Sylhet View 24 PRINT

আসুন দায়িত্বশীল সাংবাদিকতাকে বাঁচিয়ে রাখি

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৯-০৯-১৯ ২২:৩২:০৭

|| মাতুব্বর তোফায়েল হোসেন ||
আমার নামে একটি মিথ্যা শ্লীলতাহানির মামলা হলে ফেসবুকে আমার আইডিতে প্রকৃত ঘটনার বিবরণ তুলে ধরে আমি একটার পর একটা বিবৃতি পোস্ট করতে থাকলে কয়েকজন সাংবাদিক আমার অফিসে এসে আমাকে হেনস্থা করার আড়ালে যেই আকুতিটুকু শুনিয়ে গেলো, সেটা আমার মর্মমূলে গভীরভাবে আঘাত করেছিলো। সাংবাদিকগুলো কেমন মায়া মায়া চোখে তাকাচ্ছিলো। তাদের দেখে করুণা হচ্ছিলো এই ভেবে যে, বেচারা! কিছু সংবাদ দিয়ে কামাইটামাই করবে, সেখানে আমি সেটা অপ্রয়োজনীয় করে দিচ্ছি!
তাদের মধ্যে দুজন সদ্য সাংবাদিকতায় স্নাতক সম্পন্ন করে এই পেশায় এসেছে। তাদের একজন তো বলেই বসলো, ভাই কিছু কিছু সময়ে চুপ থাকতে হয়। আমাকে সে চুপ থাকার পরামর্শ দিচ্ছে! চুপ থাকলে তার সংবাদের একটা মার্কেট ভ্যালু থাকে, সেখান থেকে দুটো পয়সা বেশি আসার সম্ভাবনা থাকে। আমি সেই সম্ভাবনাটা নষ্ট করে দিচ্ছি। পেটে লাথি পড়লে মানুষ তো তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠবেই। কিন্তু তাদের পেটে ভাত জুটাতে আমার মানহানি মেনে নিতে হবে কেন, এই প্রশ্নে আমি ছাড় দিতে মোটেও রাজি ছিলাম না। লক্ষ্য করুন, এখানে সন্ত্রাস এবং অসহায়ত্ব দুটোই ফুটে উঠছে। প্রভাবশালীদের ভাঙিয়ে খেতে ব্যর্থ হয়ে তারা আমার মত একজন নিরীহকে বেছে নিয়েছে। এটি তাদের চূড়ান্ত অসহায়ত্ব। আবার একটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে ব্যক্তি হিসেবে আমি আর নিরীহ নই। ফলে তারা দেয়ালে পিঠ ঠেকে ভীষণ আক্রমণাত্মক হয়ে উঠেছে। আমার প্রতি তাদের বার্তাটি হলো, শেষ পর্যন্ত চাইলাম তোকে ভাঙিয়ে খেতে, ব্যাটা সেখানেও বাগড়া দিচ্ছিস, তাহলে আমরা এখন কী করবো? আমরা কি মস্তানি-ছিনতাই করবো? ব্যাপারটি গুরুতর হৃদয়বিদারক। এমন একটি বাস্তবতায় সাংবাদিকতার মৌলিক পরিবর্তন ও তার রকমফের নিয়ে আমার সামান্য আলোকপাত--

পত্রিকা কেউ আগের মত পড়ে না। বিশেষত কাগজে লেখা পত্রিকা। বড় বড় লাইব্রেরির শত শত বই ধূলির আস্তরণে চাঁপা পড়ছে। সুন্দর বাধাই ঝকঝকে তকতকে সুগন্ধী বইয়ের ভাঁজ খুলে গভীর মনোনিবেশে পড়ার সময়ও আর আগের মত হয় না কারো। পাঠাগারে কিংবা কোনো দপ্তরে নিয়মিত সরবরাহকৃত কাগজের পত্রিকা দিনশেষে অবিকৃত পড়ে থাকে। পাবলিক লাইব্রেরিতে বিসিএস পাঠকের বাইরে সিরিয়াস পাঠকের সংখ্যা খুবই নগণ্য। যারা জ্ঞানপিপাসার টানে পড়তে যায় তাদের অভিজ্ঞতা খুব বাজে।

তাহলে দেশে কি তথ্য ও জ্ঞানচর্চার খরাকাল শুরু হলো? বাস্তবতা তা নয়। বাস্তবতা হলো, মানুষ পড়ছে, জানছে আগের চেয়ে বেশি। কোনো খবর থেকেই মানুষ এখন আর বিচ্ছিন্ন থাকে না, থাকতে চাইলেও পারে না, কোনো না কোনো উপায়ে খবর কানে এসে পৌছাবেই। কারো যদি গভীরে গিয়ে জানতে ইচ্ছে করে, বড় বড় টেক্সট সে ছোট্ট পরিসরের স্ক্রিনে পড়ে ফেলছে। পৃষ্ঠা ধরে ধরে পড়ার চেয়ে এই পড়ার গতি অনেক বেশি। ছোট্ট স্ক্রিনে অনেক লেখা পড়ে ফেলা যায় খুবই কম সময়ে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এখন সকল জ্ঞান ও তথ্যের মূল আধারে পরিণত হয়েছে। হয়াটস্ অন ইওর মাইন্ড কিংবা কোনো ওয়েবসাইটে সকল লেখাই তোলা থাকে। মনের কথা, তত্ত্বকথা, জ্ঞানের কথা, অনুসন্ধানী ব্যাপার সব থাকে সেখানে। চোখের সামনে আপনিই চলে আসে। আরো বেশি জানতে গিয়ে মানুষ গুগলের আশ্রয় নিতে পারে। সেখানে ইপ্সিত বিষয় ধরে সার্চ দিলে পছন্দ-অপছন্দের সব লেখাই চলে আসে। তৃপ্ত হবার মত অনেক লেখা খুঁজে পাওয়া যায় অতি সহজে। একটি তথ্য বা জ্ঞান পেতে আগে যেখানে বছরের পর বছর অনুসন্ধান চালাতে হতো, এখন তা এক ক্লিকেই মিলে যায়। সংবাদ বা গুরত্বপূর্ণ তথ্য পেতে এখন আর কেউ পত্রিকার মুখ চেয়ে থাকে না। অন্যভাবে বলা যায়, কাগজের পত্রিকার উপর নির্ভরশীলতা বহুলাংশে কমে গেছে। ফলস্বরূপ কাগজের পত্রিকার চাহিদা পড়ে গেছে। অনলাইনেও বিপুল পরিমান ওয়েবসাইটভিত্তিক পত্রিকা চালু হওয়ায় এককভাবে বাজার দখল করতে পারছে না কেউ। বর্তমানে ডিজিটাল-এনালগের দ্বন্দ্বমুখর সময় চলছে। নতুন পুরোনোর এই দ্বন্দ্বে কোনো ক্ষেত্রেই স্থিতাবস্থা প্রতিষ্ঠা পাবার সুযোগ ঘটছে না।

পরিবর্তিত এই বাস্তবতায় ঐতিহ্যবাহী পেশা, সাংবাদিকতার আশ্চর্য রূপান্তর ঘটে গেছে। ক্ষেত্রবিশেষ বাদ দিলে বলা যায়, গড়পরতা প্রতিটি মানুষই এখন সাংবাদিক! ব্যক্তি তার আশেপাশের ঘটনাবলির উপর সঙ্গতবাবেই চোখ রাখে। যেটিকে তার কাছে তাৎপর্যপূর্ণ মনে হয়, সেটিকে সামাজিক যোগাযোগের ইলেকট্রনিক মাধ্যমে তুলে দেয়। এভাবে তুলে দেয়ার ক্ষেত্রে তার সম্পূর্ণ স্বাধীনতা ও সক্ষমতা রয়েছে। কেননা তার একটি নিজস্ব আইডি রয়েছে এবং সেখানে মনের অভিব্যক্তি প্রকাশের সম্পূর্ণ সুযোগও রয়েছে। প্রতিটি ব্যক্তি এই স্বাধীনতা, সক্ষমতা এবং সুযোগ ধারন করে। 'সাইকেলটি আরোহী সমেত খালে গিয়া পড়িলো', 'ছাগলটি ঘাষ না খাইয়া মাটিতে গড়াগড়ি করিতেছে', 'বাসটি উল্টাইয়া পড়িয়া খাদে গিয়া ঠাঁই লইলো এবং পাঁচজন নিহত ও দশজন আহত' ইত্যাকার নৈমিত্তিক অভিজ্ঞতা মোবাইল ফটোগ্রাফিসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উপস্থাপিত হয়। ' 'চাচা তার ভাতিজিকে লইয়া পালাইয়াছে', 'প্রেমিক তাহার প্রেমিকাকে ধর্ষণ করিলো' ইত্যাকার খবর চটকদারিত্ব দেখানোর মোহ থেকে মানুষ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উপস্থাপন করে। প্রতিটি ব্যক্তির এই অনুভূতি-অভিব্যক্তি প্রকাশের মাধ্যমেই সমাজের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত প্রতিটি জায়গার খবর-তথ্য-ঘটনা পৌছে যায়। জাতীয়ভাবে কোনো কোনো তথ্য খুব আলোড়নধর্মী হলে পত্রপত্রিকার আগ্রহের বিষয়ে পরিণত হয় এবং সেটি জাতীয়, এমনকি কখনো কখনো আন্তর্জাতিক বিষয়ে পরিণত হয়। যুগের সেরা অনুভবটি হলো, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমই সকল সংবাদের উৎস।

পৃথিবীটা যেহেতু মানুষের নিয়ন্ত্রণে এবং মানুষেরই প্রয়োজনে, তাই মানুষ ছাড়া কোনো সংবাদ নেই। আর প্রতিটি মানুষের হাতে একটি রিসিভার ও একইসাথে একটি সার্কুলেটর রয়েছে। মানুষই সংবাদ প্রচার করে, মানুষই সংবাদ শোনে-দেখে-জানে। তথ্যের মত জ্ঞানও প্রচারিত হবার জন্য এখন এই প্রক্রিয়া নির্ধারিত হয়েছে। ফলে বিট কয়েনের বাইরে আয় করার সুযোগ সাংবাদিকতার জগতে ক্রমেই উধাও হয়ে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে ওয়েবসাইট ভিত্তিক সংবাদপত্রের ভূমিকা প্রধান হয়ে দেখা দিচ্ছে। কাগজের সংবাদে কোনো নতুনত্ব থাকে না। কারন ঘটনার মুহূর্তমাত্র পরেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার হয়ে যাচ্ছে। প্রেস থেকে কাগজ এসে চোখের সামনে সংবাদ মেলে ধরতেই মানুষ খেয়াল করে, আরে এটা তো সে আগেই জেনেছে!

শর্টহ্যান্ড রাইটের সাংবাদিকতা টেপরেকর্ডার, ভিডিও পার হয়ে এখন এই রূপে হাজির হয়েছে। সাংবাদিক হিসেবে তৃতীয়পক্ষের কোনো প্রয়োজনই নেই। ইন্টারনেটের মাধ্যমে প্রতিটি মানুষই প্রতিটি মানুষের কাছে দৃশ্যত সাংবাদিক। তাহলে প্রশ্ন হলো, সাংবাদিকতার মত একটি ঐতিহ্যবাহী পেশা কি নির্মূল হতে চলেছে? আমরা এখনই সেটা বলতে পারি না। তবে সাংবাদিকতার মৌলিক রূপান্তর যে ঘটেছে সেটা খুব জোর দিয়ে বলা যায়। আর সেই মৌলিক রূপান্তরটি কী, সেটি বুঝতেই আমরা সাংবাদিকতা পেশার উদ্ভব ও বিকাশের ধারাটি ঘেটে দেখতে পারি।

আদিকালে মানুষ যখন দলবদ্ধভাবে বিচরণ করতো, তখন তাদের পারস্পরিক যোগাযোগের মাধ্যম ছিলো ভাষা ও সংকেত। গলা কিংবা শিঙ্গা দিয়ে দূরের কারো কাছে ভাষা ও সংকেতের মাধ্যমে সংবাদ পৌছে দেয়া হতো। জোরে জোরে হাঁক ছিলো তাদের নিত্যনৈমিত্তিক কর্মকান্ড। শোরাশুরি ও চিৎকারও ছিলো নিত্যদিনকার ব্যাপার। শুধু ঝগড়া করতে নয়, বনে-মাঠে স্বাভারিক স্বরের বাইরে থাকা মানুষকে চিৎকার করেই বার্তা পৌছুতে হতো। এটাই আদিকালের সাংবাদিকতা। অতপর গোত্র গোত্র পাশাপাশি বসবাসের সংস্কৃতি শুরু হলে সমাজের আয়তনিক বিস্তৃতি ঘটে। এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়ি, এক পাড়া থেকে আরেক পাড়া, এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে বার্তা আদান-প্রদানের প্রয়োজন দেখা দিলো। তখন আর শোরগোলেও কাজ হয় না। খাদ্য সংগ্রহ ও বাণিজ্যের প্রয়োজনে মানুষ যখন আপনজন থেকে বহু দূরে দূরে দীর্ঘদিনের জন্য থাকতে বাধ্য হবার সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত হলো, তখন শোরগোলের বাইরে ভিন্ন পদ্ধতির আশ্রয় নিতে হলো। সেটা চিঠি বা দূতের মাধ্যমে চলতে শুরু করলো। চিঠি পৌছুতে ডাকের উদ্ভব ঘটলো। এরই সূত্র ধরে এক অঞ্চলের খবর অন্য অঞ্চলে পৌছুতে শুরু করলো। এখান থেকেই সাংবাদিকতার ধারনাটি প্রথম আসে।

সাংবাদিকতার আনুষ্ঠানিক উদ্ভবের ইতিহাস সম্পর্কে জানা যায়ঃ
"ইয়োহান কারোলাসের ১৬০৫ সালে স্ট্রাসবুর্গ থেকে প্রকাশিত রিলেশন অলার ফুর্নেমেন উন্ড গেডেনকভুর্ডিগেন হিস্টরিয়েনকে প্রথম সংবাদপত্র বলে অভিহিত করা হয়। প্রথম সফল ইংরেজি দৈনিক হল ১৭০২ থেকে ১৭৩৫ সালে প্রকাশিত ডেইলি ক্যুরান্ট। ১৯৫০ এর দশকে দিয়ারিও কারিওকা সংবাদপত্রের সংস্কার রূপকে ব্রাজিলে আধুনিক সাংবাদিকতার জন্ম বলে চিহ্নিত করা হয়।

১৯২০ এর দশকে যখন আধুনিক সাংবাদিকতা রূপ ধারণ করতে শুরু করে লেখক ওয়াল্টার লিপম্যান এবং মার্কিন দার্শনিক জন ডিউয়ি গণতন্ত্রে সাংবাদিকতার ভূমিকা নিয়ে বিভিন্ন যুক্তি-তর্ক উপস্থাপন করেন। তাদের এই ভিন্ন ভিন্ন দর্শন এখনো সমাজ ও রাষ্ট্রে সাংবাদিকতার ভূমিকা বিষয়ে যুক্তি প্রদর্শনে ব্যবহৃত হয়।"

শেখ আবদুস সালাম কর্তৃক বিবৃত বাংলাপিডিয়ার উল্লেখযোগ্য বক্তব্যটি এমনঃ

"আধুনিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে সাংবাদিকতার উৎপত্তি অষ্টাদশ শতাব্দীর ইউরোপে। উপনিবেশ হওয়ার কারণে এশিয়ার অন্য যে কোন দেশের আগেই বাংলা অঞ্চলে সাংবাদিকতা শুরু হয়। ১৭৮০ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে কলকাতা থেকে প্রকাশিত জেমস অগাস্টাস হিকি'র বেঙ্গল গেজেট প্রকাশনার মাধ্যমে বাংলায় আধুনিক সাংবাদিকতার ইতিহাস শুরু হয়। পত্রিকার বিজ্ঞাপনে উলে­খ করা হয়েছিল, সকল পক্ষের জন্য উন্মুক্ত হলেও এটি কারও দ্বারা প্রভাবিত নয় এমন একটি সাপ্তাহিক, রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক পত্রিকা। ১৮১৮ সালে বাংলা সাংবাদিকতা আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে। সে বছর বাঙ্গাল গেজেট, দিগদর্শন এবং সমাচার দর্পণ নামে তিনটি সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়েছিল। প্রথম বাংলা সংবাদপত্র সমাচার দর্পণ শ্রীরামপুর থেকে ১৮১৮ সালে প্রকাশিত হয়। বাংলাদেশের বর্তমান ভূখন্ড থেকে প্রথম প্রকাশিত সাপ্তাহিক 'রংপুর বার্তাবহ' প্রকাশিত হয় রংপুর থেকে ১৮৪৭ সালে এবং ঢাকা থেকে প্রথম প্রকাশিত সাপ্তাহিক ঢাকা নিউজ প্রকাশিত হয় ১৮৫৬ সালে। ঢাকা প্রকাশ ১৮৬১ সালে এবং ঢাকা দর্পণ ১৮৬৩ সালে ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয়েছিল।

বিশ শতকের শুরুতে সাংবাদিকতা পেশা এক নতুন মোড় নেয়। জাতীয়বাদী আন্দোলন, মুসলিম জাতীয়তাবাদের উত্থান, প্রথম ও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ এবং প্রতিনিধিত্বমূলক সরকারের সূচনা প্রভৃতি কারণে সংবাদপত্রসমূহের চাহিদা ও পাঠকসংখ্যা দ্রুত বিস্তার লাভ করে। ১৯৪৭ সালে দেশভাগ এবং পূর্ববাংলার রাজধানী হিসেবে ঢাকার উত্থান সাংবাদিকতার বিস্তারের ক্ষেত্রে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে ভূমিকা পালন করে।

এদেশে পত্রপত্রিকার প্রকাশ এবং তা অব্যাহত রাখা কখনই মসৃণ ছিল না। ১৭৮০ সালে হিকি'র বাঙ্গাল গেজেট থেকে শুরু করে অদ্যাবধি এদেশের পত্রিকাগুলির আইনি প্রক্রিয়ায় ডাক সুবিধা বন্ধ হয়ে যাওয়া; সম্পাদক, মালিক ও সাংবাদিকের কারাবরণ; অর্থদন্ড ও জরিমানা, প্রেস বাজেয়াপ্ত হওয়া, নির্যাতন-হত্যার মুখোমুখি দাঁড়ানো ও শিকার হওয়া; পত্রিকা বন্ধ হয়ে যাওয়া এমনতর বহু ধরণের অস্বাভাবিক পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়েছে এদেশের পত্রিকা প্রকাশনাকে।

১৯৯০ সালে বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদ কর্তৃক নিবর্তনমূলক কয়েকটি আইনের রদ এবং ২০০৯ সালে আওয়ামীলীগ সরকার আমলে রাইট টু ইনফরমেশন অ্যাক্ট এর প্রবর্তন এদেশের সাংবাদিকতাকে ইতিবাচকভাবে এগিয়ে যেতে সাহায্য করছে।

সাংবাদিকতার প্রশিক্ষণ যুক্তরাষ্ট্রে শুরু হলেও তা বর্তমানে বাংলাদেশেও প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রম হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে। বাংলাদেশের ৩টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সহ ৬/৭টি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা বিভাগ রয়েছে। এ ছাড়াও দেশের বিভিন্ন ইনস্টিটিউট ও সেন্টারে সাংবাদিকতা শিক্ষা/প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। সাংবাদিকতা প্রশিক্ষণের জাতীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে ১৯৭৬ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে  বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট (পিআইবি) দীর্ঘকাল ধরে প্রশিক্ষণের কাজটি চালিয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়াও ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ম্যাস কমুনিকেশন (NIMCO) এবং স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান হিসেবে BCJDC, MMC সাংবাদিকদের প্রশিক্ষণ প্রদান করে চলেছে।

কায়েমী স্বার্থের দ্বারা সাংবাদিকের প্রতি হামলা, খারাপ আচরণ, পঙ্গু করে দেয়া, এমনকি হত্যাকান্ডের ঘটনা পর্যন্ত ঘটে থাকে। বাংলাদেশের সাংবাদিকতা বলা যায়, এখনও খানিকটা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে পথ চললেও ক্রমশ তা পেশাদারিত্ব নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।"

সাংবাদিকতা সরাসরি শিল্পকলা কিনা এমন প্রশ্নে মিশ্র প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হলেও সাংবাদিকতা ব্যাপকভাবে শিল্পকলা দ্বারা প্রভাবিত। ইউরোপীয় রেনেসাঁ থেকে উদ্ভূত এই মাধ্যমটি শিল্পচর্চার গুরত্বপূর্ণ এক মাধ্যম হয়ে ওঠে। সাহিত্য ও চিত্রকলার অন্যতম চর্চাক্ষেত্র সংবাদ মাধ্যম বাণিজ্যিকভাবে প্রাতিষ্ঠানিকতা পায়। হয়তো একারনেই সাংবাদিকতাকে নিরেট শিল্পকলা বলা যায় না। তবে শিল্পকলার প্রতিটি শাখাকে কেন্দ্র করেই বাণিজ্যিকরণ ঘটেছে। হয়তো সাংবাদিকতায় এর দৃশ্যমানতা তুলনামূলক বেশি। ব্যবসা-বাণিজ্য দ্বারা পরিচালিত সমাজে এটি অবধারিত। সংবাদ উপস্থাপন, ভাষা প্রয়োগের ঢঙ ও আঙ্গিক ইত্যাদি প্রতিটি ক্ষেত্রেই শৈল্পিকতার ছাপ থাকে। তাই সৃজনশীলতা মূলে সাংবাদিকতা একটি শিল্পকলা সন্দেহ নেই। ঐতিহাসিকভাবে বিবর্তিত সাংবাদিকতা পেশার বর্তমান সংকটটি এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। ইন্টারনেট, ডিজিটাল যুগের আলোকে নতুনভাবে নির্ধারিত হচ্ছে সাংবাদিকতার রূপ।

ইলেকট্রনিক মিডিয়া এখনো যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারলেও প্রিন্ট মিডিয়ার ভবিষ্যত খুবই হতাশাজনক। তবে হাতে হাতে উচ্চপিক্সেলের মোবাইল ক্যামেরার ছড়াছড়ি ইলেকট্রনিক মিডিয়ারও রূপান্তর ঘটিয়ে চলছে। সাংবাদিকতা ছেড়ে সরকারি-বেসরকারি চাকরির দিকে ঝুঁকছে মেধাবীরা। ফলে পেশাদার সাংবাদিকতায় মেধার সংকট দেখা দিচ্ছে। প্রায়শই শুনতে পাওয়া যায়, সংবাদপত্রগুলো সাংবাদিকদের বেতন দিতে হিমশিম খায় এবং নতুন রিক্রুটকৃত সাংবাদিকদের বেতন খুবই কম ধরা হয়। এটি সাংবাদিকতার জগতে অশণিসংকেত। বুদ্ধিবৃত্তিক মানুষের স্বাধীন পেশা হিসেবে স্বীকৃত এই ক্ষেত্রটি নতুনদের জন্য হতাশাব্যঞ্জক। সমাজে সৃজনশীল মানুষগুলোর স্বাধীন সত্তা বজায় রেখে বেঁচে থাকার শেষ আশ্রয়টি দুর্বল হয়ে পড়ছে। এটি সার্বিকভাবেই সমাজের সুসাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর একটি পরিস্থিতি।

মেধাবী ও দায়িত্বশীলদের আনাগোনা কমে যাওয়ায় সাংবাদিকতার জগতে ফটকা সাংবাদিকের ছড়াছড়ি। বেতন এদের কাছে মূখ্য নয়, মূখ্য হলো পরিচয়। পরিচয় ব্যবহার করে অপসাংবাদিকতার মাধ্যমে ভুক্তভোগী কিংবা সামাজিক শত্রুদের পকেট কেটে পয়সা কামানোর ফন্দি করে। আমার কাছ থেকে তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করে নামকরা সংবাদপত্রের এক সাংবাদিক মিথ্যা মামলা করা পক্ষকে দেখিয়ে রিপোর্ট প্রকাশের হুমকি দিয়ে পয়সা হাতিয়ে নিয়েছে বলে খবর এসেছে আমার কানে। খবরটি সত্য-মিথ্যা, না জেনেও বলা যায়, এটি একটি বাস্তবতা।

এখন অনলাইনভিত্তিক সংবাদপত্রের জয়জয়কার চলছে। যদিও এটি পাইলট প্রোগ্রামের মত গবেষণাকাল অতিক্রম করছে। ওয়েবসাইট ভিত্তিক সংবাদপত্রের পাশাপাশি ফেসবুকিং সাংবাদিকতাও জনপ্রিয় হচ্ছে। সরকারী নিবন্ধন নীতিমালা অনলাইন সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে খুব একটা সুস্পষ্ট হয় নি এখনো। তবে সামাজিকভাবে এর ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা এই নীতিমালাকে স্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট করতে অচিরেই সরকারকে মনোযোগী করে তুলবে বলে মনে হয়। স্ক্রিনে পড়ার সার্বজনীন চর্চাটি গড়ে উঠলে, গড়ে উঠবে তা একরকম নিশ্চিত, কাগজের পত্রিকা বাহুল্য মনে হবে। ডকুমেন্ট হিসেবে আর্কাইভে রাখার জন্য একটা মাত্র কপি প্রিন্ট দিলেই চলবে। বাকি সব পড়া-লেখা-উপস্থাপন অনলাইনেই চলবে। আগামী দিনের সাংবাদিকতা হয়তো এদিকেই যাচ্ছে। আমরা দেখি, ঐতিহ্যবাহী সংবাদপত্র থেকে ভালো ভালো সাংবাদিকগণ সাংবাদিকতা ছেড়ে মোটা বেতনের চাকরি-বাকরির দিকে ঝুঁকছে। প্রথম আলোর শরিফুল হাসান এক্ষেত্রে ভালো উদাহরণ হতে পারে। তিনি সাংবাদিকতা ছেড়ে একটি এনজিও তে চাকরি শুরু করার সময় ফেসবুকে বিস্তারিতভাবে তার কারন ও অপরিহার্যতা খুব খোলামেলাভাবে তুলে ধরেছিলেন।

দেশে কম্পিউটার ও ইন্টারনেট প্রযুক্তির ব্যাপ্তির ফলে ওয়েবসাইট তৈরির ব্যয় অনেক কমে গেছে। সাধারণ মানের একটি সাইট মাত্র তিন-চার হাজার টাকায়ও তৈরি করা যায়। অনেক ক্ষেত্রে তারও কম লাগে। এর ফলে ঢাকাসহ সারা দেশে অনলাইন মিডিয়ার ব্যাপক প্রসার ঘটছে। এমনও দেখা গেছে, একেকজন কম্পিউটার অপারেটরও একটি সাইট তৈরি করে ‘সম্পাদক’ বনে গেছেন। সংবাদপত্র অফিসের কোনো কোনো অফিস সহকারী এমনকি পিওনেরও অনলাইন পত্রিকা আছে। মূলত কোনো ধরনের আয় না থাকলেও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে বিজ্ঞাপনবাবদ ‘চাঁদা’ই তাদের মূল আয়। সেই সঙ্গে গুগলের বিজ্ঞাপনের আশায় অনেকেই নিউজপোর্টাল বানাচ্ছেন। আর নিজেকে পরিচয় দিচ্ছেন ‘সাংবাদিক’ হিসেবে। এছাড়া বিভিন্ন ক্ষেত্রে সাংবাদিক হিসেবে নিচ্ছেন বিশেষ সুবিধা।

ইতিহাস বলে, ১৯৭৪ সালে ব্রুস পারেলউ ইলিয়ন বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি অনলাইন সংবাদপত্র চালু করেন। ১৯৮৭ সালে শুরু হওয়া সরকারি মালিকানাধীন ব্রাজিলীয় সংবাদপত্র ‘জর্নালদোদিঅ্যা’ ৯০ দশকের দিকে অনলাইন সংস্করণের সূচনা করে। তবে যুক্তরাষ্ট্রে শতাধিক সংবাদপত্র অনলাইনে প্রকাশনা শুরু করে ১৯৯০ সালের শেষ দিকে। বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, বাংলাদেশে অনলাইন সাংবাদিকতার শুরু ২০০৫ সালের দিকে। ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা না থাকায় ২০১০ সাল পর্যন্ত এ মাধ্যমের পাঠক ছিল হাতে গোনা। এরপর মানুষের হাতের নাগালে সহজে ইন্টারনেট চলে আসে। বাড়তে থাকে অনলাইন পত্রিকার পাঠক। দেশে বর্তমানে কয়েক ধরনের নিউজ পোর্টাল বা অনলাইন পত্রিকা রয়েছেঃ
 ১. ডেইলি ইভেন্ট নিউজ পোর্টাল ২. বিশেষ সংবাদভিত্তিক নিউজ পোর্টাল ৩. বিশেষায়িত নিউজ পোর্টাল ৪. মিশ্র নিউজ পোর্টাল।

সংবাদপত্রকে বলা হয় তাড়াতাড়ির সাহিত্য। এক্ষেত্রে অনলাইন সংবাদপত্র হলো অতি তাড়াতাড়ির সাহিত্য। অনলাইন সাংবাদিকতার নীতিমালা ও তথ্যপ্রযুক্তি আইনের যুগোপযোগী সংস্কার ঘটিয়ে এবং নিবন্ধনের শর্তে দায়িত্বশীলতা-পেশাদারিত্ব নিশ্চিত করার ব্যবস্থা রেখে নতুন যুগের এই সাংবাদিকতাকে বিশ্বস্ত ও গঠনমূলক করা যেতে পারে। মানুষের দৈনন্দিন জীবনের গতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ, অনলাইন সাংবাদিকতাকে ঢেলে সাজিয়ে আস্থার জায়গায় উত্তীর্ণ করার ব্যাপক সুযোগ রয়েছে। ভালো মানুষের হাতে ভালো ও খারাপ মানুষের হাতে খারাপ, অনলাইন সাংবাদিকতাকে এমন অনিশ্চয়তার মধ্যে রাখা কিছুতেই উচিৎ হবে না।

লেখক: কবি ও গল্পকার

সম্পাদক : মো. শাহ্ দিদার আলম চৌধুরী
উপ-সম্পাদক : মশিউর রহমান চৌধুরী
✉ sylhetview24@gmail.com ☎ ০১৬১৬-৪৪০ ০৯৫ (বিজ্ঞাপন), ০১৭৯১-৫৬৭ ৩৮৭ (নিউজ)
নেহার মার্কেট, লেভেল-৪, পূর্ব জিন্দাবাজার, সিলেট
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.