আজ শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ ইং

শিক্ষকের মর্যাদা বৃদ্ধির আন্দোলন প্রসঙ্গে

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৯-১০-২৫ ১২:১৮:২৬

মো. তোফায়েল হোসেন :: প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন ও মর্যাদার দাবীতে চলমান আন্দোলন সম্পর্কে সকলেই অবগত আছেন। আমি দেশের বুদ্ধিজীবি, সচেতন নাগরিক, নীতিনির্ধারক, রাজনীতিবিদ এবং আপামর শিক্ষক সমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করে প্রাথমিক শিক্ষকদের মর্যাদার প্রসঙ্গটিকে যৌক্তিকভাবে তুলে ধরতে চাই। আমার বাবা একজন প্রাইমারি শিক্ষক ছিলেন। তাঁর সন্তান হিসেবে আমার আজন্ম শখ ছিলো শিক্ষক হওয়া। মেধা ও যোগ্যতার সৌভাগ্যক্রমে আমি সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসার পদের চাকরিটি পেয়ে যাই। চাকরিটি আমার জন্য যত না রুটি-রুজির, তার চেয়ে বেশি আজন্ম শখের পরিপূরক হিসেবে। বাবার পেশার প্রতি ভালো লাগা থেকে এবং শিশুদের সর্বোচ্চ বিকাশে সামান্য ভূমিকা রাখার সুযোগ পেয়ে অশেষ আনন্দ ও পরিতৃপ্তি লাভ করেছিলাম।

আমার চাকরিটি পদাধিকার বলে শিক্ষকদের বসের আসনে অধিষ্ঠিত। কিন্তু চাকরি করতে গিয়ে নিজেকে কখনো বস মনে হয় নি আমার, মনে করতে আমার মন সায় দেয় নি। বলা যায়, শৈশবের অজ্ঞানতায় বাবার পেশাকে যেটুকু ধরতে ও বুঝতে পারি নি, সেটুকু বুঝতে পারার একটা সুযোগ পেয়ে গেছি। শিক্ষকদের প্রতি শৈশবের শ্রদ্ধাবোধ তখনো বজায় ছিলো আমার। শুধু তখন না, শ্রদ্ধাটি এখনো বজায় রয়েছে। দেশের প্রতিটি শিশু প্রাথমিক স্তরের শিক্ষকের হাত দিয়ে বেড়ে ওঠে। বড় হয়ে তারপর মাধ্যমিক স্তরে যায়। এরপর উচ্চ মাধ্যমিক হয়ে উচ্চ শিক্ষা স্তরে প্রবেশ করে। উচ্চ শিক্ষা স্তরে পড়াশোনা করার সময় মেধাবী শিক্ষার্থীরা আর প্রাইমারির শিক্ষক হবার স্বপ্ন দেখে না। বিসিএস, উচ্চ বেতনে প্রাইভেট কোম্পানী কিংবা এনজিও, এমনকি নিদেন পক্ষে কলেজের শিক্ষক হবার স্বপ্ন দেখে। কিন্তু প্রাইমারির 'মাস্টার' হবার কথা ভুলেও ভাবে না। আমার মনে হয়, এখানেই লুকিয়ে রয়েছে সমস্যার মূলটি।

শিশু যখন বড় হয়ে দেখে, তার শৈশবের গুরুজন সামাজিকভাবে 'থার্ডক্লাস' ক্লাস নাগরিক, গুরত্বহীন মানুষের মত বিচরণ করে, সরকারি ও প্রশাসনিক কোনো জায়গাতেই তাকে গুরত্বপূর্ণ মনে করা হয় না, তখন তার ভেতরে লালিত শ্রদ্ধাবোধটি প্রকাশ করার সৎসাহস সে হারিয়ে ফেলে। আর এই সৎসাহসের অভাবই তাকে অন্য পেশায় যেতে তাগিদ দেয়। মেধার সংকটটি এখান থেকেই শুরু। তবে সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ থেকে পাশ করা ছাত্ররাও আজকাল প্রাইমারির শিক্ষকতায় প্রবেশ করছে। এটা দেখে কেউ কেউ উচ্ছ্বসিত হয়ে থাকতে পারে। মনে রাখতে হবে, এদের প্রবেশ করার কারন শিক্ষকতা বিশেষত প্রাইমারির শিক্ষকতাকে ভালোবেসে নয়। একটা সরকারি চাকরির প্রয়োজনীয়তা থেকে। বহু চাকরির ইন্টারভিউ দিয়ে বয়স ফুরিয়ে যেনতেন একটা চাকরি পেয়ে বেঁচে থাকার অবলম্বন খুঁজতে গিয়ে এই শ্রেণির মেধাবীরা প্রাইমারির শিক্ষক হতে আসে। ফলে এখানেও আমাদের জন্য কোনো সান্ত্বনা নেই।

