আজ মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ইং

এটিইও পদের চাকরি: বাস্তবতা ও প্রত্যাশা

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৯-০৮-৩১ ২২:০৫:৫৫




:: মোঃ তোফায়েল হোসেন ::

সহকারী থানা/উপজেলা শিক্ষা অফিসার। সংক্ষেপে এটিইউ বা এইউইও। আমার বক্তব্য শ্রুতিসুন্দর করার জন্য এই নিবন্ধে পদটিকে সংক্ষেপিত 'এটিইও' হিসেবে উচ্চারণ করবো। উপজেলা পর্যায়ে একসময় একটি মাত্র শিক্ষা অফিস ছিলো। শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে প্রাথমিক শিক্ষাকে আলাদা মন্ত্রণালয়ের অধীনে নেয়ার পর এবং উপজেলা পর্যায়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন 'উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিস' নির্মিত হবার পর এখন দুইটি শিক্ষা অফিস দৃশ্যমান। ব্যাপারটি বাস্তবিক কারনেই হয়েছে। তবে প্রাথমিক শিক্ষায় চাকরিজীবিদের পদমর্যাদা ও কর্মপরিবেশজনিত কিছু অসঙ্গতির উদ্ভব ঘটেছে। সেটি দীর্ঘদিন বিবেচনায় নেয়া হয়নি। সম্প্রতি কিছু ইতিবাচক উদ্যোগের কথা শোনা যাচ্ছে, সেগুলো এখনো আলোর মুখ দেখে নি। এমন একটি বাস্তবতায় এটিইও পদটি নিয়ে সামান্য কিছু কথা তুলে ধরতে চাই।

দেশে প্রায় ৬৭ হাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর কর্তৃক সরাসরি নিয়ন্ত্রিত বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৭৫ হাজার ৯৯১টি, মোট শিক্ষক ৩ লক্ষ ৬৯ হাজার ৯৭৯ জন, শিক্ষার্থী সংখ্যা ১ কোটি ৩৫ লক্ষ ৫৯ হাজার ৮৯৯। রয়েছে প্রায় সত্তর হাজার কেজি স্কুল এবং হাইস্কুল সংলগ্ন দেড় সহস্রাধিক প্রাথমিক বিদ্যালয়। পাশাপাশি প্রায় চার হাজার স্বতন্ত্র এবতেদায়ি মাদ্রাসা, সাড়ে ছয় হাজার উচ্চমাদ্রাসার সাথে যুক্ত প্রাথমিক তথা এবতেদায়ী স্তর। এগুলো শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রনাধীন, আবার অংশত প্রাথমিক শিক্ষা মন্ত্রণালয়েরও দেখভালের আওতায় রয়েছে। সরকারি বেসরকারি মিলে পাঁচ লক্ষাধিক শিক্ষক এবং দুই কোটিরও বেশি শিক্ষার্থী। এই বিভাগের মত বড় পরিবার শুধু বাংলাদেশ কেন, পৃথিবীর কোনো দেশেই নেই। বিপুলসংখ্যক শিক্ষকের সাথে সমন্বয় এবং পরিচর্যার প্রয়োজনে এটিইওগণ বিদ্যালয়ের সাথে বলা যায়, সরাসরি জড়িত। তাদের কাজের ধরনটি তদারকির মতো হলেও যুগের চাহিদার আলোকে শিক্ষকদের সাথে যথাযথ মর্যাদা বজায় রেখে কিছু সৃজনশীলতার প্রকাশও ঘটাতে হয়।

মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়নে পদটি যেমন গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, তেমনি এটি অস্বাভাবিক ঝুঁকিপূর্ণ। এসডিজি বাস্তবায়ন এবং জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণকল্পে আজকের শিশুদের আগামী দিনের যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি নিয়ে শিক্ষকদের সাথে পরিচর্যাকারী হিসেবে মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করছে এটিইও। শিক্ষকদের সুবিধা-অসুবিধা বিবেচনায় নিয়ে শিক্ষার্থীদের বিকশিত করার প্রয়োজনে শিক্ষকদের সর্বোচ্চ দক্ষতা বের করে আনতে এটিইওর ভূমিকা সর্বাধিক কার্যকর। শিক্ষকদের বন্ধু হয়ে, আপনজন হয়ে, সামাজিক দায়বদ্ধতার বোধে তাদের উদ্বুদ্ধ করে সরাসরি শিশুদের কল্যাণার্থে ব্যাপক ভূমিকা রেখে চলছে এটিইও পদটি।

পাশাপাশি মাঠ পর্যায়ে এই চাকরিতে কিছু মারাত্মক ঝুঁকি চিহ্নিত করা গেছে। আমি নিজের অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, কতিপয় দালাল উপজেলা শিক্ষা অফিসে আধিপত্য বজায় রাখতে গিয়ে সরাসরি এটিইওদের সাথে সংঘাতে লিপ্ত হয়। এই বাস্তবতা বাংলাদেশের সর্বত্র। সামান্য নিয়মের কথা, সামান্য পদক্ষেপ, এমনকি মহৎ কোনো উদ্যোগ নিতে গেলেও এটিইওর স্বাধীনতা মারাত্মকভাবে বিপন্ন হয়। ফাঁকিবাজদের সামান্য তিরষ্কার করলেও এটিইওর উপর ভয়ংকর বিপদ নেমে আসে। হাইব্রিড নেতাদের যোগসাজসে দালাল ও ফাঁকিবাজরা কর্তব্যপরায়ণ এটিইওর বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর অবমাননা, প্রধানমন্ত্রী এবং স্থানীয় সংসদ সদস্যকে কটুক্তি ইত্যাকার আজগুবি কিছু অভিযোগ এনে চরমভাবে লাঞ্ছিত করে। এ ধরনের হাইব্রিড নেতাদের রমরমা না থাকলে কোনো কোনো উপজেলায় এটিইওর বিরুদ্ধে মিথ্যা নারী নির্যাতনের অভিযোগ এনে চরিত্র হননের চূড়ান্ত ধৃষ্টতা প্রদর্শন করতে দেখা যায়। কখনো কখনো ধর্মীয় মূল্যবোধে আঘাত হানার বায়বীয় অভিযোগ এনেও এরকম অপদস্ত করা হয়।

দশম গ্রেডের এটিইও পদে চাকরি করতে এসে কোনো নাগরিকের পক্ষেই এত বড় বড় অভিযোগ করার মত কাণ্ড ঘটানো সম্ভব নয়, কথাও নয়। তদুপরি এভাবে অপমান-অপদস্ত করার ঘটনা নিয়মিত ঘটে চলছে। বিভিন্ন সময়ে দালালদের হাতে এটিইওদের মারধরেরও শিকার হতে দেখা যায়। ফলে এটিইওর চাকরিটি অন্য যেকোনো চাকরির তুলনায় অধিক ঝুঁকিপূর্ণ। এমন একটি পদে চাকরি করতে এসে মান-সম্মান, এমনকি জীবনও ঝুঁকিতে পড়ার মুখে একজন মেধাবী ছাত্রের দুর্দশার অন্ত থাকে না। অথচ পদোন্নতিবিহীন একই পদে যুগের পর যুগ ধরে চাকরি করতে বাধ্য হয় এটিইওরা। একসময় এই পদের সমমর্যাদায় থাকা পদের অনেক পদই ইতিমধ্যে প্রথম শ্রেণি তথা নবম গ্রেডের মর্যাদায় উন্নীত হয়েছে। থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা, মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা ইত্যাদি। কিছু কিছু পদ এটিইওর নিম্নগ্রেডে থেকেও বর্তমানে নবম গ্রেডে উন্নীত অর্থাৎ এটিইওর উপরে অবস্থান করছে! এটি প্রতিদিন এটিইওদের চোখে পড়ে এবং তা দেখে তাদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়।

চাকরিতে সমমর্যাদার যেকোনো দুইটি পদের একটির উন্নীতকরণ ঘটলে অপরটি সামাজিকভাবে মর্যাদাহানির মুখে পড়ে। পদের অবনমন না হয়েও কার্যত তার অবনমন ঘটে যায়। এই অবনমনের বাস্তবতা এবং পদোন্নতিহীনতা দুয়ের মিলনে এটিইও পদের চাকরিজীবিদের উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে কাজ করা রীতিমত চ্যালেঞ্জ। দেশপ্রেম ও সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে তবুও এটিইওরা নিয়ম মেনে কাজ করার সর্বাত্মক চেষ্টা চালায়। অথচ সেটি করতে গেলেও হজম করতে হয় নানা হয়রানি এবং অপমান-লাঞ্ছনা।

মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জ্বীবিত হয়ে সরকারি নীতির প্রতিফলন, প্রাথমিক শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন এবং এসডিজির লক্ষ্য অর্জনের পথে এটিইওর চাকরির দুর্দশা একটি বড় বাধা হিসেবেই বিবেচিত হবার কথা। দুর্নীতিমুক্ত প্রাথমিক শিক্ষা এবং সরকারি ও দাতাগোষ্ঠীর অর্থের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করে মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষার সুফল প্রতিটি শিশুর কাছে পৌছে দিতে এটিইওদের দুর্দশা লাঘব করার কোনো বিকল্প আছে বলে মনে হয় না।

উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় দেশের প্রতিটি নাগরিকের শামিল হওয়ার মাধ্যমেই দেশ এগিয়ে যাবে কাঙ্খিত লক্ষ্যে। সেটি নিশ্চিত করতে প্রাথমিক শিক্ষার মান-উন্নয়নে সর্বোচ্চ মনোযোগ দেয়া সময়ের দাবি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার 'দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স' নীতি এবং 'রূপকল্প-২০২১' বাস্তবায়ন করার ধারাবাহিকতায় স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনে বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে অপেক্ষার প্রহর গুণছে দেশপ্রেমিক নাগরিকগণ। এমন একটি সময়ে এটিইও পদের চাকরিকে ঝুঁকিমুক্ত ও অধিকতর গতিশীল করে এটিইওকে দেশপ্রেমিক নাগরিক হিসেবে পূর্ণ ভূমিকা পালন করার সুযোগ করে দেয়ার বিশেষ প্রয়োজন রয়েছে।


লেখক: সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসার

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন