Sylhet View 24 PRINT

আমা‌দের সাইফুর রহমান, আমা‌দের মহসীন আলী

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৯-০৯-০৪ ১৩:০৭:১৬

মুন‌জের আহমদ চৌধুরী :: স্বাধীনতা‌ত্তোর বাংলা‌দে‌শে দ‌ক্ষিণ সুরমা থে‌কে নির্বা‌চিত এম‌পি ও মন্ত্রী মাহবুব আলী খা‌নের আম‌লে ‌সি‌লে‌টে ব্রিজ-কালভার্ট আর রাস্তাঘাট নির্মাণ শুরু হয়। পরবর্তীকা‌লে হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী জাতীয় পা‌র্টির আম‌লে সি‌লে‌টে শাহজালাল বিশ্ব‌বিদ্যালয়, রেলও‌য়ের আধু‌নিকায়নে অনবদ্য ভু‌মিকা রা‌খেন। কিন্তু, ৯৬\'র আম‌লে সি‌লেট শহ‌রের প্র‌বেশমু‌খে আজ‌কের হুমায়ুন রশীদ চত্বর নামকর‌ণে বাঁধা দেন মরহুম মন্ত্রী আব্দুস সামাদ আজাদের সমর্থকরা। প‌রে সাইফুর রহমান অর্থমন্ত্রী থাকাকা‌লে হুমায়ুন রশীদ চত্বরের বাস্তবায়ন ও নামকরণ সম্পন্ন হয়।

স্বাধীনতাত্তোর বাংলা‌দে‌শে সি‌লেট বিভা‌গের সব‌চে‌য়ে দাপু‌টে ও উন্নয়নবান্ধব রাজনী‌তি‌বিদ ছি‌লেন এম. সাইফুর রহমান। পাচঁ সে‌প্টেম্বর তাঁর মৃত্যুবার্ষিকী। ওয়ান ই‌লে‌ভে‌নের আ‌গে প‌রে তাঁর সম্প‌র্কে বাংলা‌দে‌শের সংবাদপ‌ত্রে যত সংবাদ প্রকা‌শিত হ‌য়ে‌ছে, তার নব্বই শতাংশই আমার হাতে ব্রেক করার সু‌যোগ পে‌য়ে‌ছিলাম, ব‌লে নি‌জে‌কে ভাগ্যবান ম‌নে ক‌রি।

জীব‌নের শেষ দিনগু‌লি তাঁর কে‌টে‌ছে নিদারুন একা‌কি‌ত্বে। সন্তানরা ওয়ান ই‌লে‌ভে‌নের দিনগু‌লি‌তে কেউ জে‌লে, ‌কেউ মামলায় জেরবার। শুধু কায়সার রহমান টি‌টো ছাড়া। বড় ছে‌লে না‌সের রহমান জে‌লে। তার বিরু‌দ্ধে তখন একের পর এক মামলা। তা‌কে কারামুক্ত কর‌তে একজন গৃহবধু স্ত্রী কতটা কষ্ট শ্রম আর আন্ত‌রিকতা নি‌য়ে যুদ্ধটা সেই দুঃসম‌য়ে কর‌তে পা‌রেন, তার কিছুটা আ‌মার দেখা হয় না‌সের রহমা‌নের স্ত্রী রে‌জিনা রহমান‌কে দে‌খে। ‌সেময় সংবাদের প্র‌য়োজ‌নে আপার সা‌থে প্রায়ই ফো‌নে কথা হত।

ওয়ান ই‌লে‌ভে‌নের দিনগু‌লি‌তে যারা জে‌লে ছি‌লেন, তাদের বাই‌রে থাকা স্বজনরাই কেবল ম‌নে কর‌তে পা‌রেন, মু‌র্তিমান আতংক রূপী মানুষগু‌লি দেখ‌তে ঠিক কি রকমের। কারান্তরীন নেতা‌দের কারাগা‌রের বাই‌রে থাকা স্বজন‌দের আইন শৃংখলা বাহিনীর কিছু অসৎ সদ‌স্যের মত নামধারী কিছু সাংবাদি‌কদের হা‌তেও চরমভা‌বে লাঞ্চিত, ‌নির্যা‌তিত হ‌তে হয়। আপাও আমা‌কে তা‌দের দ‌লের লোক ভেবে প্রায় দশ বছর আ‌গে এক‌দিন আমায় কল ক‌রে আচমকাই ফো‌নের ব্যা‌লেন্স চেক কর‌তে ব‌লেন। ‌চেক ক‌রে দেখি এবং বিব্রত হই এবং বিব্রত ক‌রেই ফেরত পাঠাই। স্মৃ‌তির মানুষদের অ‌নে‌কেই বে‌চেঁ আজ দু‌নিয়ায় নেই। মা‌নি চাচা নেই।

ওয়ান ইলি‌ভে‌নের দিনগু‌লি‌তে, অর্থাৎ সে দিনগু‌লি‌তে তার সা‌থে সাইফুর রহমান স্যা‌রের খবর জানবার সু‌ত্রে আ‌রো দুজন মানু‌ষের সা‌থে আমার নিয়‌মিত যোগা‌যোগ হত। একজন সাইফুর রহমা‌নের ছোটভাই মরহুম র‌ফিকুল ইসলাম মা‌নি মিয়া, ও স্যা‌রের এ‌পিএস শামসু ভাই। ওয়ান ই‌লে‌ভে‌নের সম‌য়ে স্যার‌কে ছে‌ড়ে গে‌লে, ‌জে‌লে বা পলাতক থাক‌লেও তিতু‌মীর ক‌লে‌জের সা‌বেক এই এজিএস ও ছাত্রদল নেতা স্যারকে এক মুহু‌র্তের জন্যও ছে‌ড়ে যান নি।
খব‌রের খো‌ঁজে অনুস‌ন্ধিৎসু এই ছোট্ট জীবন আমা‌কে আমার জনপ‌দের অ‌নেক ঘটনার স্বাক্ষী হবার সু‌যোগ ক‌রে দি‌য়ে‌ছিল।

‌বিএন‌পি প্র‌তিষ্টার পর থে‌কে জীবিত থাকাকা‌লে সাইফুর রহমান ছি‌লেন অন্তত মৌলভীবাজা‌রের বিএনপি রাজনী‌তির শেষ কথা। সাইফুর রহমা‌নের ই‌চ্ছে বা পছ‌ন্দের বাই‌রে গি‌য়ে সেখা‌নে কেউ রাজনী‌তি‌তে টিক‌তে পা‌রেন নি। বাস্তবতা ছিল এমনই। ক‌ঠিন স‌ত্যিগু‌লি তি‌নি অবলীলায় বল‌তেন।

২০০১ সা‌লে বিএন‌পি ক্ষমতায় এলে সাইফুর রহমা‌নের জানার বাই‌রে ‌গি‌য়ে মন্ত্রীসভায় প্র‌তিমন্ত্রী হি‌সে‌বে শপথ নেবার চি‌ঠি পান চারবা‌রের এম‌পি এবাদুর রহমান চৌধুরী। কিন্তু, ‌কিছু‌দিন পরই মন্ত্রীত্ব হারা‌তে হয় সি‌লেট বিভা‌গের এখনকার জী‌বিত পার্লা‌মেন্টারীয়ান ও সা‌বেক মন্ত্রী‌দের ম‌ধ্যে সব‌চে‌য়ে বর্ষীয়ান এ রাজনী‌তি‌বিদ‌কে। দ‌ক্ষিন সি‌লে‌টের বিনয়ী ও ক্যা‌রিশম্যা‌টিক এ সর্বজন শ্র‌দ্বেয় এ রাজনী‌তি‌বি‌দের যেহেতু আ‌মি প‌রিবা‌রের সদস্য ও এম সাইফুর রহমা‌নের মৃত্যুবা‌র্ষিকী‌র সম‌য়ে লেখা‌টি প্রকা‌শিত হ‌বে, তাই সে বিষয়‌টি আজ উহ্য থাকাই‌ সমী‌চিন বোধ ক‌রি।

দীর্ঘ ক‌য়েক যুগ মৌলভীবাজার তথা সি‌লেট বিভা‌গে বিএন‌পির রাজনী‌তি ও ক্ষমতার একক অ‌ধিপ‌তি ছি‌লেন ‌জনাব সাইফুর রহমান। স্বয়ং খা‌লেদা জিয়া তা‌কেঁ সন্মান ও বিশ্বাস দু‌টোই কর‌তেন। সাইফুর রহমান তার প্রধানমন্ত্রীর কাছ থে‌কে সমীহ পে‌তেন। সমীহ ভালবাসা পাবার ম‌তো গুন তাঁর ছিল। তিনিই একমাত্র বাংলাদেশী যিনি বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের বোর্ড অব গভর্নরসের চেয়ারম্যান হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন।

