আজ শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ ইং

জেগে উঠুক বাংলাদেশের ফুটবল

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৯-১০-১৬ ১২:১৪:১২

নব্বইয়ের দশকের প্রথমদিকে। সিলেট শহরের স্কুল ছাত্রাবাসের রাতের একটি ডিনারের আয়োজনের পূর্বে কিছু মুভি দেখানোর জন্য টেলিভিশন এবং ভিডিও প্লেয়ার আনা হলো ভাড়া করে। হঠাৎ বিকালের দিকে ছাত্রাবাসের কিছু বড় ভাইদের দেখলাম খুবই উত্তেজিত আর উত্তেজনার সাথে সিলেট উপশহরের বিদ্যুৎ সাপ্লাই কেন্দ্রে গিয়ে সাফ সাফ বলে এসেছেন আজ বিকালে বিদ্যুৎ না থাকলে ভাংচুর হবে বিদ্যুৎ কেন্দ্রে কারণ বিকালে আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচ।
সে কি উত্তেজনা।

কায়সার হামিদ-সাব্বির-কানন-রুক্সী-মুন্না- আসলাম এমন কিছু নামই তখন জানতাম। আর জানতাম জাফরুল্লাহ শরাফত-খোদাবক্স ম্রিধাদের নাম।

নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে আমাদের গ্রামের সবাই বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার ম্যাচ দেখার জন্য প্লান করতেছেন। ম্যাচের আগেরদিন আমাদের বৈদ্যুতিক স্ট্রান্সফরমার বিকল হয়ে গেলে বিদ্যুৎ অফিসে একাধিক বার যোগাযোগ করে ও কোন সদুত্তর না পেয়ে গ্রামের তরুণ যুবকদের ২৫/৩০ জনের এক‌টি দল বিয়ানীবাজারের বিদ্যুৎ অফিসে হানা দিয়ে নিজেরাই স্ট্রান্সফরমার নিয়ে আসতে শুরু করলে তাৎক্ষণিক ভাবে উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা লাইনম্যান পাঠিয়ে বিদ্যুৎ সংযোগের ব্যবস্থা করে দেন।

এই দুটি চিত্রই বলে দিচ্ছে বাংলাদেশের ফুটবলের উত্তান পতনের গল্পের সারমর্ম। ব্যবধান মাত্র ৮/৯ বছরের। দেশীয় ফুটবলের নিম্নগামীতা অন্যদিকে স্যাটেলাইট কল্যাণে ইউরোপীয় ফুটবলারদের ছন্দময় ফুটবলের অনবদ্য নৈপুন্যের আড়ালে ক্রমশই দেশী ফুটবলের আড়াল যাত্রা। ক্লাবের অভ্যন্তরে হাউজির পরিবর্তে ক্যাসিনোর আগমন।
অতপর শুধুই পতনের গল্প ক্লাব পাড়ায় আলফাজ-আমিনুল-মুন্নাদের নিয়ে আলোচনার জায়গায় স্থান করে নেন সম্রাট গং রা। প্লেয়ারদের জায়গায় চলে আসেন রাজনৈতিক "ভাই"রা।

আর জাতীয় দলের এমন কোন প্লেয়ার নাই যিনি আমাদের বিয়ানীবাজারের মাঠে খেলেননি সেটা ও এই ১৯৯০-হতে ২০০০ এবং পরবর্তীতে কয়েক দফায় ২০১২ পর্যন্ত। আমাদের শৈশব থেকে কৈশোর এবং পরবর্তীতে আফজাল-নকিব-জুয়েল রানা-জয়-বিপ্লব-আমিনুল পর্যন্তই।

ক্রীড়াপরিষদের এক‌টি অনুস্টানে কয়েকজন কোচ আর সাবেক প্লেয়ারদের চা পানের বিরতির এক‌টি আড্ডাতে আক্ষেপ শুনেছিলাম আলফাজ লেভেলের এক‌টি প্লেয়ার নাই যে কিনা তিন চারজন কে অবলীলায় টপকে যেতে পারে। শুধু মাত্র হেড ওয়ার্ক দিয়ে নকিব টপ স্কোরার হয়ে যেতেন। জুয়েল রানা কে তো মালদিনির মতো এক শ্রদ্ধাবোধ অর্জন করে নেয়া দলনেতা মনে হতো সবসময়ই। আর আমিনুল ই ছিলেন সম্ভবত দেশের শেষ ফুটবল সুপারস্টার যাকে বিমানবন্দর থেকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল সম্ভবত মুক্তিযোদ্ধা ক্রীড়াচক্র কোচ মানিকের দল বানানোর সময়ে।

অতপর দেশের ফুটবল প্রেমিরা শুধুই চিনেন সালাউদ্দীন নামক এক ব্যক্তিকে যিনি অতীতের সুপারস্টার আর বর্তমানের বাফুফের প্রেসিডেন্ট এবং বাংলাদেশের ফুটবল পতনের মূল কারিগর।

এতো সব অবস্থার মাঝে ও কিছু কিছু কোচ বাংলাদেশের ফুটবলারদের নিয়ে চেষ্টা করে যাচ্ছেন সামর্থ্যের সবটুকু দিয়ে তাদেরই একজন এই জেমি ডে।অন্যদের মাঝে ছিলেন অটো ফিস্টার-সামির শাকির ডিডো-ক্রুসিয়ানি- সার্বিয়ান জুরান জার্ভেচিব অন্যতম।

সাল মনে নেই তবে নব্বইয়ের শেষের দিকে আমরা যখন স্বর্ণ পদক অর্জন করি এশিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে সেই ম্যাচে আলফাজের পায়ে বল যাওয়া মাত্র ভারতের ধারাভাষ্যকারদের সম্মেলিত চিৎকার ছিলো আলফাজ কিলিং দ্যা টাইম কারণ তখন বাংলাদেশ এক শূন্য গোলে এগিয়ে এবং খেলার শেষ পর্যায়ে। এবং বিপ্লব /আমিনুল সময়ে সাফ চ্যাম্পিয়ন সম্ভবত ২০০৩/৪ মৌসুমে।

আজ কলকাতায় একই অবস্থায় থেকেও শেষ মূহুর্তের গোলে জয়ের বদলে ড্র নিয়ে আসতে হয়েছে এক মাত্র একজন আফজাল কিংবা জুয়েল রানাদের অভাবে। তারপর ও এই ড্র জয়ের চেয়ে বেশী কারণ শেষ বিশ বছরে বাংলাদেশ ক্রমশ তলানির দিকে ধাবিত হচ্ছে আর ভারত ক্রমাগত ভাবেই এগিয়ে যাচ্ছে।

আমাদের সময়ে বাইচুং ভুটিয়া নামক এক প্লেয়ারের তফাৎ ছাড়া বাংলাদেশ-ভারতের একাদশ এর পারফরম্যান্স ছিলো প্রায় সমমানের। বাইচুং সেখানে অধিকাংশ বারই তফাৎ বানিয়ে দিতো জয় ছিনিয়ে নিয়ে।

আজকের এই বাংলাদেশ দল কে চিনি না এক জামাল ভূইয়া ছাড়া ভারতের ক্ষেত্রে ও সুনিল ছেত্রী ছাড়া কাউকে চিনি না তারপর সেই নব্বইয়ের দশকের প্রথমদিকের নাম না জানা আবাহনী-মোহামেডানের ম্যাচের ন্যায় চরম উত্তেজনা নিয়ে দেখলাম বাংলাদেশ বনাম ভারত ম্যাচ।

কলকাতার ফুটবল ক্রেজ দেখে মনে হলো এতো বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের সেই গর্জনরত আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচ যেখানে আমি মফস্বল থেকে ঢাকায় গিয়ে সুযোগ পেয়ে ম্যাচ দেখতে গিয়ে ভুলে প্রতিপক্ষের গ্যালারিতে ঢুকে পড়েছিলাম।
বোবার ন্যায় ম্যাচ জিতে প্রতিপক্ষের ডেরা থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছিলাম এক ঢাকাইয়া ভাইয়ের কল্যাণে যিনি বুঝেছিলেন এই বালক ফুটবল প্রেমি কিন্তু বুঝে নাই বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম এর কোন গ্যালারি কার অলিখিত মালিকায় থাকে আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচে।

পরিকল্পনা আর সঠিক পরিচর্যা চালু করা গেলে আমাদের এই তরুণদের মাধ্যমেই নব জাগরণ সম্ভব এবং এটাই দেখিয়ে দিচ্ছে দামাল ছেলেরা। বাকিটুকু জন্য প্রয়োজন সদিচ্ছা আর পেশাদারী ব্যবস্থাপনা। দর্শক শক্তি আর ফুটবল প্রেম যে এখনো আছে সেটা আজ আবারও প্রমাণিত।

লেখক :: ফুজেল আহমেদ, টরন্টো, কানাডা।

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন