Sylhet View 24 PRINT

স্মৃতিতে ধীরেশ স্যার

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৯-১০-৩১ ০১:০৪:০৮

সৈয়দ হক :: ফেসবুক স্ক্রল করতে প্রতিদিন রাতে একেকটা মৃত্যুর খবর আর নিতে পারছি না। প্রথমে কেউ একজন একটা স্ক্রিন শর্ট নিয়ে বললো ধীরেশ স্যার মনে হয় আর নেই। ম্যাসেঞ্জারে আবার খবর নিলাম ঐ খবরের সত্যতা নিয়ে। তিনি আমাকে একটি স্ক্রিন শর্ট পাঠালেন। শোয়েব আদমজী ভাইকে গভীর রাতে ফোন দিলাম। রাশভারী গলায় আলাপ শুরু হলেও তাঁর গলা ধরে গেলো। রেখা আপা (শোয়েব ভাইয়ের স্ত্রী) ফোন নিয়ে বললেন ঘটনা সত্যি। তাঁদের কাছ থেকে খোজ নিলাম এই কারণে যে স্যার দু তিন বছর আগে লন্ডনে যে বেড়াতে এসেছিলেন তিনি তাঁদের বাসায় উঠেছিলেন।রেখা আপা তো রীতিমত কাঁদছেন। অংকের মতো ভয়াবহ সাবজেক্ট নাকি স্যার তাঁকে সহজ করে দিয়েছেন। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে গিয়ে স্যারকে নাকি তিনি দীর্ঘ চিঠি লিখেছিলেন। আর সে চিঠি স্যার যত্ন করে রেখে দিয়েছিলেন। আমি চোখ মুছি।

ইন্টার মিডিয়েটে আমরা যখন ভর্তি হই। এম সি কলেজের টিলার উপর বিশাল আর্টস বিল্ডিঙে স্যার এর সাথে আমাদের প্রথম ক্লাস। তাও আবার অংকের ক্লাস। সিলেট শহরের আমরা যারা সাইন্স নিয়ে পড়তে এসে এমসি কলেজে ভর্তি হই তাঁদের মধ্যে গর্ভমেন্ট স্কুল এবং এইডেড স্কুলের ছাত্ররা সংখ্যায় বেশী হওয়ায় এই দুই গ্রুপকে ট্যাকেল দেওয়া সমস্যা হয়। প্রথম দিনেই স্যারের সাথে মোলাকাত। স্যার মনে হয় হোম ওয়ার্ক করে এসেছেন। জিন্স ট্রেইনার টি শার্ট গলায় সোনার চেইন, ব্লেজারের হাত মোড়ানো এসেই নিজের নাম পরিচয় দিয়ে অংক করানো শুরু করলেন। গ্যালারী টাইপ ক্লাস রুম। নৌকার অংক। স্রোতের অনুকুল আর প্রতিকুলের অংক। আমাদের স্বভাবজাত দুস্টমিতো আছেই। হঠাৎ স্যার আমাদের প্রয়াত বন্ধু কৌশিক রঞ্জনকে অংকের বিষয় নিয়ে ডাকলেন। সে আমতা আমতা করতেই স্যারের মাইর শুরু । কি মাইর !!পরে টিটু।আবার মাইর !! আমার লাল শার্ট পরা ছিলো। স্যার আমাকে অনেকক্ষণ দাঁড় করিয়ে দিয়ে বললেন, ক্লাস শেষ না হওয়া পর্যন্ত দাড়িয়ে থেকো।ক্লাস শেষ হলে স্যার বললেন, ঝি রে মেরে বউরে বুঝানো হলো। মানে হইলো গর্ভমেন্ট আর এইডেড স্কুল সাইজ। কঠিন অনুশাসনের মাঝে বড় হওয়া আমরা এরকম শিক্ষকে অভ্যস্থ নই। এই স্যার আমাদের সাথে ক্যারাম খেলেন, ব্যাডমিন্টন খেলেন। স্যারের সিগারেট ছেলেরা মেরে নিয়ে কমনরুমের পিছনে গিয়ে ফুঁকে, ধোঁয়া উড়ায় ।