তাহলে শিক্ষক হিসেবে বর্তমানে যারা কর্মরত আছে, তারা কি কেউ মেধাবী নয়? প্রশ্নটা যৌক্তিক। কিন্তু উত্তরটা সহজ নয়। সহজ না হওয়ার কারন অনেক। বহু লোক আছে যারা শুধু শিক্ষকতাকে ভালোবেসে এই পেশাতে এসেছে। তারা কাগজে কলমে মেধাবী হোক বা না হোক, তারা সবচেয়ে যোগ্য এই পেশার জন্য। অনেক না পাওয়াকেও তারা পেশাগত আনন্দের বদৌলতে পুষিয়ে নিতে পারে। কিন্তু সামাজিকভাবে খুব একটা লোভনীয় চাকরি নয় বলে মনের দিক থেকে সব সময় ছোট হয়ে থাকে। আবার যারা শুধু চাকরি করতে এই পেশায় আসে, তারাও কাংখিত মর্যাদা ও মূল্যয়ণ না পেয়ে এক সময় হতোদ্যম হয়ে পড়ে এবং কাজের প্রতি মনোযোগ হারিয়ে ফেলে।

অপরদিকে শিশু শুধু বই পড়ে না, জীবন থেকে শেখে, অন্যদের দেখেও শেখে। বিদ্যালয়ে অবস্থানকালীন সময়েও শিশু এই প্রক্রিয়ার বাইরে যেতে পারে না। ফলে প্রাথমিক স্তরে শিক্ষকের কাজ বহুমুখী। যিনি শিক্ষক তিনিই কেরাণী, তিনিই অভিভাবক ও পথপ্রদর্শক। অনেকটা গুরুর ভূমিকায় অবতীর্ণ। কিন্তু আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় যে শিক্ষক যত ছোট শিক্ষার্থী পড়ায় তাকে তত কম গুরত্ব দিয়ে দেখা হয়। এই দেখাতে দুটো সমস্যা তৈরি হয়। প্রথমত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকের পরিশ্রমটিকে অবমূল্যায়ণ করা হয়। দ্বিতীয়ত শিশুদের মনে গভীর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। শিশু যখন দেখে, তার গুরুজন ও পথপ্রদর্শককে কোনো মর্যাদাই দেয়া হচ্ছে না, গুরত্ব নেই তার আদর্শ মানুষটির; জীবন ও জগত সম্পর্কে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা তৈরি হবার সম্ভাবনাটিই তখন প্রচন্ড মার খায়। অথচ প্রাথমিক স্তরে প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণিকে সবচেয়ে গুরত্ব দিয়ে দেখা হয় এবং সেভাবেই চলছে এখন। প্রাথমিক শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের সাথে সমাজ মানসের একটি বিরাট পার্থক্য আমাদের চোখ এড়াতে পারে না। আমার মনে হয়, এই পার্থক্য ঘুচানোর সময় এসেছে আজ।

প্রাথমিক স্তরে শিশুর ব্যবস্থাপনা খুবই কষ্টকর ব্যাপার। শিশু যতো বড় হতে থাকে তার ব্যবস্থাপনাও সহজ হতে থাকে। একদিনের শিশু আর এক বছরের শিশু লালন-পালনে পার্থক্য অনেক। আবার এক বছরের শিশুর তুলনায় দশ বছরের শিশুর যত্ন ও পরিচালনা অনেক সহজ। দশ বছরের শিশু আর বিশ বছরের শিশু আকাশ-পাতাল পার্থক্য করে দেয়। আমাদের দেশে শিক্ষার তিনটি স্তর রয়েছে। প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা। মাধ্যমিকের একটি উপস্তর উচ্চমাধ্যমিক।

বিশ্ববিদ্যালয়ে যে শিক্ষার্থী ভর্তি হতে যায় তার মুটামুটি একটা কাঠামো ও ধরণ ইতিমধ্যে তৈরি হয়ে যায়। এমন মানুষের ব্যবস্থাপনা সহজ। বিশেষত বেঞ্চে বসা, আগমন-প্রস্থান, প্রবেশ-বাহির, খাওয়া, পোশাক পরা, সহপাঠীদের সাথে সম্পর্ক ও পড়াশুনায় যার যার দায়িত্ব নিজেই পালন করে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও শিক্ষকগণ মৌখিক ও ক্ষেত্রবিশেষে লিখিত নির্দেশনা দিয়েই দায়িত্ব শেষ করতে পারে। জটিল ও বেআইনি পরিস্থিতিতে পুলিশের সহযোগিতাও নিতে পারে। কিন্তু উল্লিখিত বিষয়গুলোতে প্রাথমিক স্তরে এর কোনোটাই কার্যকর নয়।

শিশুকে একই নির্দেশনা বারবার দিতে হয়। তাদের মধ্যে খুনসুটি, ধস্তাধস্তি নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। বিদ্যালয়ে শিশুর অভ্যাস ও আচরণিক ব্যবস্থাপনা খুবই পরিশ্রমের কাজ। শিক্ষকদের এসব সামলাতে গিয়ে প্রায়ই গলদঘর্ম হতে হয়। কিন্তু এগুলো ধর্তব্যের মধ্যেই আনা হয় না। বিরামহীন পড়ানোর জন্য নিয়োজিত শিক্ষক বাস্তব এই সমস্যাগুলোর মুখে পড়ে হিসেব মেলাতে পারে না। কোনো পুরষ্কার বা প্রতিদান নেই তার জন্য।

এর বাইরে ভয়ংকর একটি বাস্তবতা রয়েছে। সচরাচর সেটি আলোচিত হতে দেখা যায় না। আমার অভিজ্ঞতা থেকে দু'একটি ঘটনার উদাহরণ দিয়ে এই বাস্তবতা তুলে ধরার চেষ্টা করবো।

একবার এক স্কুলে আয়োজিত সাবক্লাস্টার প্রশিক্ষণে কতিপয় শিক্ষক নেতা কোনো রকম না বলে কয়ে হাজির হয়। তারা তখন স্থানীয় এমপি মহোদয়ের সাথে সুসম্পর্কের বদৌলতে কর্তৃপক্ষকে থোড়াই কেয়ার করতে শুরু করেছে। তারা আমার তত্ত্বাবধানে পরিচালিত উক্ত প্রশিক্ষণে খুবই দৃষ্টিকটুভাবে উপস্থিত হয় এবং পরিবেশকে এলোমেলো করে ফেলে। স্বভাবতই আমার মনঃক্ষুণ্ন হবার কথা। তারা আমাকে অন্তত জানিয়ে আসতে পারতো। এটা ভেবে একটু অভিমান হচ্ছিলো আমার। অনুমতি তো দূরের কথা, আমাকে তারা জানিয়ে আসার সৌজন্যটুকুও প্রদর্শন করে নি। উল্টো তারা আমার প্রশিক্ষণ কক্ষটি দখল করে বসেছে এবং সমবেত প্রশিক্ষণার্থী শিক্ষকদের নানা ছবক দিয়ে চলছে। আমি এজন্য তাদের কোনো প্রশ্ন করি নি এবং তিরষ্কারও করি নি। শুধু তাদের সাথে এক টেবিলে বসে দুপুরের ভাত খেতে অসম্মতি জ্ঞাপন করেছিলাম। তারা আমার এ অভিমান প্রদর্শনকে রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখলো। প্রতিশোধ নিতে তারা যেটি করেছিলো, সেটি শুনলে আপনি স্তম্ভিত হয়ে যাবেন। স্থানীয় যুবলীগ-ছাত্রলীগের নেতাকর্মীকে গিয়ে বলেছিলো, আমি নাকি সাবক্লাস্টার প্রশিক্ষণে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কটুক্তি করেছি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে কটুক্তি করেছি এবং স্থানীয় এমপি মহোদয়কে নিয়ে বাজে কথা বলেছি! পরের দিন অফিসে এসে উপজেলা ছাত্রলীগ-যুবলীগের প্রায় পঞ্চাশজনের একটি বাহিনী আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে আমাকে চরমভাবে লাঞ্ছিত করে গেলো। এরাও শিক্ষক, এরাও সরকারের টাকা বেতন হিসেবে নেয়!

আরেক উপজেলায় পাঁচজনের একটি চক্র আমার এক সহকর্মী দ্বারা প্ররোচিত হয়ে ঐ এলাকার মাননীয় সংসদ সদস্যের কাছে আমার সম্পর্কে আপত্তিকর কিছু বিষয় তুলে ধরে আমার বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলার চেষ্টা করে। আমার সহকর্মী আমার প্রতি রুষ্ট হয়েছিলো কারন আমি শিক্ষা অফিসারের কাছে বেশি প্রিয় এবং শিক্ষা অফিসার বিভিন্ন ব্যাপারে আমাকে গুরত্ব দিতে থাকেন। ঐ সহকর্মী আগে থেকেই পাঁচজন শিক্ষকের চক্রটাকে নিয়ে বিভিন্ন রকম বাণিজ্য করে আসছিলো। নতুন শিক্ষা অফিসারের আমার প্রতি দুর্বলতা দেখে সহকর্মী তার চক্রকে হীনস্বার্থে এহেন জঘণ্য কাজে ব্যবহার করে। আমি ঐ সহকর্মীকে যেমন আমার সহকর্মী মনে করি না, তেমনি ঐ শিক্ষক নামের নোংরা মানুষ পাঁচজনকেও শিক্ষক সমাজ শিক্ষক মনে করবে না বলেই আমার বিশ্বাস।

আরেক উপজেলায় একজন শিক্ষক নেতাকে মিটিংয়ের মধ্যে অশোভন কথা বলতে নিষেধ করলে সে প্রচন্ড ক্ষুব্ধ হয় আমার উপর। তার ক্ষোভের বহিপ্রকাশ ঘটায় সে আমার সম্পর্কে নানান মিথ্যা বলে উপজেলা চেয়ারম্যানকে ক্ষেপিয়ে তোলার মাধ্যমে। উপজেলা চেয়ারম্যান তার উপপত্নী স্বরূপ এক শিক্ষিকা দিয়ে আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা শ্লীলতাহানির অভিযোগ করে এজাহার দাখিল করে থানায়।

এরাও শিক্ষক। শুধু শিক্ষক নয়, শিক্ষক নেতা হিসেবে পরিচয় দিয়ে বেড়ায়। এই ধরনের নোংরা চরিত্রের শিক্ষকদের ভয়ে তটস্থ থাকে সকল শিক্ষক এবং কর্মকর্তা। আমি বিশ্বাস করি, আজ যারা মর্যাদার প্রশ্নে আন্দোলনে নেমেছে, তারা এই ধরনের জঘণ্য মানুষকে তাদের শ্রেণিভুক্ত মনে করে না। এই উপদ্রব বাংলাদেশের বিভিন্ন উপজেলায় বিরাজমান। শিক্ষকদের যেটুকু মর্যাদা এখনো টিকে রয়েছে, এইসব উপদ্রব সেটুকুকেও কলঙ্কিত করছে। এদেরকে চিহ্নিত করে সামাজিকভাবে বয়কট করার সময় হয়েছে।

সবশেষে বলতে চাই, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকতা হোক যথাযথ মর্যাদার এবং মেধাবীদের নিকট আকর্ষণীয়তম পেশা। শিশুর সর্বোচ্চ বিকাশ নিশ্চিত করে উন্নয়নের বাতিঘর হিসেবে প্রাথমিক শিক্ষা স্তর সর্বোচ্চ ভূমিকা পালন করুক। একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় দেশকে এগিয়ে নেয়ার স্বপ্ন বাস্তবায়নে প্রাথমিক শিক্ষকদের সর্বোচ্চ ভূমিকা পালনের সুযোগ ও পরিবেশ নিশ্চিত হোক। আর এটি শিক্ষকের যথাযথ মর্যাদার সাপেক্ষে যথাযথ বেতন নিশ্চিত করার মাধ্যমে বহুলাংশে সম্ভব হবে বলেই আমরা মনে করি।

লেখক :: সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসার।

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন