীনতা একদিনে আসেনাই। অনেক ত্যাগ তিতিক্ষার পর বাংলাদেশ নামক স্বাধীন রাস্ট্রের জন্ম হয়েছে। আমরা এখন স্বাধীন দেশে শ্বাস প্রশ্বাস নিতে পারছি।

১৭৫৭ সালে আমরা আমাদের স্বাধীনতা হারিয়েছিলাম আর ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর আমরা আমাদের স্বাধীনতা ফিরে পেয়েছিলাম। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন সহ পাকিস্তান বিরোধী বিভিন্ন আন্দোলনে অনেক বাংলা মায়ের দামাল ছেলে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেছেন তাদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন, ক্ষুদিরাম, তিতুমীর, শেরে বাংলা একে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাষানীসহ অনেকে।

ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন সহ পাকিস্তানের শোষণ নিপীড়নের বিরুদ্ধে যে সকল নেতার কন্ঠস্থর ছিল বজ্র কঠিন  বিভিন্ন আন্দোলনে যারা নিজেদের জীবনের লাভ ক্ষতির কথা চিন্তা না করে দেশের কথা চিন্তা করেছেন দেশের মানুষের কথা চিন্তা করে আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়েছেন নেতৃত্ব দিয়েছেন সেই সব নেতাদের মধ্যে উজ্জ্বল একটি নাম ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯২০ সালের ১৭ই মার্চ গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্ম গ্রহণ করেন।

বঙ্গবন্ধুর ডাক ছিল খোকা।  পরিবার পরিজন পাড়া প্রতিবেশীরা কি ভেবেছিল টুঙ্গিপাড়ার সেই খোকা বাঙালী জাতির মহানায়কে পরিণত হবেন। কে মহানায়কে পরিণত হবেন তা কিছু ছোট বেলায় আচ করা যায় সেদিনের সেই খোকা যে নিজিকে সমাজের তরে দেশের তরে  বিলিয়ে দিবেন তা স্কুল জীবনে আচ করা গিয়েছিল। খোকার  রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়েছিল ১৯৩৯ সালে মিশনারি স্কুলে পড়ার সময় থেকেই। এ বছর স্কুল পরিদর্শনে এসেছিলেন তদানীন্তন বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির মুখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক এবং পরবর্তীতে বাংলার প্রধানমন্ত্রী এবং এমনকি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকারী হোসেন শহীদ সোহ্‌রাওয়ার্দী। তিনি স্কুলের ছাদ সংস্কারের দাবীর উপর ভিত্তি করে একটি দল নিয়ে তাদের কাছে যান যার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি নিজেই।

পরবর্তীতে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর স্নেহ ভালোবাসা পরামর্শে  কাটে খোকার রাজনীতির জীবনের অনেক গুলি বছর। বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবী নিয়ে প্রতিষ্ঠিত আন্দোলনে অংশ নেয়ার মাধ্যমে শেখ মুজিবের রাজনৈতিক তৎপরতার সূচনা ঘটে। ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করার জন্য তিনি গ্রেফতার হন।

কিন্তু ছাত্রসমাজের তীব্র প্রতিবাদের মুখে ১৫ মার্চ শেখ মুজিব এবং অন্য ছাত্র নেতাদেরকে মুক্তি দেয়া হয়। এদের মুক্তি উপলক্ষে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় র‌্যালি হয় যাতে মুজিব সভাপতিত্ব করেন। ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি লাহোরে বিরোধী দলসমূহের একটি জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনেই শেখ মুজিব তার ঐতিহাসিক ছয় দফা দাবী পেশ করেন যা ছিল কার্যত পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের পরিপূর্ণ রূপরেখা। যাকে বাঙালির মুক্তির সনদ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। এই  সময় তিনি সিলেট, ময়মনসিংহ এবং ঢাকায় বেশ কয়েকবার পুলিশের হাতে বন্দী হন। বছরের প্রথম চতুর্থাংশেই তাকে আটবার আটক করা হয়েছিল। আইয়ুব খান বিরোধী আন্দোলনে তিনি রাখেন গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা। সেনাবাহিনী কর্তৃক আটক হয়ে জেলে দুই বছর থাকার পর ১৯৬৮ সালের প্রথমদিকে পাকিস্তান সরকার শেখ মুজিব এবং আরও ৩৪ জন বাঙালি সামরিক ও সিএসপি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করে যা ইতিহাসে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নামে সুপরিচিত। মামলায় উল্লেখ করা হয়েছিল শেখ মুজিবসহ এই কর্মকর্তারা ভারতের ত্রিপুরা অঙ্গরাজ্যের অন্তর্গত আগরতলা শহরে ভারত সরকারের সাথে এক বৈঠকে পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার ষড়যন্ত্র করেছে। এতে শেখ মুজিবকে এক নম্বর আসামী করা হয় এবং পাকিস্তান বিভক্তিকরণের এই ষড়যন্ত্রের মূল হোতা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। সকল ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে মুক্তিপান তিনি।

কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ  ১৯৬৯ সালের  ২৩ ফেব্রুয়ারি তারিখে শেখ মুজিবের সম্মানে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) এক সভার আয়োজন করে। লাখো জনতার এই সম্মেলনে শেখ মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু" উপাধি প্রদান করা হয়। উপাধি প্রদানের ঘোষণা দিয়েছিলেন তৎকালীন ছাত্রনেতা তোফায়েল আহমেদ। ১৯৭০ সালে নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পান তঁার নেতৃত্বাধীন আওয়ামীলীগ। তিনি ক্ষমতা গ্রহণ করতে পারেননাই। ১৯৭১ সালের শুরু হয় আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ। পাকিস্তানিদের কাছে গ্রেফতার হওয়ার আগে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা করেন। ১৬ই ডিসেম্বর মুক্ত হয় প্রিয় মাতৃভুমি।

১৯৭২ সালে ১০ই জানুয়ারী দেশে ফিরে যখন দেশ পুর্ণগঠনের কাজে হাত দেন ধীরে ধীরে সফল হচ্ছেলিনেন তখন খন্দকার মোশতাক সহ কিছু মীরজাফরদের চক্রান্তে সেনাবাহিনীর কিছু অকৃতজ্ঞ অফিসারের হাতে  স্বপরিবারে নিহত হন বাঙালী জাতির এই মহানায়ক। তিনি এই পৃথিবী থেকে চলে গেলেও রয়ে গেছেন বাঙালী সহ বিশ্বের মানুষের মনের মনিকোঠায় শ্রদ্ধার আসনে। তাকে নিয়ে রচিত হয়েছে অসংখ্য কবিতা যার আর কোন রাজনৈতিক নেতার ক্ষেত্রে হয়নি। তার মৃত্যুর বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে শোকের ছায়া নেমে আসে। বিশ্বের বাঘা বাঘা নেতারা তাকে নিয়ে করেছেন  স্মৃতিচারণ।
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বিশ্ব নেতাদের উক্তি

১। ‘আমি হিমালয় দেখিনি, বঙ্গবন্ধুকে দেখেছি।’- ফিদেল ক্যাস্ট্রো।

২। আওয়ামিলীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের মত তেজী এবং গতিশীল নেতা আগামী বিশ বছরের মধ্যে এশিয়া মহাদেশে আর পাওয়া যাবে না।- হেনরি কিসিঞ্জার।

৩। শেখ মুজিবকে চতুর্দশ লুইয়ের সাথে তুলনা করা যায়। জনগন তার কাছে এতপ্রিয় ছিল যে লুইয়ের মত তিনি এ দাবী করতে পারেন আমি ই রাষ্ট্র।
--- পশ্চিম জার্মানী পত্রিকা।

৪। শেখ মুজিব নিহত হলেন তার নিজেরই সেনাবাহিনীর হাতে অথচ তাকে হত্যা করতে পাকিস্তানীরা সংকোচবোধ করেছে।
বিবিসি-১৫ আগস্ট ১৯৭৫।

৫। ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হচ্ছেন সমাজতন্ত্র প্রতীষ্ঠার সংগ্রামের প্রথম শহীদ।তাই তিনি অমর।’ –সাদ্দাম হোসেন।

৬। ‘শেখ মুজিবের মৃত্যুতে বিশ্বের শোষিত মানুষ হারাল তাদের একজন মহান নেতাকে,আমি হারালাম একজন অকৃত্রিম বিশাল হৃদয়ের বন্ধুকে।’—ফিদেল কাস্ট্রো।

৭। ‘আপোষহীন সংগ্রামী নেতৃত্ব আর কুসুম কোমল হৃদয় ছিল মুজিব চরিত্রের বৈশিষ্ঠ্য’—ইয়াসির আরাফাত।

৮। ‘মুজিব হত্যার পর বাঙালীদের আর বিশ্বাস করা যায় না,যারা মুজিবকে হত্যা করেছে তারা যেকোন জঘন্য কাজ করতে পারে।’- নোবেল বিজয়ী উইলিবান্ট।

৯। ‘শেখ মুজিবুর রহমান ভিয়েতনামী জনগনকে অনুপ্রাণিত করেছিলেন।’— কেনেথা কাউণ্ডা।

১০। ‘শেখ মুজিব নিহত হবার খবরে আমি মর্মাহত। তিনি একজন মহান নেতা ছিলেন।তার অনন্যসাধারন সাহসিকতা এশিয়া ও আফ্রিকার জনগনের জন্য প্রেরণাদায়ক ছিল।’ –ইন্দিরা গান্ধী।

১১। ‘বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ডে বাঙলাদেশই শুধু এতিম হয় নি বিশ্ববাসী হারিয়েছে একজন মহান সন্তানকে।’– জেমসলামন্ড, ইংলিশ এম পি।

১২। প্রভাবশালী ব্রিটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ানের মতে, 'শেখ মুজিব ছিলেন এক বিস্ময়কর ব্যক্তিত্ব।'

১৩। ফিনান্সিয়াল টাইমস বলেছে, ‘মুজিব না থাকলে বাংলাদেশ কখনই জন্ম নিতনা।’

১৪। ভারতীয় বেতার 'আকাশ বানী' ১৯৭৫ সালের ১৬ আগস্ট তাদের সংবাদ পর্যালোচনা অনুষ্ঠানে বলে, 'যিশুমারা গেছেন। এখন লক্ষ লক্ষ লোক ক্রস ধারণ করে তাকে স্মরণ করছে। মূলত মুজিবকেই তারা যিশুর ভুমিকায় মানছেন...

১৫। একই দিনে লন্ডন থেকে প্রকাশিত ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ লোক শেখ মুজিবের জঘন্য হত্যাকান্ডকে অপূরণীয় ক্ষতি হিসেবে বিবেচনা করবে।’

১৬। নিউজ উইকে বঙ্গবন্ধুকে আখ্যা দেওয়া হয়, ‘পয়েট অফ পলিটিক্স বলে’।

১৭। বৃটিশ লর্ড ফেন্যার ব্রোকওয়ে বলেছিলেন, ‘শেখ মুজিব জর্জ ওয়াশিংটন, গান্ধী এবং দ্যা ভ্যালেরার থেকেও মহান নেতা’।

১৮। জাপানী মুক্তি ফুকিউরা আজও বাঙালি দেখলে বলে বেড়ান, ‘তুমি বাংলার লোক? আমি কিন্তু তোমাদের জয় বাংলা দেখেছি। শেখ মুজিব দেখেছি। জানো এশিয়ায় তোমাদের শেখ মুজিবের মতো সিংহ হৃদয়বান নেতার জন্ম হবে না বহুকাল।’

২০। মরহুম মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীও বলেছিলেন, ‘টুঙ্গিপাড়ার শেখ মুজিবের কবর একদিন সমাধিস্থলে রূপান্তরিত হবে এবং বাঙালির তীর্থস্থানের মতো রূপলাভ করবে’।

২২। বঙ্গবন্ধুর নিহত হবার সংবাদ শুনে মিশরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত এতটাই দুঃখ পেয়েছিলেন যে,তিনি আক্ষেপ করে বলেছিলেন ‘তোমরা আমার ই দেয়া ট্যাংক দিয়ে আমার বন্ধু মুজিব কে হত্যা করেছ! আমি নিজেই নিজেকে অভিশাপ দিচ্ছি’।

টুঙ্গিপাড়ার সেই খোকা নিজের রাজনৈতিক দুরদর্শিতা, দেশপ্রেম, আত্মত্যাগের জন্য খোকা থেকে রাজনীতির কবিতে পরিণত হয়েছিলেন।

আমরা আসলেই হতভাগা জাতি। এত বছর পরেও এদেশ বঙ্গবন্ধুর মত নেতা আর একজনও পায়নি। আমরা তার আত্মার মাগফেরাত কামনা করি।

লেখক: কর্মকর্তা, মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটি, সিলেট।

সম্পাদক : মো. শাহ্ দিদার আলম চৌধুরী
উপ-সম্পাদক : মশিউর রহমান চৌধুরী
✉ sylhetview24@gmail.com ☎ ০১৬১৬-৪৪০ ০৯৫ (বিজ্ঞাপন), ০১৭৯১-৫৬৭ ৩৮৭ (নিউজ)
নেহার মার্কেট, লেভেল-৪, পূর্ব জিন্দাবাজার, সিলেট
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.