এরপর থেকে স্যার এর সাথে আস্তে আস্তে ঘনিষ্টতা ব্যাড়তে লাগলো। আমরা দশজন বন্ধু স্যার এর কাছে প্রাইভেট পড়তে শুরু করলাম। সুপহানিঘাট মসজিদের পাঁশে দিঘী। বিপরীতে গলি। গলির মুখে টং দোকান।টিনশেড বাড়ী। চামেলি আপার বাবা তাহের আলীর। একটু দূরেই আবুল কাহের শামীম ভাইয়ের বাসা। পাশেই বিজিত দা থাকেন বিজিত দায়ের বোনের বাসায়। স্যার লুজ পেপার শিটে আমাদের অংক করান। অনেক কথাই হয় পড়ার ফাঁকে। স্যার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন । জগন্নাথ হলে থাকতেন। বলতেন হলে না থাকলে ছাত্রদের প্রতি , মানুষের প্রতি সহমর্মিতা বাড়ে না। হিন্দু মুসলমান সবার রক্ত কিন্তু এক। মানুষ হও। হলে থাকো বুঝবে।

তাঁর মায়ের বাড়ি সিলেটে। বাবার বাড়ি ময়মনসিংহ। মায়ের অনুরোধে সিলেট আসেন।বিয়ে করেন পছন্দ করে। বৌদির নাম দুলু। স্যার আদর করে ডাকতেন রেণু। মেয়ে দীপতা। ডাক নাম নীপা। ছেলে ধীমানের মনে হয় তখন জন্ম হয়েছে। আমরা যখন পড়তাম বৌদি আম্বর খানায় সোনালী ব্যাংকে কাজ করতেন।

অনেকদিন প্রায় ৩০ বছর হবে স্যার এর সাথে দেখা নাই। মাঝখানে একবার লন্ডন আসলেন। প্রথমবার আলাপে স্যারকে ‘রাসেল, তৌহিদ, সাহেদ’ এসব কি ওয়ার্ড দিয়ে চিনাতে হল। পরের দিন প্রায় এক ঘণ্টা আলাপ হলো। সেই আমার মায়ের কথা , দেশ, রাজনীতি, মরাল, ভ্যালু ইত্যাদি। স্যার আমাকে মেয়র ডাকতেন। শেষ আলাপেও দেশে যাওয়ার কথা বলেছিলেন। এর মধ্যে বৌদির বিরল অসুখের কথা বললেন। কেমো দিতে ভারত যেতেন। আমেরিকায় মেয়ের কাছে যেতেন মাঝখানে দেখতাম স্যার ফেসবুকে খুব একটিভ। রাত জাগা। আমার লেখায় লাইক। মাঝখানে নিউজিল্যান্ড এর ঘটনার পরে স্যার একদিন ম্যাসেজ পাঠালেন, লিখাটা খুব ভাল হয়েছে। তুমি যে লিখতে পারো আমি জানতাম না।লিখে যাও। মাঝখানে একদিন স্যার কে বললাম , স্যারের লাইক নাই ক্যান। স্যার বললেন সব কাজে লাইক, হাততালির দরকার নাই। ভাল কাজ করে যাও মানুষই তোমাকে মনে রাখবে। স্যার আমার মাকে বলেছিলেন, হি ইজ এ গুড হিউম্যান বিট লেজি বাট....। কাল সারারাত আপনাকে মনে পড়েছে স্যার। আমার মা কেও মনে পড়ছে। দিব্যান লোকান স্বগচ্ছতু ।।

সম্পাদক : মো. শাহ্ দিদার আলম চৌধুরী
উপ-সম্পাদক : মশিউর রহমান চৌধুরী
✉ sylhetview24@gmail.com ☎ ০১৬১৬-৪৪০ ০৯৫ (বিজ্ঞাপন), ০১৭৯১-৫৬৭ ৩৮৭ (নিউজ)
নেহার মার্কেট, লেভেল-৪, পূর্ব জিন্দাবাজার, সিলেট
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.