ভাষা আ‌ন্দোলন ক‌রে‌ছেন, ‌মেধাবী ছাত্র ছি‌লেন। তাঁর সম‌য়ে তি‌নি ছি‌লেন দেশ‌সেরা চাটার্ড একাউ‌টেন্ট, অর্থনী‌তি‌বিদ। সি‌লেট মৌলভীবাজার, হ‌বিগঞ্জ সুনামগ‌ঞ্জে উন্নয়‌নের রাজনী‌তি‌তে সাইফুর রহমান‌কে অগ্রনায়ক না বল‌লে ই‌তিহাস‌কে অস্বীকার করা হয়। তাঁর ক্ষমতা ছিল কাউ‌কে মন্ত্রীসভায় রাখবার, বাদ দেবার, অন্তত সি‌লে‌টের ক্ষে‌ত্রে। তি‌নি এলাকায় থাক‌লে সার্কিট হাউ‌জের দ‌রোজায় দা‌ড়ি‌য়ে থাকতেন জেলা প্রশাসকরা, তার প্র‌টোক‌লের গা‌ড়িতে থাক‌তেন পু‌লিশ সুপার। তার একবা‌রের মু‌খের কথায় ছাত্রদ‌লের শি‌ক্ষিত নেতাকর্মীরা ব্যাংকগু‌লি চাকু‌রি পে‌তেন। সরকারী চাকুরী‌তে নি‌য়োগ নেবার জন্য তি‌নি ছাত্রদ‌লের চেনা নেতা‌দের তাড়া দি‌তেন। যা‌দের ভালবাস‌তেন, পছন্দ কর‌তেন তা‌দের তি‌নি দুহাত ভ‌রে দি‌তেন।
এই সাইফুর রহমা‌নের একটু স্নেহভাজন বা প‌রি‌চিত হবার সু‌যোগেও অ‌নে‌কে বৃহত্তর সি‌লে‌টে শুন্য থে‌কে কো‌টিপ‌তি হ‌য়ে‌ছিলেন।

‌কিন্তু, রাজনী‌তি বড় নির্মম। প‌রি‌স্থি‌তির বাস্তবতায় ওয়ান ই‌লে‌ভে‌নে সাইফুর রহমা‌ন‌কে বিএন‌পির সংস্কারপন্থী অং‌শের দায়িত্ব নি‌তে বাধ্য ক‌রে সে সময়কার সরকার।

সংস্কারপন্থী হবার অপরা‌ধে নিজ শহর মৌলভীবাজা‌রে এলেও সে দিনগু‌লি‌তে সাইফুর রহমা‌নের বাড়ী বা বাগানবাড়ী‌তে যাওয়া দু‌রে থাক, তাঁর, ছায়াও মাড়া‌তেন না অনেকে।

স্ত্রী বিগত হবার পর নি‌জের প্রো‌ষ্টেট ক্যান্সার আর বয়সজ‌নিত অসুস্থতার পাশাপা‌শি রাজনী‌তির একা‌কিত্ব তা‌কে সে দিনগু‌লি‌তে বড্ড ভোগা‌চ্ছিল। ‌যে সাইফুর রহমান‌কে একবার বাড়ী‌তে নিমন্ত্রন ক‌রে খাওয়া‌তে ভিআই‌পিরা একসময় অ‌পেক্ষায় থাক‌তেন, তারাই সম‌য়ের ফে‌রে তা‌কে এ‌ড়ি‌য়ে চলা শুরু ক‌রেন।

‌কিন্তু, একজন সংবাদকর্মী হি‌সে‌বে, মৌলভীবাজা‌রের মানুষ হি‌সে‌বে স্বীকার করতেই হ‌বে, রাজনী‌তির মা‌নে য‌দি উন্নয়ন হয়, অর্থ ও প‌রিকল্পনা মন্ত্রী এম সাইফুর রহমান ছি‌লেন সে উন্নয়‌নের রাজনী‌তির এক ন‌ন্দিত নায়ক। সাইফুর রহমানের আম‌লে জাতীয় বা‌জেট হ‌তো ৩০ হাজার কোটি টাকার। অথচ জাতীয় এখন ৫ লাখ কোটি টাকার বাজেট হয়। তবু আজ সি‌লে‌টের মানু‌ষের অভি‌যোগ কাং‌খিত উন্নয়ন না হবার। উন্নয়ন বঞ্চনার।
 
দুই.
সৈয়দ মহসীন আলী সাইফুর রহমা‌নের ম‌তো দীর্ঘসময় থাকা দাপু‌টে কোন মন্ত্রী ছি‌লেন না। তি‌নি পুর্ন মন্ত্রী হ‌লেও এলাকায় দ‌লের রাজনীতির নিয়ন্ত্রন নি‌তে পা‌রেন নি। সমা‌লোচকরা ব‌লেন, এর কারন তাঁর সরলতা। তি‌নি ছি‌লেন যতখা‌নি একজন টি‌পিক্যাল রাজনী‌তি‌বিদ, তার চে‌য়েও বে‌শি একজন জননেতা। কে কোন দল ক‌রেন, তার কা‌ছে গে‌লে সেটা তি‌নি দেখ‌তেন না। ভি‌খি‌রি‌দেরও তাঁর ৩৬, শ্রীমঙ্গল রো‌ডের বাড়ীর অন্দ‌রে ভাত খে‌তে যাবার প্র‌বেশাধিকার ছিল। রাজনী‌তির জন্য পৈ‌ত্রিক সম্পদ বি‌ক্রি ক‌রে গে‌ছেন লোকটা আজীবন। তিনবার বাইপাস সার্জারী আর দি‌নে তিনবার ইনসু‌লিন নি‌য়েও লোকটা ছুট‌তেন, গ্রাম থে‌কে গ্রা‌মে, মানু‌ষের কা‌ছে। মানুষই ছিল তার সাধনা। যে মহসীন আলী প্র‌তি পু‌জোমন্ড‌পে গি‌য়ে প্রসাদ দি‌লে না কর‌তেন না, পা‌ছে মানুষ য‌দি কষ্ট পায়!

অথচ সেই মহসীন আলী‌কে প্র‌তি বৃহস্প‌তিবার রা‌তে হজরত সৈয়দ শাহ মোস্তফা (রহ) মাজা‌রের এক‌কো‌নে চুপচাপ প্রার্থনায় মগ্ন থাক‌তে দে‌খে‌ছে তার শহ‌রের মানুষ। এরশাদ ক্ষমতায় থাক‌তে ৮৮ বন্যার সময় মহসীন আলী‌কে আমন্ত্রন জা‌নি‌য়ে‌ছি‌লেন জাতীয় পা‌র্টি‌তে যাবার। কিন্তু, মহসীন আলী কখ‌নো দল বদলান‌নি, ‌নেতা বদলান‌নি। ওয়ান ই‌লে‌ভে‌নের কঠিন সম‌য়ে তি‌নি প্রশাস‌নের নি‌ষেধ উ‌পেক্ষা ক‌রেই নিজ বাড়ী‌তে অন্যান্য বা‌রের ম‌তো ১৫ আগষ্ট বড়ো আ‌য়োজ‌নে পালন ক‌রেন। অতটা দুঃসাহস তার ছিল।

চ‌লিত রাজনী‌তির নষ্ট স্রো‌তের নী‌তিহীনতার বাই‌রের একজন জন‌নেতার নাম সৈয়দ মহসীন আলী। যি‌নি তাঁর জীব‌নে কখ‌নো স‌চেতনভা‌বেই ধূর্ত রাজনী‌তি‌বিদ হ‌তে চান‌নি, ‌চে‌য়ে‌ছেন আজীবন মানু‌ষের ভালবাসা। অর্থ-‌বিত্ত, সম্পদ কোন‌কিছু চায়‌নি লোকটা। প‌রিবা‌রে স্ত্রী কন্যা‌দের সময় দেননি কোন‌দিন।

ব্যাক্তিগতভা‌বে সৎ ছি‌লেন ব‌লেই ২০০১ সা‌লের নির্বাচ‌নের পর আওয়ামীলী‌গের প্রথম ব‌র্ধিত সভায় শেখ হা‌সিনার কাছে দা‌ড়ি‌য়ে মাইক হা‌তে নি‌য়ে তি‌নি বল‌তে পে‌রে‌ছি‌লেন, \'‌নেত্রী দল ক্ষমতায় থাক‌তে আ‌মি সৈয়দ মহসীন আলীর ম‌তো মা‌ঠের নেতা তোফা‌য়েল, আমু ভাই‌দের সাক্ষাত পাই‌নি। চাটুকারদের জন্য আপ‌নি হে‌রে‌ছেন। নেত্রী যারা বিএনপি বা চারদল ক‌রে, তারা তো আমারই ভাই, আমার সন্তান\'।

মন্ত্রী ছি‌লেন মাত্র ক‌য়েক মাস। ‌বেফাসঁ মন্ত‌ব্যে সমা‌লো‌চিত হ‌য়ে‌ছেন। কিন্তু, তার রাজনী‌তির বয়স অ‌নেক। মু‌ক্তিযুদ্ধে সরাস‌রি অংশ নি‌য়ে‌ছি‌লেন কি‌শোর বয়‌সে। ২৭ বছর বয়‌সে হ‌য়ে‌ছি‌লেন পৌর চেয়ারম্যান। তিনবার পৌর চেয়ারম্যান ছি‌লেন। সি‌লেট বিভা‌গীয় মু‌ক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ছি‌লেন। ই‌তিহাসে নজীর‌বিহীন উন্নয়‌নের পরও সাইফুর রহমা‌নের ম‌তো হে‌ভিও‌য়েট নেতা‌কে নিজ আস‌নে পরা‌জিত করতে পে‌রে‌ছি‌লেন মহসীন আলী। তারপরও এলাকায় নিজ দ‌লের নেতা‌দের কৌশ‌লের কা‌ছে ছি‌লেন চরম কোনঠাসা। একটা সময় গে‌ছে সদর থানার ও‌সিও তার কথা শো‌নে‌নি। অথচ তার দল ক্ষমতায়, ‌তি‌নি এম‌পি। তারও আ‌হে নিজের কা‌ছের মানুষ‌দের নেপ‌থ্যের খেলায় দ‌লের জেলা সভাপ‌তির ভো‌টে হে‌রে‌ছেন, ‌চেম্বা‌র অব কমা‌র্সে তার প্যা‌নেল হে‌রে‌ছে, দ‌লে বি‌দ্রোহী প্রার্থী দি‌য়ে তা‌কে হারা‌নো হ‌য়ে‌ছে পৌরসভায়। তবু তি‌নি মানুষের রাজনীতিই ক‌রে‌ছেন।

তবু মানু্ষ তার কা‌ছে যেত, রোজ সকাল বি‌কেল তার বাড়ীতে সমস্যা পী‌ড়িত মানু‌ষের ভীড় থাকত, তি‌নি কাউ‌কে ফেরা‌তেন না। খুব সাধা‌রন মানুষকে অসাধারন আর অকৃ‌ত্রিমভা‌বে ভালবাসবার ম‌তো একটা হৃদয় তার ছিল। ক‌য়েক হাজার গান, ক‌বিতা মানুষটার মুখস্ত থাকত। তার কা‌ছে হিন্দু, মুসলিম বা দল লী‌গের বিভাজন ছিল না। আপাদমস্তক ছি‌লেন একজন সংস্কৃ‌তিবান মানুষ। তাঁর নেত্রী শেখ হা‌সিনা তা‌কে জীব‌নের শেষ বেলায় যতটা মুল্যায়ন ক‌রে‌ছি‌লেন, ততটা মুল্যায়ন গত তিন আম‌লে অন্তত সি‌লেট বিভা‌গে কোন আওয়ামীলীগ নেতা পান নি।


‌তিন.
সাইফুর রহমান যখন রাজনী‌তি‌তে আ‌সেন তখনকার আওয়ামীলীগ নেতা ও সে সময়কার পৌর পিতা মহসীন আলী সোনার চা‌বি দি‌য়ে সাইফুর রহমান‌কে মৌলভীবাজা‌রে নজীর‌বিহীন বর্নাঢ্য সংবর্ধনা ‌দেন। জীবিত থাকাকা‌লে রাজ‌নৈ‌তিক বৈ‌রিতা স্ব‌ত্বেও তারা কেউ কাউ‌কে ব্যা‌ক্তিগত আক্রমন ক‌রে বক্তব্য দেন‌নি। ‌দেখা হ‌লে বোঝাই যেত না, তারা দুজন দুই দল ক‌রেন।

এমনই সুন্দর আ‌র সম্প্রী‌তির ছি‌ল আমা‌দের জনপ‌দের রাজনী‌তি‌। ২০০১ সা‌লের পর সাইফুর রহমা‌নের দোর্দন্ড ক্ষমতার আম‌লে মহসীন আলী তখন জেলা আওয়ামীলীগ সভাপ‌তি। শহ‌রের দারুল উলুম মাদ্রাসার অচলাবস্থা নি‌য়ে সাইফুর রহমান এক‌দিন ডাক‌লেন মহসীন আলী‌কে। তৎকালীন মৌলভীবাজা‌রের ডি‌সি ও এস‌পি‌কে ব‌ল‌লেন সাইফুর রহমান, \'বিষয়টা মহসীন যেভা‌বে সমাধান কর‌তে ব‌লে ঠিক সেভা‌বে কর‌বেন।\' সে দৃশ্য‌টির চাক্ষুস সাক্ষী হবার সুযোগ হ‌য়ে‌ছিল আমার।

ভাষা আ‌ন্দোল‌নে ভুমিকার জন্য সাইফুর রহমান একু‌শে পদক ও মহান স্বাধীনতা সংগ্রা‌মে অবদা‌নের জন্য সৈয়দ মহসীন আলী‌কে মর‌নোত্তর স্বাধীনতা পদ‌কে ভুুষিত ক‌রে স্ব-স্ব আম‌লের সরকার।

চার.
এম. সাইফুর রহমান বা সৈয়দ মহসীন আলী, তাদের কেউই দেবতা নন, তারাও আমা‌দের ম‌তোন মানুষ। তা‌দের কাজগু‌লি, আর আমা‌দের কা‌ছে তা‌দের কা‌জের মুল্যায়ন এ দুই নেতা‌কে জনগ‌নের ভালবাসার নায়‌কে প‌রিন‌তি দি‌য়ে‌ছে‌।

তারা চ‌লে গে‌ছেন পরপা‌রে। আমা‌দের সমা‌লোচনার জবাব দেবার ম‌তো দুর‌ত্বে আজ তারা নেই। এ দুজনের কারো সম্প‌ত্তির উত্তরাধীকার বা কা‌রো রাজ‌নৈ‌তিক উত্তরাধীকার আ‌ছেন কিনা সেটাও আমার লেখার বিষয়বস্তু নয়।
বাস্তবতা হ‌লো, আর একজন সাইফুর রহমান বা আর একজন মহসীন আলী আমা‌দের নেই। আর কোনদিন এরকম নেতা মৌ‌লভীবাজার পা‌বে, সেটা আজ‌কের নেতা‌দের কাজকর্ম আমা‌দের বিশ্বাসও কর‌বার আশ্বাসটুকু কি দেয় ?

তা‌দের না থাকবার শুন্যতা আজ যেন সভা ক‌রে আ‌ছে। তা‌দের সম‌য়ে সে সম‌য়ের সব‌চে‌য়ে পাঠক‌প্রিয় দুটাকার দৈ‌নিক আমা‌দের সম‌য়ে কাজ করার ক্ষেত্র ও তার বাই‌রে দুজ‌নের সা‌থেই সাংবা‌দিকতার এবং এর বাইরের বহু স্মৃ‌তি আছে‌। তা‌দের ঝা‌ড়ি-ভালবাসা দু‌টোর স্বাদই আমায় দি‌য়ে‌ছে সাংবা‌দিকতা।

দুজ‌নের রাজনৈ‌তিকভা‌বে প্রবল নিঃসঙ্গ সময় আর ক্ষমতার পতাকা লাগা‌নো গা‌ড়ি দু‌টোই দে‌খে‌ছি।
দুজ‌নেই গান আর সংস্কৃ‌তি‌কে ভালবাস‌তেন। সাইফুর রহমানের সেটুকু সীমাবদ্ধ ছিল একটা প‌রিসর পর্যন্ত, মহসীন আলী ভেত‌রে-বাই‌রে একজন সংস্কৃ‌তি আর সংগীত‌প্রেমী মানুষ।

‌মৌলভীবাজা‌রের ই‌তিহাস ব‌লে, যারা এ জনপ‌দে রাজনী‌তি‌তে সফল হ‌য়ে‌ছেন, তা‌দের সবার সহধর্মী‌নির সে সফলতার পেছ‌নে অন্তত অ‌র্ধেক ভু‌মিকা আ‌ছে‌। ‌যেমন সাইফুর রহমান, ‌তে‌মনি মহসীন আলী। সৈয়দা সায়রা মহসী‌ন এম‌পি হ‌য়ে‌ছি‌লেন। একজন মহসীন আলীকে বি‌নির্মা‌নে তার ভু‌মিকা অস্বীকার করলে স‌ত্যকে হ‌লে অস্বীকার করা হয়।

তেম‌নি আজ থে‌কে ৮৭ বছর আ‌গে মৌ‌লভীবাজা‌রের বাহারমর্দন গ্রা‌মের সম্ভান্ত বস্তু মিয়ার সন্তান একজন সাইফুর রহমা‌ন বি‌নির্মা‌নের পেছ‌নে তারঁ নি‌জের মেধা যোগ্যতার যতটা অবদান বিদুষী, বিচক্ষন স্ত্রী দুর‌রে সামাদ রহমা‌নের অবদানও অনেকটা।

রাজনী‌তি‌তে নে‌মে মৌলভীবাজা‌র সদ‌র-রাজনগ‌রের মত একসময় আওয়ামীলী‌গের ঘা‌টি‌তে বার বার যখন হার‌ছি‌লেন সাইফুর রহমান, তখন বেগম খা‌লেদা রব্বানীদের রাজনী‌তি‌তে আনার পেছ‌নে অনবদ্য ভু‌মিকা রা‌খেন তি‌নি। নুরজাহান সুয়ারা খালার মতোন মৌলভীবাজা‌রের বেগ‌ম দুর‌রে সামাদ রহমা‌নের কা‌ছের দুএকজন বন্ধু এখ‌নো বে‌চেঁ আ‌ছেন। স্মৃ‌তিগু‌লি তাই পুরোপু‌রি মারা যায় নি।

আ‌মি চাই মৌলভীবাজার শহ‌রের এম সাইফুর রহমান অ‌ডি‌টো‌রিয়ামের নাম বহাল থাকুক। এ‌টি সরকারী উচ্চ বিদ্যালয় অ‌ডি‌টো‌রিয়াম না‌মে নামকর‌নের যে অপপ্রয়াস চল‌ছে, তা বাস্তবায়ন হ‌লে মৌলভীবাজা‌রের মানুষ ল‌জ্জিত হ‌বে। দুবারের এমপি, সা‌বেক মন্ত্রী সৈয়দ মহসীন আলীর না‌মে কোথাও প্র‌তিষ্টান তো দু‌রের কথা কোথাও কোন সড়ক বা স্থাপনারও নাম নেই। এখন তার প‌রিবা‌রের কেউও ক্ষমতার রাজনী‌তি‌তে নেই। তার নামে শহ‌রের বে‌রিরপা‌রে বা অন্য কোথাও অন্তত এক‌টি সড়ক বা চত্ব‌রের নামকরন ক‌রে প্রয়াত এ নেতার প্র‌তি সন্মান দেখাবেন, মৌলভীবাজা‌রের ক্ষমতাশীনরা এটুকু নিশ্চয় বে‌শি চাওয়া নয়!

বহুদিন আ‌গে মারা যাওয়া মৃত মানু‌ষের নাম হাতু‌ড়ি দি‌য়ে ভে‌ঙ্গে দেবার ম‌ধ্যে বর্বরতা থা‌কে, পাশ‌বিকতা থা‌কে, উন্মত্ততা থাকে। হাতু‌ড়িওয়ালারা জানান দেয় তা‌দের আত্মপ‌রিচয়।

সাইফুর রহমান বা মহসীন আলীর ম‌ধ্যে কোন ধর‌নের তুলনার বেয়াদবী এ লেখার গন্তব্য নয় কোনভা‌বেই। বরং দল মত নি‌র্বি‌শে‌ষে তারা মৌলভীবাজারবাসীর গ‌র্বের ধন। এ দুজ‌নের জানাজায় যত মানু‌ষের উপ‌স্থি‌তি হ‌য়ে‌ছিল, কোন সরকা‌রের প্রধানমন্ত্রীর জনসভা‌তেও কখ‌নো এত মানু‌ষের ভীড় হয় নি কখ‌নো।

খুব ক‌রে সপ্ন দেখি, এক‌দিন মৌলভীবাজা‌রে এ‌ দুই নেতার মৃত্যুবার্ষিকী এক ম‌ঞ্চে পালন করবার।

সেই সম‌য়ে সাইফুর রহমা‌ন স্যা‌রের সা‌থে তার পিএস সামসু ভাই‌য়ের ফো‌নে ফোন করতাম, সংবা‌দের প‌্র‌য়োজ‌নে। আমার নাম শুন‌লে তি‌নি কথা বল‌তেন। স্বজন‌দের বাই‌রে শুধুমাত্র সাংবা‌দিক প‌রিচ‌য়ের কনিষ্টতম ব্যা‌ক্তি আ‌মি, যার সা‌থে স্যা‌রের ওয়ান ই‌লে‌ভে‌নের দিনগু‌লি‌তে কথা হত।

আর সৈয়দ মহসীন আলী জীবনের শেষ ১০ বছ‌রে তাঁর অনুজ খোকন চাচা ছাড়া সব‌চে‌য়ে বে‌শি চ‌ড়ে‌ছেন আমার বাই‌কেই। আমার কা‌ধেঁ মৃত্যু অব‌ধি তার সে আদ‌রের হাতটি ছিল। বহু স্মৃ‌তিচারণ আজ‌কের সম‌য়ে অত্যু‌ক্তি হ‌বে বোধক‌রি।

আমা‌দের শ্রেষ্ঠ সন্তান‌দের যত‌দিন ধ‌রে সন্মান জানা‌তে শিখব না দল, ম‌তের উ‌র্দ্ধে উ‌ঠে, আমাদের স্বভা‌বের ছোটলো‌কি জ‌নিত ক্ষুদ্রতায়- তত‌দিন লি‌লিপু‌টের উচ্চতার বড়‌ত্বের আধাঁ‌রের রা‌তগু‌লি ভোর হ‌বে না। আর কত ছোট হব আমরা বৃত্ত থে‌কে বৃ‌ত্তে, ‌চি‌ত্ত হ‌তে চি‌ত্তে ?

সাইফুর রহমান, মহসীন আলীরা বার বার জন্ম নেন না। যারা তাদেঁর ব্যবহার ক‌রে‌ছেন, অ‌নে‌কে আজ তা‌দেঁর স্মৃ‌তির পা‌শেও নেই। যে নষ্ট রাজনী‌তির কার‌নে আমরা একম‌ঞ্চে না হোক আলাদা ক‌রেও স্মরণ কর‌তে পা‌রি না আমা‌দের শ্রেষ্ঠ সন্তান‌দের, সেই রাজরীতি‌র নামে ভন্ডামীর প্র‌তি ঘৃনা জানাই।

পাচঁ সে‌প্টেম্বর এম সাইফুর রহমা‌নের মৃত্যুবা‌র্ষিকী। ১৪ সে‌প্টেম্বর সৈয়দ মহসীন আলীর। যত‌দিন মৌলভীবাজার থাক‌বে, কৃতজ্ঞতা নামক শব্দ‌টি থাক‌বে, তত‌দিন তারা থাক‌বেন মৌ‌লভীবাজারবাসীর শ্রদ্ধায়, ভালবাসায়।

‌লেখকঃ লন্ডনে বসবাসরত সাংবাদিক

সম্পাদক : মো. শাহ্ দিদার আলম চৌধুরী
উপ-সম্পাদক : মশিউর রহমান চৌধুরী
✉ sylhetview24@gmail.com ☎ ০১৬১৬-৪৪০ ০৯৫ (বিজ্ঞাপন), ০১৭৯১-৫৬৭ ৩৮৭ (নিউজ)
নেহার মার্কেট, লেভেল-৪, পূর্ব জিন্দাবাজার, সিলেট
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.